মিস পানি্ন, সুমী, হামীম ...এভাবে আর কত জীবন হারিয়ে যাবে পথে! by নিয়ামত হোসেন

কতকগুলো প্রশ্নের উত্তর এখানে কখনও পাওয়া যায় না। এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপৰ আছে কি না কে বলবে! তবে তেমন কর্তৃপৰ না থাকার কথা নয়।
কিন্তু কোন দিক থেকেই প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না। সেজন্য সাধারণভাবে মানুষের ধারণা হয় বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই। এর সঙ্গে সংশিস্নষ্ট প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবারও সম্ভবত কেউ নেই। তবে প্রশ্নের উত্তর নয়, এসব ব্যাপারে যেসব ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় সেগুলোতেও আসলে খুব কাজ হয় তাও দেখা যায় না। তাই প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। প্রশ্নগুলোর মূল কথাটা হলো, আমাদের সড়কগুলোর অরাজক অবস্থার কি অবসান নেই? এটা কি চলতেই থাকবে? কিছু লোকের কারণে এই সড়কগুলো চরম নিরাপত্তাহীন হয়েই থাকবে? অকালে ঝরে যাবে একের পর এক মানুষের জীবন?
কী রাজধানী, কী রাজধানীর বাইরে সবখানেই সড়কপথে চরমভাবে নিরাপত্তার অভাব! রাজধানীর রাসত্মাতেও মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, বাইরের রাসত্মাতেও হারাচ্ছে! সেদিন রাজধানীর বাইরের সড়কে প্রাণ হারাতে হলো এক বিদেশীনীকে। থাই রাজকুমারীর সফরসঙ্গী হিসাবে গাইবান্ধা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার পথে একটি মালবাহী যান তাঁর গাড়িকে ধাক্কা দিয়ে পথ থেকে ছিটকে ফেলে দেয়। তারপরের বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। টিভির খবরে বলা হয়েছে, সড়কের নিরাপত্তা নাই সেটা যেমন একটা ব্যর্থতার কথা তেমনি তার চেয়েও দুঃখ এবং লজ্জার কথা হচ্ছে যে মহিলা সেদিন প্রাণ হারালেন তিনি একজন বিদেশী কূটনীতিক। ঢাকার থাই দূতাবাসে কাজ করতেন। এসব খবর বিদেশীদের কাছে যখন যাবে তখন সবাই কি বিষয়টিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করবে? আমাদের দেশে রাসত্মার করম্নণ নিরাপত্তাহীন অবস্থার কথা কি তাদের মনে হবে না? যদি এমন ধারণা কারও মনেও হয় তা হলে তাঁর কি বাংলাদেশে এসে পর্যটক হিসাবে দু'দিন বেড়িয়ে যাওয়ার শখ হবে?
দুর্ঘটনা কোন্্ দেশে না হয়? কিন্তু আমাদের দেশের মতো প্রায় প্রতিদিনই এভাবে মানুষের জীবন ঝরে পড়ে কয়টা দেশে? শিশু স্কুল থেকে বেরিয়ে বাড়িতে যাবে_ কিন্তু যেতে পারল না, বাসের চাকায় পিষে লাশ হয়ে গেল! এই সেদিনের ঘটনা! ঘটেছে ঢাকার রাজপথে। এই মর্মানত্মিক ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে আরও কয়েকজন শিশু প্রাণ হারিয়েছে। রাসত্মায় একের পর এক এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। আর সেদিন থাই দূতাবাসের কাউন্সিলরকেও প্রাণ দিতে হলো রাসত্মায় বেপরোয়া গতিতে আসা অপর একটি যানের ধাক্কার কারণে। বৃহস্পতিবার থাই দূতাবাসের মিনিস্টার কাউন্সিলর মিস পানি্ন লিকানাজুলের মর্মানত্মিক মৃতু্য মানুষকে একদিকে প্রচ-ভাবে ব্যথিত করেছে এবং একই সঙ্গে আমাদের সড়কগুলোর নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে বিশেষ করে ভাবিয়ে তুলেছে। এই দুঃখজনক মৃতু্যর মাত্র কয়েকদিন আগে মানুষ শুনেছে পূর্বে উলেস্নখিত স্কুলছাত্রকে বাসের চাপা দেয়ার খবরটি। এই মর্মানত্মিক ঘটনাটি ঘটে কাকরাইলের লিটল ফাওয়ার স্কুলের কাছে। হামীম নামের ঐ শিশু মায়ের হাত ধরে রাসত্মা পার হচ্ছিল। কিন্তু সেখানেই অকালে নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ। এই ঘটনার একদিন পরেই বিমানবন্দর সড়কে সবার সঙ্গে রাসত্মা পার হচ্ছিল শিশু সুমী আক্তার। এই শিশুটিও পিষ্ট হয়ে যায় দানব যানের চাকায়। বৃহস্পতিবার আরেক ঘটনা ঘটে তেজগাঁওয়ে। একটি যাত্রীবাহী বাস সোজা গিয়ে ধাক্কা মারে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়ালে। এই ঘটনায় আহত হন জনাতিনেক। কাকরাইলে প্রাইভেট কারের নিচে চাপা পড়ে প্রাণ হারান এক আইনজীবী। ঐ দিনই যাত্রাবাড়িতে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা যান এক পথচারী।
বাসের চাকায় মানুষ এবাবে পিষ্ট হবে কেন? বাস এমন বেপরোয়াভাবে চালানো হবে কেন? পাগলের মতো বাস বা অন্যান্য যান চালানো হবে কেন? যুক্তি হতে পারে রাসত্মায় গাড়ি চলবে। মানুষ চলবে ফুটপাথে। সে মানুষ রাসত্মায় এলে বাস ধাক্কা দিতেই পারে_ এটা যতই সঙ্গত যুক্তি হোক, ঢাকা শহরের রাসত্মার অবস্থা দেখলে এ যুক্তি মেনে নেয়া যায় না। রাসত্মায় অবশ্যই বাস এবং অন্যান্য গাড়ি চলবে। মানুষ কেন যাবে রাসত্মায়? যুক্তি হিসাবে এটা মানা উচিত হলেও এ কথা কি ওঠে না যে শহরের বহু রাসত্মায় ফুটপাথ নাই, যে শহরে পর্যাপ্ত সংখ্যক ওভারব্রিজ, আন্ডার পাস নাই, যে শহরে ধারণৰমতার চাইতে বহু বহু গুণ লোক বাস করে এবং যে শহরে রাসত্মার পাশেই অনেক স্কুল কলেজ, সে শহরে মানুষ কি ইচ্ছা করে রাসত্মায় যায়? যায় বাধ্য হয়ে। ট্রেন চলে রেল লাইনে। কিন্তু যদি ট্রেনের ড্রাইভার দেখেন দূরে কোন লোক লাইন দিয়ে হাঁটছে বা লাইনে বসে আছে, সেখানেও দূর থেকে হুইসেল বাজানো হয়, প্রয়োজনে ট্রেনের গতি শস্নথ করা হয়, এমনকি ট্রেন থামিয়েও দেয়া হয়। সেখানে রাসত্মায় যদি কোন ড্রাইভার দেখে যে একজন মানুষ বা শিশু রাসত্মা পার হচ্ছে, সে যদি বেআইনীভাবেও পথে সে সময় থাকে বা পার হয় তখন তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য বাস থামানো হবে না? বাসের এত কি তাড়া? তাদের সময়ের এত অভাব কেন? মানুষের জীবন আগে না সময় আগে? কোন্্টার দাম বেশি? প্রায় শোনা যায় দ্রম্নতগামী বাসের চাকায় কিংবা বেপরোয়া বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে লোকে প্রাণ হারাচ্ছে। আমাদের বাস কিংবা মোটরগাড়ি কিংবা ট্রাকগুলো কি জাপানী বুলেট ট্রেনের মতো দ্রম্নতগামী? জানি না, চালকদের কি শিৰা দেয়া হয়, উত্তমরূপে গাড়ি চালাও, সমসত্ম বিধি মেনে চল, লেনের বাইরে যাবে না ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সব নিয়ম শেখানো হয় নিশ্চয়ই। কিন্তু যত কিছুই হোক রাসত্মায় কোন মানুষকে ধাক্কা দেবে না, কাউকে চাপা দেবে না, শিশু বৃদ্ধ নারী দেখলেও তাদের গায়ে গাড়ি তুলে দেবে না, তাতে যদি তারা অন্যায়ভাবেও চলার পথে এসে পড়ে তবুও এক কথায় যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চ সতর্কতায় গাড়ি চালাতে হবে, মানুষের নিরাপত্তা সবার আগে খেয়াল রাখতে হবে_ এমন শিৰা চালকেরা পান না তা অবশ্য নয়, তবে কতখানি গুরম্নত্ব মানুষের নিরাপত্তার ব্যাপারে দেয়া উচিত ততখানি দেয়া হয় কিনা। অনত্মত বাস এবং ট্রাক চালকদের দেয়া হয় কিনা জানি না। যদি কোন বৃদ্ধ, মহিলা, শিশু বা যে কোন মানুষ ভুলে বা অন্যায়ভাবে গাড়ির রাসত্মায় এসে পড়ে তার জীবন বাঁচিয়ে, তাকে আহত না করে, পরে তার আইন অনুযায়ী শাসত্মির ব্যবস্থা করা হোক, কিন্তু চাকায় পিষ্ট করতে হবে কেন? ঢাকা নগরীর ভেতরে বাইরে চারদিকে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কিন্ডারগার্ডেন। এখানে গিজ গিজ করছে মানুষ। গ্রাম থেকে হরদম মানুষ আসছে কাজকর্ম ছাড়াও নানা প্রয়োজনে আসছে। তার মধ্যে অগণিত গাড়ি, অল্প রাসত্মা। যানজট। এখানে পথে গাড়ি চালানো হবে বেপরোয়া গাতিতে, এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এটা ইউরোপ-আমেরিকার কোন শহর নয়, এটা একটা দরিদ্র দেশের দরিদ্র এবং অগোছালো শহর। এখানে প্রায় প্রতিনিয়ত রাসত্মায় গাড়ি চাপা পড়ে মানুষকে মরতে হবে কেন? মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে এখানে নিশ্চিত রাখার ব্যবস্থা হোক।
শহরের বাইরে তো বটেই, শহরের ভেতরেই কোন কোন যান চলে দানবের গতিতে। কেন তাদের এত গতি? কেন তারা বেপরোয়া? রাসত্মায় স্কুলছাত্রকে চাপা দিচ্ছে, বয়স্ক মানুষকে চাপা দিচ্ছে, বিদেশী কূটনীতিকের গাড়ি এমনভাবে ধাক্কা মারল যে তাঁর সে গাড়ি রাসত্মা থেকে ছিটকে পড়ে গেল দূরে, তারপর তেমনই দানবযন্ত্র রাসত্মা ফেলে ধাক্কা মারল তেজগাঁওতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়ালে! এসব তো তা-ব চালানোর মতো ঘটনা! পথের এসব তা-ব বন্ধ করতে হবে। কেউ বলেন অনেকের লাইসেন্স ভুয়া, কেউ কেউ নাকি নেশায় আসক্ত। কিন্তু লাইসেন্স ভুয়া, সে যোগাড় করল কেমন করে, ওটা এৰুণি কেড়ে নেয়া হোক। কারও বিরম্নদ্ধে নেশার অভিযোগ থাকলে সে বিষয়েও নিয়মিত তদনত্ম চালাতে হবে। রাসত্মাকে নিরাপদ করতে হবে। যানবাহনের গতি কমাতে হবে, হর্ন বন্ধ করতে হবে, ট্রাফিক আইন যাতে প্রত্যেকে মেনে চলে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। আর যাতে মিস পানি্নর মতো বিদেশী কূটনীতিক, হামীম, সুমী আক্তারের মতো শিশুকে, কোন মানুষকে পথে প্রাণ দিতে না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখনই নিশ্চিত করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.