সিডনির মেলব্যাগ- মিডিয়া ও অগ্রসর সমাজ ভাবনা by অজয় দাশগুপ্ত

বাংলাদেশের মিডিয়া এখন তুঙ্গস্পর্শী সময়কাল পার করছে। চ্যানেলের প্রাবল্য, পত্রিকা তথা প্রিন্ট মিডিয়ার জোয়ারে ভাসছে দেশ। কোন্টা রেখে কোন্টা দেখবেন, কোন্টা শুনে কোন্টায় চোখ বুলোবেন সে পছন্দ রীতিমতো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
মিডিয়ার এই রমরমা সময় দেখে আমাদের মতো বয়স্কজনদের অনুভূতি মিশ্র হওয়াটাই স্বাভাবিক। একটা সময় ছিল যখন দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ব্যতীত দেখা ও শোনার বিকল্প কোন বাহন ছিল না। সে দুঃসহ কালে সরকার ও দল নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বক্্রগুলো এক পরে সাফাই গাইতে গাইতে জন-পরিত্যাজ্য হয়ে পড়তো। যাদের প েগীত গাওয়া পরবতর্ী নির্বাচন বা জনপ্রিয়তার পরীায় তাদের ধস নামানো পরাজয় নিশ্চিত করাই ছিল এদের কাজ। জনগণ রাষ্ট্র তথা সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার বিনোদন ব্যতীত কোন বক্তব্য বা মতামত গ্রহণ করত না। আজ যখন এত এত মিডিয়া সে ক্রানত্মিকাল পার হয়ে দেশ কি নতুন কোন পথের সামনে দাঁড়াতে পারছে? সত্তর দশকের দুর্ভাবনা, আশির দশকের স্বৈরতন্ত্র নব্বইয়ের অভু্যত্থানে গণতন্ত্রের মুক্তি মিডিয়াকে খুলে দিয়েছে বটে, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এখনও সমানত্মরালভাবে গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি।
আমাদের বিপুল জনসংখ্যা দুশ্চিনত্মার পাশাপাশি সম্ভাবনাও, যে কারণে বহু উন্নত দেশের মিডিয়াকে ফেলে সংখ্যা ও মানে এগিয়ে রয়েছি আমরা। কারিগরি মান ব্যতীত অস্ট্রেলিয়া বা নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের মিডিয়াও আমাদের কাছে শিশু। আমাদের অনুষ্ঠানমালাও বিশাল সংস্কৃতি ভাণ্ডার এশিয়ার ছোট ছোট দেশ বা ুদ্রজাতিসত্তাগুলোর জন্য বিস্ময়। সাম্প্রতিক সময়ে কম্বোডিয়া ও ব্যাংকক অবস্থানকালে সেসব দেশের টিভি তথা ইলেকট্রনিক চ্যানেলগুলো দেখেই এই প্রত্যয় জন্মেছে। আমাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত আকাঙ্খা মিলে যে ভাণ্ডার তার কাছে এগুলো সাফল্য।
মিডিয়া নিয়ে এই বাতচিত বা লেখালেখির কারণ কি? কেন এই প্রসঙ্গ? এ প্রশ্ন জাগতেই পারে। অতিক্রানত্ম একুশে আমাদের দেশের বড় অর্জন বা ফলাফল নিশ্চিতভাবে সংস্কৃতি। আর তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রধান ও সবচেয়ে বড় অবলম্বনই হচ্ছে মিডিয়া। বাংলাদেশ বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির পীঠস্থান যদি ঢাকা হয়, তার মিডিয়াই তার চু। চু যদি নির্মল, স্বচ্ছ ও আধুনিক হয়, দৃষ্টিভঙ্গিও হবে পরিচ্ছন্ন। পরিচ্ছন্ন, প্রগতিশীল দৃষ্টিপাত ব্যতীত আমাদের সমাজ ও দেশের সমস্যা নির্ণয় বা সমাধান কোনটাই সম্ভব হবার নয়। মিডিয়ার এই চরম বিকাশলগ্নে পুরোটা বা সম্পূর্ণ জগতটিকে এক কথায় পজিটিভ বলতে পারলে ভালো লাগতো। কিনত্মু দুঃখজনক হলেও সত্য, তা বলা যাচ্ছে না। কেন তা বলতে পারছি না?
রাজনীতি তো বটেই, সংস্কৃতির দিক থেকেও প্রতিবন্ধক দূর হয়নি। উন্নয়নশীল দেশ নামে পরিচিত আমাদের মতো দেশের সমাজ নানাবিধ কলহে এমনিতেই দুর্বল। শক্তিমান বা শক্তিধররা সব সময়ই মিডিয়া নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী ও ব্যগ্র হয়ে পড়ে। তাদের ধারণা, এ কাজটি ব্যতীত প্রতিষ্ঠা, আধিপত্য কিংবা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা অসম্ভব। সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দল বা প্রতিপও এখন আর চোখ বুজে সময়পেণে আগ্রহী নয়। ব্যক্তিমালিকানা ও প্রাইভেটাজাইশনের এই যুগে টিভি কেন্দ্র, রেডিও স্টেশন, পত্রপত্রিকার মালিকানা কোন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের নব্য ক্রোড়পতি, মিলিওনিয়ার থেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সবাই এখন মিডিয়ামুখী। বিগত কয়েক বছরে এর চূড়ানত্ম নমুনা দেখছি আমরা। এই পস্নাবনে একদা প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাসযোগ্য মিডিয়াগুলোও নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে জেগে উঠতে চাইছে। বলাবাহুল্য, বিবিসি, ভোয়া-নির্ভর বিশ্বাসযোগ্যতা হ্্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে প্রবাসী বাঙলীরা গড়ে তুলেছে নিজস্ব জগত। তাদেরই এখন শেকড় অনত্মপ্রাণ। অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রামের বাঙালীর বিবিসি বা তোয়ার খবর জেনে সত্যতা যাচাইয়ের যুগ এখন গত। অন্যদিকে বহির্বিশ্বের বাঙালী ঢাকা বা বাংলাদেশ ছাড়া অচল।
পারস্পরিক নির্ভরতা, পাল্টে যাওয়া এই কালে দেশের মিডিয়াকে দিতে হবে রাজনৈতিক নিরপেতা। পরিষ্কার করে বলা উচিত নিরপেতা মানে দলভেদে গুরম্নত্ব নিয়ে বা অহেতুক ইসু্য নিয়ে বিরোধিতা পরিহার। কিনত্মু তার মানে এই নয় মুড়ি-মুড়কির সমান দর। স্বাধীনতাবিরোধী, রাষ্ট্রবিরোধী ধর্মান্ধ, জঙ্গীবাদীদের প্রশ্রয় দেয়া নিরপেতা নয়। নিরপেতা মানে মুক্ত বুদ্ধি, মুক্ত চিনত্মার স্বদেশ প্রত্যাশা। আমাদের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার অধিকাংশই সেইদিকে সজাগ। হাতেগোনা, ভঁূইফোঁড়দের বাদ দিলে পরিস্থিতি অনুকূল।
মিডিয়ার কথা নিয়ে এ কিসত্মিটির লেখার আরেকটি বড় কারণ একুশে। একুশে ফেব্রম্নয়ারির কল্যাণে, তার অবদানেই বাংলা মিডিয়া আজ এ অবস্থানে আসতে পেরেছে। উগ্র সুনাম, যশ আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী দেশ বিদেশের বাঙালি ও বাংলা মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পিত রূপরেখার আজ বড়ই প্রয়োজন। স্বাধীন দেশের প্রাপ্ত মনস্ক সমাজের এই দায় মেটাতে সংশিস্নষ্টজনরা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন।
ফধংমধঢ়ঃধধলড়ু@যড়ঃসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.