কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড, প্রাপ্তি ও উপাদন by এ এম এম শওকত আলী

ফেব্রুয়ারি-২০১০ কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলায় উদ্বোধন করেছেন। উপকরণ সহায়তা কার্ড বিতরণের অন্যতম প্রধান লৰ্য হলো উপকরণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করা।
সেচযন্ত্রের ৰেত্রে ডিজেল ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত ভতর্ুকি যাতে পায় তা নিশ্চিত করা। সর্বমোট ১ কোটি ৮২ লাখ কৃষকের মধ্যে এ কার্ড বিতরণ করা হবে। এ ধরনের কৃষক ও কৃষিবান্ধব উদ্যোগ ইতিহাসে সর্বপ্রথম গ্রহণ করা হলো, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এর সঠিক মূল্যায়নের সময় এখনও আসেনি। কারণ এ প্রথা সবেমাত্র চালু করা হয়েছে।
ডিজেলে ভর্তুকি প্রদানের জন্য কৃষকদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলারও সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। অর্থাৎ এ এ্যাকাউন্ট থেকেই প্রাপ্ত ভতর্ুকি প্রদান করা হবে। এর ফলে কার্ডধারী প্রকৃত কৃষকের কাছে ভতর্ুকি সরাসরি প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব। ইতোপূর্বে বিদু্যত পরিচালিত সেচযন্ত্রের জন্য ভতর্ুকি প্রদানের প্রথা ছিল জটিল। কারণ, ৰুদ্র ও প্রানত্মিক চাষীরা সেচযন্ত্রের মালিকদের মাধ্যমেই বিঘাপ্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করে প্রয়োজন অনুযায়ী সেচকার্য পরিচালনা করত। আশির দশকের দ্বিতীয়ার্ধে একজন গবেষক এ প্রথাকে পানি-প্রভু (ডধঃবৎ খড়ৎফ) প্রথা হিসাবে চিহ্নিত করেন। বর্তমান প্রথার আওতায় দরিদ্র কৃষকরা এ প্রথা থেকে মুক্তি পাবে মর্মে আশা করা যায়।
কৃষি উপকরণ কার্ডধারী কৃষকদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলার বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। কারণ বিদ্যমান কৃষিঋণ বিতরণ ব্যবস্থায় যে কোন কৃষক ঋণ গ্রহণ করার সময় এ্যাকাউন্ট খোলার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের কত এ্যাকাউন্টধারী কৃষক রয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান সংশিস্নষ্ট ব্যাংক জানলেও এর মোট সংখ্যা সম্পর্কে জনগণ অবহিত নয়। এ নিয়ে জাতীয় সংসদেও কোন সময়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। আশির দশকের সময় ঋণ গ্রহণের জন্য কৃষিঋণ পাসবই প্রথার প্রচলন করা হয়েছিল। এ প্রথার বিষয়টি অনেকেরই জানা নেই। প্রথাটি বর্তমানে অচল কি সচল তাও কেউ জানে না। প্রশ্ন হলো, যাদের এ্যাকাউন্ট এ প্রথায় খোলা হয়েছিল, তারাও কি আবার নতুন করে খুলবে?
উপকরণ কার্ড প্রদান করা হবে ১ কোটি ৮২ লাখ কৃষককে। এ সংখ্যা গ্রাম পর্যায় থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাবৃন্দ। যদি এ পরিসংখ্যান সঠিক না হয় তাহলে বিতরণ ব্যবস্থায় কিছু জটিলতার সৃষ্টি হবে। কারণ বিদ্যমান সার বিতরণ ব্যবস্থায় ওয়ার্ড পর্যায়ের নির্ধারিত খুচরা সার বিক্রেতার মাধ্যমেই সার ক্রয় করতে হবে। এ ৰেত্রে কার্ডে নির্ধারিত পরিমাণ সারই কৃষক ক্রয় করতে সৰম। সম্ভবত এ পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি) কর্তৃক প্রণীত সার ব্যবহার সংক্রানত্ম নির্দেশিকার ওপর ভিত্তি করে।
অন্যদিকে প্রতিবছর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর প্রকাশিত ডায়েরিতে ফসলওয়ারী সার ব্যবহারের পরিসংখ্যান রয়েছে যা বিএআরসি প্রদত্ত পরিমাণ থেকে ভিন্নতর মর্মেও অভিযোগ রয়েছে। এ অভিযোগ যদি সঠিক হয় তাহলে প্রাপ্তি বিষয়ে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হবে। এর সাথে যোগ করা যায় আরেকটি বিষয়। সার বিতরণকারী কর্তৃপৰের তথ্য অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক সারের চাহিদার মধ্যে তারতম্য রয়েছে। যেমন ইউরিয়া সারের সর্বাধিক ব্যবহার হয় রাজশাহী বিভাগে মোট সারের শতকরা ৪০ ভাগ। একইভাবে টিএসপি ও এমওপি সারের ব্যবহার হয় শতকরা ৪২ ভাগ। ফরিদপুরসহ বরিশাল বিভাগে উলিস্নখিত তিন প্রকার সারের ব্যবহার যথাক্রমে ৮, ১০ ও ৯ ভাগ। এর পরে অবস্থান করছে খুলনা বিভাগ। এ বিভাগে ব্যবহারের হার যথাক্রমে ১৪ ও ১৬ ভাগ। সিলেট চট্টগ্রাম বিভাগে চাহিদার হার হলো যথাক্রমে ১৫, ১৬ ও ১৩ ভাগ। প্রদত্ত পরিসংখ্যান ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে।
বিতরণকৃত উপকরণ কার্ডের বিভাগওয়ারী বিভাজন পাওয়া গেলে স্পষ্ট করে বলা সম্ভব ছিল এ প্রথার প্রকৃত দুর্বলতা। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট তা হলো প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় জমির আয়তন অনুযায়ী নির্ধারিত সার এবং কৃষকভেদে প্রকৃত সার ব্যবহারের হার ভিন্নতর হবে। এ সত্যটি অভিজ্ঞতার আলোকেই বলা যায়। জটিলতা হবে ঐ ধরনের কৃষকদের যারা সার বিএআরসি কতর্ৃক নির্ধারিত হারের চেয়ে অধিক সার ব্যবহার করে। এ বিষয়টি স্পষ্ট নয়, এ ধরনের কৃষকরা নিজস্ব নির্ধারিত পরিমাণ সার ক্রয়ে বর্তমান প্রথায় সৰম হবে কিনা। সুষম সার ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষজ্ঞরা সভা সেমিনারে আলোচনা করলেও এটা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে নীতি নির্ধারকদের কোন আশঙ্কাও নেই। এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা ভাল হবে।
নির্ধারিত এক কোটি ৮২ লাখ কার্ডধারী কৃষকের পরিসংখ্যান কতটুকু সঠিক? কৃষি শুমারির সর্বশেষ পরিসংখ্যান এখনও পাওয়া যায়নি। জানা গেছে যে, শুমারির প্রতিবেদন বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন। এ বিষয়ে সর্বশেষ পরিসংখ্যান ১৯৯৬-৯৭ সালের। এতে আয়তনভেদে কৃষি হোল্ডিং-এর সংখ্যা হচ্ছে এক কোটি ১৭ লাখ ৯৭ হাজার। তবে কোন কৃষকের একাধিক হোল্ডিংও থাকা সম্ভব। এটাই হলো বাসত্মবতা। সর্বমোট কৃষি হোল্ডিং-এর মধ্যে কৃষিকাজে সম্পৃক্তদের সংখ্যা ছয় কোটি ৫৮ লাখ আট হাজার আটাত্তর। তবে এ পরিসংখ্যান কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের পরিসংখ্যান। অর্থাৎ এদের মধ্যে কেউ পরিবারের সদস্য অথবা বর্গাদার। সর্বশেষ শুমারির সংশিস্নষ্ট পরিসংখ্যান না পাওয়া পর্যনত্ম চুলচেরা বিশেস্নষণ করা সম্ভব নয়।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরামে বরিশাল বিভাগে দারিদ্র্যের হার সর্বাধিক মর্মে উলেস্নখ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে বলা হয়েছে, এ বিভাগেই সারের ব্যবহারের হার সর্বনিম্ন। সুতরাং অনুমান করা যায় যে, এ অঞ্চলে সারের ব্যবহারের হার উন্নীত করার লৰ্যে উদ্যোগ প্রয়োজন। সিডরের ধ্বংসলীলা-পরবর্তী সময়ে কৃষি পুনর্বাসনের লৰ্যে এ অঞ্চলে, বিশেষ করে বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলায় বৈদেশিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছিল। এ সাহায্যের কতটুকু কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান প্রয়োজন। সাহায্যের প্রতিশ্রম্নতি এখনও রয়েছে। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা, কৌশল নির্ধারণ ও বাসত্মবায়ন। যেহেতু এ অঞ্চলে সারসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণের ব্যবহার কম, সেহেতু এ অঞ্চলের অনেক কৃষক কার্ড পাওয়ার পরও সার ব্যবহার হয়ত করবেন না। কারণ এদের চাহিদাও কম। বিষয়টি উপেৰা করা সমীচীন হবে না। অবিলম্বে বরিশালসহ খুলনা ও সিলেট অঞ্চলে কত কার্ড বিতরণ করা হয়েছে সে বিষয়টি জানা প্রয়োজন। এসব অঞ্চলের সমসত্ম কৃষকই যদি কার্ড পায় তাহলে সারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লৰ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
কৌশলগত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কয়েকটি পদৰেপ গ্রহণ করা যায়। এক. মোট কৃষিজমির পরিমাণসহ মোট কৃষকের সংখ্যা নির্ধারণ। দুই. এদের সবাই কার্ড পেয়েছে কি-না তা জেনে নেয়া। তিন. বীজ বিতরণসহ সেচ সুবিধাদির সম্প্রসারণ। চার. প্রয়োজনীয় সার প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান। পাঁচ. কৃষিঋণ বিতরণ জোরদার করা। ছয়. উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণের সুবিধা প্রদান করা।
তবে উপযর্ুক্ত কৌশলসমূহ প্রতি অঞ্চলে ভিন্নতর হবে। কারণ অঞ্চলভিত্তিক কৃষি উৎপাদনের দৃশ্য, চাহিদা ও সমস্যা ভিন্নতর। যেমন, খুলনা অঞ্চলের জন্য এ লৰ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো জলাবদ্ধতা। আইলা-পরবর্তী সময়ে এ সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। এ বিষয়টি সবাই স্বীকার করেন। এ সমস্যা নিরসনে সরকারী উদ্যোগ যে একেবারেই গ্রহণ করা হয়নি তা নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও বিএডিসি'কেও এ বিষয়ে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের উদ্যোগের সুফল বা অগ্রগতির নিবিড় পরিবীৰণ প্রয়োজন। দেখতে হবে যে, প্রকল্পভিত্তিক লৰ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না।
মাঠ পর্যায় থেকে জানা যায়, সব জেলায় উপকরণ কার্ড বিতরণ এখনও চলমান। ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ সালের সার বিতরণের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুলাই-অক্টোবর সময়ে বিভিন্ন জাতীয় মোট সারের চাহিদা প্রায় শতকরা ৩০ ভাগ। নভেম্বর-মার্চ সময়ে এ চাহিদা দ্বিগুণ হয়। এর প্রধান কারণ বোরো মৌসুম। এখন ফেব্রম্নয়ারি মাসের ২০ তারিখ। সুতরাং অনুমান করা যায় যে, কার্ড বিতরণ মার্চের মধ্যে সমাপ্ত হলেও কার্ড অনুযায়ী প্রাপ্তি নাও হতে পারে। তবে আশঙ্কার কোন কারণ নেই। মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে কোন সমস্যার সংবাদ পাওয়া যায়নি।
কার্ড বিতরণের উদ্যোগকে বৃহত্তর আঙ্গিকে বিশেস্নষণ করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, এ প্রথাকে একটি উপায় হিসাবে চিহ্নিত করা। এ উপায়ের মাধ্যমে যদি অধিক ফসল ফলানোর লৰ্যমাত্রা অর্জন করা যায় তাহলেই হবে প্রকৃত সাফল্য। সব শেষে একটি সাবধান বাণী উচ্চারণ করা সঙ্গত হবে। ১৯৯৬-২০০১ সালে কৃষি মন্ত্রণালয় জমির উর্বরতা নিশ্চিত করার লৰ্যে জমি উর্বরতা কার্ড (ঝড়রষ ঐবধষঃয ঈধৎফ) বিতরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। এর সাফল্যের অগ্রগতি ও সুফল কতটুকু তা জানা প্রয়োজন। দুই ৰেত্রেই সাফল্যের মাত্রা নির্ভর করে সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের ওপর। আশা করি, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যত্নবান হবে। প্রয়োজন হবে নিবিড় পরিবীৰণের মাধ্যমে কার্ডের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা এবং পরবর্তী বছরগুলোতে যে সমসত্ম সম্ভাব্য সমস্যা চিহ্নিত হয় সেগুলো দূরীকরণের নিশ্চয়তা প্রদান। সমাজ ও অর্থনীতিশাস্ত্রে বলা হয়, উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোন পদ্ধতি সফল হয় না। এ জন্য আরও প্রয়োজন হবে এ পদ্ধতিকে কৃষকদের জন্য গ্রহণযোগ্য করা।
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.