হরতালের বিকল্প হরতাল না করা by বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

হরতালের বিকল্প হরতাল না করা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্রমাগত লিবারেল গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে এবং এই ব্যবস্থার মধ্যে পসেসিভ ব্যক্তিবাদ কাজ করে চলেছে। পসেসিভ ব্যক্তিবাদ রাজনীতির মধ্যে, অর্থনীতির মধ্যে, সংস্কৃতির মধ্যে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল : আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পসেসিভ ব্যক্তিবাদের অনুসারী। একদিকে মার্কেট সোসাইটিব কাঠামো, অন্যদিকে লিবারেল গণতান্ত্রিক তত্ত্বের দায়-দায়িত্ব, রাজনীতি নিয়ে অর্থনীতি নিয়ে সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিবাদ করার ক্ষেত্র হ্রাস করে এনেছে। একসার মার্কেট সম্পর্ক দুই দলের মধ্যে কাজ করে চলেছে। তার দরুন পসেসিভ ব্যক্তিবাদী সংস্কৃতি দু’দলকে আক্রান্ত করেছে। আক্রান্ত বেশি করেছে দু’দলের তরুণরা, ছাত্ররা। ধনদৌলতের দিকে ছুটেছে সবাই। সেজন্য তাদের মাধ্যমে লিবারেল গণতান্ত্রিক তত্ত্ব ও সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়।
ব্যক্তির পসেসিভ কোয়ালিটি ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পসেসিভ কোয়ালিটি শক্তিশালী হওয়ার দরুন প্রতিবাদের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রতিবাদ কি কারণে। প্রতিবাদ কিসের বিরুদ্ধে। এর জবাব রাজনীতি থেকে তৈরি হচ্ছে না। বিএনপির হরতালের ডাক ক্রমাগত বর্বর হয়ে উঠেছে। নেতারা সাধারণত রাস্তায় অনুপস্থিত। স্বল্পসংখ্যক তরুণ হঠাৎ হঠাৎ ঝটিকা মিছিল করে, ককটেল ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদ্দেশে, রাস্তায়, পাড়ায় আতঙ্ক তৈরি করে, পরে পালিয়ে যায়। এ ধরনের প্রতিবাদ অর্থহীন হয়ে ওঠে। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজের সচিত্র প্রতিবেদনে যা দেখা যায় ও পড়া যায় তার মধ্যে প্রতিবাদের নৈতিক সাহস খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিবাদ ও প্রতিবাদের ভাষা সর্বজনীন চেহারা নেয় না। তরুণ আইনজীবীদের ইট ছোড়ার মধ্যে কোন নৈতিকতা আছে কি। এর ফলে এই পেশার গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য নষ্ট হয়। পাড়ার তরুণ মাস্তান ও তরুণ আইনজীবীদের মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া যায় না। সমাজের বিভিন্ন তরুণ অংশ, বিভিন্ন তরুণ পেশাজীবী অংশ ভ্যান্ডাল : এই বোধটাই তৈরি হয়। হরতালের ঐতিহ্যের দিকে চোখ ফেরানো দরকার। ভারতবর্ষে, ব্রিটিশ কলোনিকালে, গান্ধীজী হরতালকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বজনীন প্রতিবাদের মাধ্যম করেছেন। নির্যাতিত জনসাধারণ, সমাজের তরুণ অংশ, পেশাজীবী অংশ ১৪৪ ধারা কিংবা কারফিউ ভেঙ্গেছেন। ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি করেননি, দোকানপাটে আগুন লাগাননি, গাড়িঘোড়া পোড়াননি। এভাবে হরতাল একটা নৈতিক সাহসের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল শাসনের বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়িয়েছে, তারা মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠ, এই বোধ সর্বত্র ছড়িয়েছে। হরতাল বর্বরতার নয়, হরতাল এই অর্থে প্রতিবাদ এবং প্রতিবাদের ভাষা : এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যখনই হরতাল সহিংস চরিত্র নিয়েছে, যেমন চৌরিচোরার ঘটনা, তখনই গান্ধীজী হরতাল ও অবরোধ টেনে ধরেছেন। নৈতিক প্রতিরোধ থেকে মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেননি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, মার্টিন লুথার কিং, প্রতিবাদের এই ভাষা, নৈতিক সাহসের এই ভাষা, মানুষদের পাঠ করতে শিখিয়েছেন। পাকিস্তানের কলোনিকালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হরতালের এই ঐতিহ্য আমাদের শিখিয়েছেন। হরতাল হচ্ছে প্রতিরোধ, হরতাল হচ্ছে প্রতিবাদ কলোনিয়াল শক্তির বিরুদ্ধে। মানুষ স্বাধীন হওয়ার জন্য হরতাল করেছে, হরতাল এভাবে কলোনিয়াল শক্তিকে প্রতিরোধ করেছে, কলোনিয়াল শক্তির বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, হরতাল কিছুতেই বর্বরতা নয়, হরতাল নৈতিক সাহস, শেষ পর্যন্ত নৈতিক সাহস। হরতাল সশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে নিরস্ত্র মানুষের নৈতিক সাহস, এই সাহসের সম্মুখীন হওয়ার ক্ষমতা ব্রিটিশ শক্তি হারিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হারিয়েছে, শ্বেতাঙ্গ শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হারিয়েছে। এভাবে প্রমাণিত হয়েছে বর্বরতা নৈতিক সাহসের বিকল্প নয়। মানুষকে বর্বর করে তোলা রাজনীতি নয়। রাজনীতি, চূড়ান্ত নৈতিক শক্তি ও সাহস।
বিএনপির ডাকা হরতাল নৈতিক সাহস থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তরুণদের হিংস্র করে তুলেছে, হরতাল থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, নৈতিক সাহস। হরতাল প্রতিরোধের বদলে হয়ে উঠেছে ভ্যান্ডালিজম। তার দরুণ হরতাল সার্বজনীন প্রতিরোধ হতে পারছে না। হরতাল হয়ে উঠেছে মাস্তানী। রাজনীতি কি মাস্তানী। না, কিছুতে না। রাজনীতি থেকে নৈতিক সাহস গুপ্ত হলে, হরতাল থেকে লুপ্ত হয় প্রতিরোধের ক্ষমতা, হরতাল থেকে স্পষ্ট হয় প্রতিবাদের ভাষা। বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে বলে, বিএনপি সমর্থক পুঁজিপতি ও ব্যবসায়ীরা হরতালের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া শুরু করেছেন। মফস্বলের ব্যবসায়ীরা, গ্রামাঞ্চলের ধনী কৃষকরা হরতাল থেকে সমর্থন সরিয়ে নিচ্ছেন। পরিবহন মালিকরা, পরিবহন শ্রমিকরা হরতালবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন। ছাত্ররা ও পরীক্ষার্থীরা বিএনপি থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন। বিএনপি, তাহলে, কাদের শক্তি নিয়ে হরতাল করবে? ভ্যান্ডালিজম বাদে তাদের হাতে কোন হাতিয়ার নেই। হরতাল একদিকে যেমন প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের মতাদর্শ অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিবর্তমান সমাজে ধনতন্ত্রের পরিবৃদ্ধির কারণে পুঁজি সঞ্চয়ের যৌক্তিকতার সঙ্গে হরতালের মতাদর্শ যুক্ত হয়েছে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যে যে কোন ধারণা হরতালের মতাদর্শের ক্ষেত্রে ক্ষয় ধরিয়েছে। ধনতন্ত্রের প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হরতালের ব্যবহার মেনে নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের পুঁজিপতিরা (বিএনপিপন্থী কিংবা আওয়ামী লীগপন্থী) হরতালের প্রয়োগ ও ব্যবহারে শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। অপর পক্ষে দেশব্যাপী হরতালের ব্যবহার বাস্তবসম্মত হচ্ছে না। খবরের কাগজের ভাষায় হরতাল হয়ে উঠেছে ঢিলেঢালা, কিছুসংখ্যক তরুণের ইট ছোড়াছুড়ি ও বোমা ফাটানোর বিষয় ও গাড়ি পোড়ানোর আহ্লাদী কা-কারখানা। এর মধ্যে মতাদর্শ নেই, প্রতিবাদ নেই, প্রতিরোধ নেই। তার দরুণ বিএনপির মতাদর্শবিহীন হরতাল বিএনপি সমর্থক শ্রেণীর মধ্যে কোন অভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারছে না। কলোনিয়াল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : হরতালের মধ্য দিয়ে মতাদর্শের যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তার কোন লক্ষণ বিএনপির হরতালে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ধনতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ থেকে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ উধাও হয়ে যাচ্ছে। হরতাল রাষ্ট্র কিংবা সরকারের প্রতিরোধ থেকে সরে এসেছে, পর্যবসিত হয়েছে জ্যানিসিং মেডিয়েটরে, মতাদর্শহীন মাস্তানীতে। শ্রেণীশক্তি লুপ্ত হচ্ছে, রাজনীতি থেকে মতাদর্শ দূরে সরে যাচ্ছে, কোন কোন নেতার ইগোট্রিপে পরিণত হচ্ছে। হায়রে প্রতিবাদ, হায়রে প্রতিরোধ, হায়রে মতাদর্শ। বাংলাদেশ একটা পসেসিভ মার্কেট সোসাইটিতে পর্যবসিত হয়েছে।’ সেখানে লিবারেল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভাববার মতো। একটা পসেসিং ক্লাস ভোটের অধিকারের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা রক্ষা করার চেষ্টা করছে। এটা হয়ত লিবারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু এটা কি লিবারেল গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার নৈতিক জাস্টিফিকেশন হবে? গভার্নিং ক্লাস, সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষ, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অনিশ্চিত সংহতি কতদূর পর্যন্ত মেনে চলবে? এই সমস্যার কোনো স্পষ্ট জবাব না থাকার দরুন, হরতালের মাধ্যমে বিরোধিতাকে মতাদর্শহীন মাস্তানিতে পর্যবসিত করা হয়েছে। এই বিরোধিতা লিবারেল গণতান্ত্রিক তত্ত্বকে শিথিল করে তুলেছে, লিবারেল গণতান্ত্রিক তত্ত্ব মার্কেট সম্পর্কে মধ্যে জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না, তার দরুন পসেসিভ ব্যক্তিবাদ মতাদর্শহীন মাস্তানিতে বদলে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে ভ্যান্ডালিজম। ভ্যান্ডালিজম এবং হরতালের মধ্যে তফাত যুগান্তরের কথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

No comments

Powered by Blogger.