একটি স্মারক বক্তৃতা স্মৃতি তর্পণ, না কিছু আপ্তবাক্য? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

ঢাকায় একটি স্মারক বক্তৃতা শোনার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। যার উপর স্মারক বক্তৃতা তিনি বাংলাদেশে প্রগতিশীল গণ সাংবাদিকতার একজন অগ্রদূত জহুর মোর শহাসেন চৌধুরী এবং যিনি স্মারক বক্তৃতাটি দিয়েছেন তিনি উপমহাদেশ খ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার।
তিনি দিল্লী থেকে ঢাকায় এসেছেন এই স্মারক বক্তৃতাটি দেয়ার জন্য। জহুর হোসেন চৌধুরীকে খুব কাছ থেকে চিনতাম এবং জানতাম। তিনি ছিলেন আ্রদ্ধাভাজন সাংবাদিক এবং সম্পাদক। ভারতের বষর্ীয়ান সাংবাদিক ফুলদীপ নায়ারের সঙ্গেও আমার দু'এক দফা দেখা সাাত হয়েছে। তাতে পরিচয়টা স্থায়ী হয়নি। তাঁর কলামের আমি নিয়মিত পাঠক এমন কথা বলব না। কিন্তু বহু লেখা পড়েছি এবং এখনও পড়ি।
ঢাকায় ২৬ জানুয়ারি মঙ্গলবার হোটেল সোনারগাঁওয়ের গ্রান্ড বলরুমে এই স্মারক বক্তৃতায় (জহুর হোসেন চৌধুরী মেমোরিয়াল লেকচার ২০১০) আয়োজন করেছিলেন দৈনিক ভোরের কাগজের কতর্ৃপ। স্বয়ং রাষ্ট্রপ্রধান জিল্লুর রহমান এই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়েছিলেন। এত সাড়ম্বরে ঢাকায় সাম্প্রতিককালে আর কারও উপর স্মারক বক্তৃতাদানের আয়োজন হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। একেবারে প্রথম শ্রেণীর হোটেলে রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে এই স্মারক বক্তৃতা। এদিক থেকে জহুর হোসেন চৌধুরী সৌভাগ্যবান ব্যক্তি বলতে হবে। সাংবাদিক জীবনে যিনি প্রশংসিত হওয়ার পাশাপাশি বিতর্কিত ও নিন্দিত হয়েছেন। মৃতু্যর দীর্ঘকাল পর তাঁকে নিয়ে এই সাড়ম্বর স্মরণসভা, স্মারক বক্তৃতা অবশ্যই বাংলাদেশে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
এই স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রটি হাতে পেয়ে একটু বিস্মিত হয়েছিলাম। জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁর সাংবাদিক জীবনের বেশিরভাগ সময় সংবাদ সম্পাদক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। দৈনিক সংবাদের সম্পাদক হিসেবেই তিনি সক্রিয় সাংবাদিকতা থেকে অবসর নিয়েছিলেন। ভেবেছিলাম, এই স্মারক বক্তৃতার আয়োজনও করেছে সংবাদ কতর্ৃপ। আমন্ত্রণপত্র খুলে ভুল ভাঙল। সভার আয়োজক ভোরের কাগজ কতর্ৃপ। তখন জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে ভোরের কাগজের অন্যতম মালিক ও প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরীর যে আত্মীয়তা ও পারিবারিক সম্পর্ক সে কথা মনে পড়ল।
এই স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে যথাসময়ে উপস্থিত হওয়ার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল এবং উপস্থিত হওয়ার প্রস্তুতিও নিয়েছিলাম। কিন্তু অদৃষ্ট বাদ সাধল। এমনিতেই কদিন যাবত অসুস্থ ছিলাম। হঠাৎ অসুস্থতা বেড়ে গেল। একেবারে শয্যাশায়ী না হলে এ সভায় উপস্থিত থাকতাম। জহুর হোসেন চৌধুরীর প্রতি আমার শ্রদ্ধা এবং তাঁর সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের একজন খ্যাতনামা ভারতীয় সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার কী বলেন তা জানার আগ্রহের কারণেই এই সভায় যেতে প্রস্তুত হয়েছিলাম। যেতে না পেরে হতাশও বোধ করেছি।
আমার সেই হতাশা কিছুটা দূর হয়েছে স্মারক বক্তৃতার একটি মুদ্রিত কপি হাতে পাওয়ার ফলে। এই বক্তৃতার শিরোনাম 'উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মিডিয়ার ভূমিকা।' ইংরেজীতে দেয়া বক্তৃতা। খুবই আগ্রহের সঙ্গে পড়লাম। স্বল্প পরিসর এই বক্তৃতায় জহুর হোসেন চৌধুরী এবং তাঁর বিখ্যাত কলাম দরবার-ই-জহুরের উল্লেখ মাত্র দুটি প্যারার কয়েক লাইনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উদীয়মান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তাঁর কলোনিয়াল যুগ থেকেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভাবনা নির্মাণ ও বাস্তবায়নে জহুর হোসেন চৌধুরীর কি ভূমিকা ও অবদান ছিল গোটা ভাষণের বক্তব্যের সঙ্গে তার কোন যোগ ও সম্পর্ক দেখানো হয়নি। এই ভাষণে জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা এই কথাটি মুছে দিয়ে কেবল উদীয়মান গণতন্ত্রে মিডিয়ার ভূমিকা রাখা হলে অসঙ্গত হতো না, বরং সঙ্গত হতো।
এ জন্যে কুলদীপ নায়ারকে দোষ দেই না। জহুর হোসেন চৌধুরীর নাম বা লেখার সঙ্গে তাঁর সাাত পরিচয় ছিল আমার তা মনে হয় না। হয়ত আকস্মিক দেখা সাাত হয়েছে। আর জহুর চৌধুরীর লেখা পড়ার সুযোগ তো নায়ারের কখনই ছিল না। তাঁর অধিকাংশ কলামই বাংলায় লেখা। কুলদীপ নায়ার বাংলা জানেন না। তাঁর জীবনে বাংলাদেশের কোন খ্যাতনামা বাঙালী কলামিস্টের লেখা ইংরেজীতে তরজমা করে পড়ার আগ্রহ বা প্রয়োজন তিনি নিশ্চয়ই কখনও বোধ করেননি।
এই অবস্থায় জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা কুলদীপ নায়ারকে দিয়ে দেয়াতে হলে শুধু তাঁর জীবন বৃত্তান্ত নয়, তাঁর উল্লেখযোগ্য লেখাগুলো ইংরেজীতে তরজমা করে নায়ারকে দেয়া উচিত ছিল। যদি দেয়া হয়ে থাকে, তার কোন পরিচয় স্মারক বক্তৃতায় একেবারেই ফুটে ওঠেনি। এই বক্তৃতাটি বাংলাদেশসহ উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি সাধারণ সভায় মূল বক্তার বক্তৃতা হতে পারে কারও নামাঙ্কিত স্মারক বক্তৃতা নয়। এটা তো রামবিহীন রামায়ণ রচনার মতো।
বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতায় দেয়া একটি অত্যাশ্চর্য স্মারক বক্তৃতার কথা আমার মনে পড়ছে। সেটি ছিল নেতাজী সুভাষ বসু স্মারক বক্তৃতা। দিয়েছিলেন ব্রিটেনের বিখ্যাত বামপন্থী নেতা টনি বেন নামে পরিচিত লর্ড ওয়েজউড বেন। তাঁকে এই বক্তৃতা দানের জন্য অনুরোধ জানাতেই তিনি বলেছিলেন, সুভাষ বসুর কর্মকাণ্ড আমার ভালভাবে জানা আছে। তবু তাঁর চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার ভালভাবে জানাশোনার জন্য তাঁর বিবৃতি, ভাষণ, রচনা ইত্যাদি আমার পড়া দরকার। না পড়ে যদি তাঁর উপর স্মারক বক্তৃতা দেই তা হবে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর বক্তৃতা। সেই সংগ্রামে সুভাষ বসুর কি ভূমিকা ও অবদান তা থাকবে না। তাহলে এই বক্তৃতার অর্থ হবে কি ? কেবল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কেই বক্তৃতাটি হবে। তাতে প্রসঙ্গক্রমে সুভাষ বসুর নামের উল্লেখ থাকবে শুধু।
টনি বেনের কথা শুনে কলকাতার সুভাষ বোস মেমোরিয়াল লেকচারের উদ্যোক্তারা তাকে ইংরেজীতে লেখা সুভাষের বক্তৃতা বিবৃতি, গান্ধী, নেহেরু, জিন্না প্রমুখ নেতার সঙ্গে পত্র বিনিময় সঙ্কলিত বিরাট গ্রন্থটি পাঠিয়ে দেন। এরপর লন্ডন থেকে কলকাতায় গিয়ে টনি বেন সুভাষ বসুর উপর যে স্মারক বক্তৃতা দেন তা এক ঐতিহাসিক বক্তৃতার মর্যাদা লাভ করেছিল। একই কথা বলা চলে, লন্ডনে আয়োজিত' নাসের স্মারক বক্তৃতা প্রসঙ্গে। বক্তৃতা দিয়েছিলেন কায়রোর আল আহরাম দৈনিকের সম্পাদক মোহাম্মদ হাইকেল। ব্রিটিশ পত্রপত্রিকাগুলো সাধারণভাবে নাসের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও হাইকেলের এই বক্তৃতা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছিল।
এই বক্তৃতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, এই স্মারক বক্তৃতা মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক যুগের রাজনীতির তাৎপর্য তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনীতির প্রধান পুরুষদের অন্যতম প্রেসিডেন্ট নাসেরের ভূমিকাকেও তুলে ধরেছে। তাঁকে ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের নব্যধারার রাজনীতির ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থাকত। ঢাকায় দেয়া কুলদীপ নায়ারের জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় বাংলাদেশের মতো উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের সঠিক ভূমিকা গঠনে জহুর হোসেন চৌধুরীর অবদান ও অবস্থান কোথায় সেই কথাটিই অনুপস্থিত রয়ে গেছে। ফলে উদীয়মান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে কুলদীপ নায়ারের বক্তৃতাটি আমার কাছে মনে হয়েছে কিছু ভাল ভাল রেটোরিক বা আপ্তবাক্যের সমাহার। তার বেশি কিছু নয়।
অনেক ব্রিটিশ নেতা ও বুদ্ধিজীবী সুভাষ বসু স্মারক বক্তৃতা দিতে রাজি থাকলেও এই বক্তৃতা দেয়ার জন্য টনি বেনকে যে বেছে নেয়া হয়েছিল তার কারণ, টনি বেন চরিত্রে সাম্রাজ্যবাদের ঘোর বিরোধী। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন জুগিয়েছেন এবং সুভাষ বসুর রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার সমর্থক। একজন ব্রিটিশ রাজনীতিক হিসেবে তিনিই সুভাষ বসুর উপর বক্তৃতা দেয়ার সবচাইতে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের সংগ্রামী সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরীর উপর স্মারক বক্তৃতা দেয়ার জন্য কুলদীপ নায়ার যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হলেন কি কারণে এবং কিজন্য তাঁকে এই বক্তৃতা দেয়ার জন্য সুদূর দিল্লী থেকে টেনে আনা হলো ? জহুর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে পরিচিত, তাঁর চিন্তা চেতনা সম্পর্কে অবহিত আর কোন খ্যাতনামা সাংবাদিক অথবা বুদ্ধিজীবী কি এখনও দিল্লী, কলকাতা অথবা ঢাকায় নেই, যাঁদের এই বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো যেত?
প্রথম যৌবনে জহুর হোসেন চৌধুরী ছিলেন এমএন রায়ের রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হিউম্যানিস্ট বা মানবতাবাদী। পরে তাঁর এই মানবতাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাম্যবাদ। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন, সেই সঙ্গে বিরোধী ছিলেন এই দুই অপশক্তির পৃষ্ঠপোষক সাম্রাজ্যবাদ ও ধনবাদেরও। সাংবাদিকতায় তাঁর ভূমিকা ছিল গণঅধিকার ও গণতন্ত্র রায় আপসহীন সংগ্রামীর। তিনি বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে কুলদীপ নায়ার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ও সাংবাদিকতার েেত্র চরম ডানপন্থী। জহুর চৌধুরী ছিলেন সোস্যাল ডেমোক্রেসির অনুসারী। কুলদীপ নায়ার অনুসারী পশ্চিমা ধনবাদী ডেমোক্রেসির। তিনি মুখে সাম্প্রদায়িকতা ও সামরিক শাসনের নিন্দা করেন। কিন্তু এই দুই অপশক্তির আসল পৃষ্ঠপোষক যে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ তার বিরোধিতা করেন না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়ের পরেও তাঁর সাংবাদিক ভূমিকা ছিল বিতর্কমূলক।
সন্দেহ নেই কুলদীপ নায়ার একজন শক্তিশালী সাংবাদিক এবং কলামিস্ট। তাঁর কলমের শক্তির কথা বিশ্ববিদিত। কিন্তু যাঁরা তাঁর বই এ টেল অব দা সাবকন্টিনেন্ট : ইন্ডিয়া আফটার নেহেরু, ইন্ডিয়া পাকিস্তান রিলেশনশিপ ইত্যাদি পড়েছেন, তাঁরা জানেন ভারতে যে ক'জন প্রগতিবিমুখ পণ্ডিত ও সাংবাদিক আছেন তিনি তাঁদের মধ্যে শীর্ষ স্থানীয়। নেহেরুর নিরপে বিদেশনীতি, ইন্দিরার গরিবী হঠাও নীতি বা কংগ্রেসের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি কোনটাই তাঁর পছন্দসই ছিল না। এখনও নয়। জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতায় তিনি উদীয়মান গণতন্ত্রের শত্রু হিসেবে মৌলবাদ ও সামরিক শাসনকে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু তাঁর কলম চিরকাল পপাত দেখিয়েছে এই দুই শত্রুর পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি।
এরশাদের আমন্ত্রণে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাঁর সামরিক শাসনের সমালোচনা করার চাইতে গুণগান করেছেন বেশি। পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হকও একসময় তাঁর সমর্থন বঞ্চিত হয়নি। আর ভারতে সেকুলার কংগ্রেসী শাসনের অবসানের পর সাম্প্রদায়িক দলগুলোর মদদে যখন দিল্লীতে অকংগ্রেসী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তখন তিনি তাদের সমর্থন দিয়েছেন এবং বিনিময়ে লন্ডনে ভারতের হাইকমিশনার পদে চাকরি পেয়েছেন। আবার কংগ্রেস সমর্থিত সরকার মতায় ফিরে আসতেই তিনি চাকরি থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন।
৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় কুলদীপ নায়ারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের অধিকাংশ বিগ মিডিয়া ছিল এই যুদ্ধে ইন্দিরা সরকারের সমর্থন দানের বিরোধী। হিন্দুস্থান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রভৃতি বড় বড় ভারতীয় পত্রিকা এবং বিগ বিজনেস ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে ইন্দিরা সরকারের নীতির বিরোধী। এ সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের হস্তপে সম্পর্কে ইন্দিরা সরকারকে কঠোর ভাষায় সতর্ক করে যে সব শীর্ষ স্থানীয় কলামিস্ট কলাম লিখতেন, তাদের মধ্যে কুলদীপ নায়ারও একজন। অবশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফলতার পথে এগুতেই এরাও ভোল পাল্টান।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কুলদীপ নায়ার ঢাকায় এসে হাজির হন। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশটির আসল অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে তেমন আগ্রহ না দেখিয়ে তিনি তখনকার হোটেল কন্টিনেন্টালে আসর জমিয়ে তাঁর বঙ্গদর্শন শুরু করেন এবং ইংরেজী বিতর্কিত সাপ্তাহিক 'হলিডের' প্রয়াত সম্পাদক এনায়েতুল্লা খান মিন্টু হয়ে দাঁড়ান তাঁর বঙ্গদর্শনের চশমা। দিল্লীতে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর কলামে মুজিব সরকারের ব্যর্থতা, অযোগ্যতা ইত্যাদিকে বড় করে দেখাতে শুরু করেন এবং তাঁর এই সময়ের বাংলাদেশ সম্পর্কিত প্রতিটি লেখাতেই থাকত 'হলিডে'তে প্রকাশিত এনায়েতুল্লা খানের মুজিব-সরকার বিরোধী লেখার উদ্ধৃতি, 'হলিডের' প্রচারণাকেই কুলদীপ নায়ার তাঁর লেখায় স্থান দিতেন প্রমাণিত সত্য হিসেবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সিমলা চুক্তি হয়। এই সময়ে ভারতের বিগ মিডিয়া এবং দিল্লীর আমলাতন্ত্রের একটা অংশ এমন একটা ভাব দেখাতে শুরু করে যে, বাংলাদেশ তো তারা জয় করেই ফেলেছেন, এখন পাকিস্তান বিজয়ের পালা। শেখ মুজিবকে তেমন কদর না দেখালেই চলে। এখন ভুট্টোর মন গলিয়ে তাঁকে দিল্লীর প্রভাব বলয়ে আনলেই কাজ ফতে। ফলে দিল্লীতে শুরু হয় প্রবল ভুট্টো প্রশস্তি। সেই প্রশস্তির বন্যায় সদ্য স্বাধীন বাংলা, তার নেতা বঙ্গবন্ধুর কথা একেবারে যমুনায় ডুবে যায়। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আমি দিল্লীতে গিয়ে দেখি বইয়ের বাজার ভুট্টো আর ভুট্টো প্রশংসায় সয়লাব। অসংখ্য বই বেরিয়েছে ভুট্টোকে প্রশংসা করে। তার দারুণ কাটতি। সবচাইতে বেশি বিক্রি হচ্ছে পিলু মোদীর 'মাই ফ্রেন্ড জুলফি' বইটি। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ সম্পর্কে দিল্লীতে কোন উৎসাহ ও উত্তেজনা নেই।
এ সময় কুলদীপ নায়ারের কলামগুলো পড়েছি। তখন একদিকে তাঁর লেখায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুকে উপো এবং ভুট্টো প্রশস্তি ও পাকিস্তানের সঙ্গে যে কোন মূল্যে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য হাপিত্যেস দেখে বিস্মিত হয়েছি। বাংলাদেশে যুদ্ধবন্দীদের বিচার এবং পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধের তিপূরণ দাবি করার ব্যাপারে ভারত যাতে আর বাংলাদেশকে সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকেই গুরুত্ব দেয় সেজন্যে কুলদীপ নায়ারের মতো ভারতের প্রখ্যাত অনেক কলামিস্টও ইন্দিরা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। তা নিয়ে দিল্লীতে সাংবাদিকদের এক চা চক্রে কুলদীপ নায়ারের সঙ্গে আমার তীব্র বাদানুবাদ হয়।
এর দীর্ঘকাল পর দিল্লীতে যখন আধা গণতান্ত্রিক আধা সাম্প্রদায়িক সরকার মতায় এবং লন্ডনে কুলদীপ নায়ার তাদের প্রতিনিধি, তখন ভারতীয় বিদ্যাভবনের এক অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার আবার দেখা। আমাকে তখন তাঁর আর স্মরণ নেই। স্মরণে রাখার কোন কারণও ছিল না। বাংলাদেশের একজন সাংবাদিক হিসেবে যখন আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করানো হলো, তখন বলেছি, দিল্লীতে বহুকাল আগে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে আপনার মতামত তখন আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কুলদীপ নায়ার আমার কথার জবাব দেননি। জবাব দেয়ার সময় ও সুযোগ তার ছিল না।
অধুনা বাংলাদেশের সংবাদপত্রে কুলদীপ নায়ারের অনুপ্রবেশ ল্য করছি। 'হলিডের' প্রয়াত এনায়েতুল্লা খান তাঁর পরম বন্ধু ও সাংবাদিক সখা ছিলেন। ঢাকার ডেইলি স্টারের মাহফুজ আনামেরও বন্ধু ছিলেন এনায়েতুল্লা। সম্ভবত সেই বন্ধুত্বের সম্প্রসারণ ঘটেছে স্টারের মাহফুজ আনাম ও প্রথম আলোর মতিউর রহমান পর্যন্ত। আমার ধারণা, সাংবাদিকতার েেত্র এরা একডালের পাখি। তাই কুলদীপ নায়ারের অতীত ভূমিকা বাংলাদেশে এখন বিস্মৃত এবং স্টার এবং আলো ছাড়াও আরও দু'একটি কাগজে তাঁর কলাম এখন আদৃত এবং প্রকাশিত। আলো-স্টারের নায়ারপ্রীতি যে কারণেই ঘটে থাকুক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু 'ভোরের কাগজ' জহুর হোসেন চৌধুরী স্মারক বক্তৃতাদানের নামে কেন বাংলাদেশের এই মানবতাবাদী বাম চিন্তাধারার মানুষটির সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের ও চিন্তাভাবনার একজনকে দিল্লী থেকে ঢাকায় নিয়ে এসেছে তার কারণ আমার কাছে অবোধ্য।
জহুর হোসেন চৌধুরীর স্মারক বক্তৃতায় তাঁর জীবন ও কর্মের কথা অনুপস্থিত। আছে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণমাধ্যমের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বহুবার শোনা রেটোরিক বা আপ্তবাক্য। এই আপ্তবাক্যের ফাঁকে ভারতে মাওবাদ ছড়িয়ে পড়ার পশ্চিমা ভীতি প্রচার করা হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ৩৫ বছর আগে ভারতে যে জরুরী অবস্থা ঘোষণায় বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁকে সামরিক শাসকদের নাগরিক অধিকার হরণের সঙ্গে তুলনা করে তার বহু পুরনো ইন্দিরা-বিদ্বেষ চরিতার্থ করার একটু সুযোগ নিয়েছেন। হাসিনা সরকারের ভাগ্য ভাল, এবার কুলদীপ নায়ার এই এক বছর বয়সী সরকারের কোন খুঁত আবিষ্কার করে কৌসলে তা এই স্মারক বক্তৃতায় ঢুকিয়ে দেননি।
সবশেষে আমার একটি বিস্ময়ের কথা। জহুর হোসেন স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান প্রধান অতিথি হয়েছেন এটা খুবই ভাল কথা। কিন্তু তাঁর ভাষণটি খোদা হাফেজ, বাংলাদেশ চিরজীবী হোক এই কথা দু'টির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। আমার বিস্ময় জয়বাংলা কথাটি উচ্চারিত হতে না দেখে। রাষ্ট্রপতি পদটি অদলীয়। তাই রাষ্ট্রপতি দলীয় স্লোগান দিতে পারেন না। কিন্তু জয়বাংলা স্লোগানটি কি দলীয়? এই স্লোগানটি ছিল আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান। সেদিক থেকে আমাদের জাতীয় স্লোগান। এখন এই স্লোগানে রাষ্ট্রপতি কণ্ঠ না মেলালে কি ধরে নিতে হবে এই স্লোগানকে আওয়ামী লীগ সরকারও অদলীয় স্লোগান বলে মনে করেন না?

No comments

Powered by Blogger.