সব ভাষা সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় সমান গুরুত্ব দেয়া হবে- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট উদ্বোধন কালে বললেন প্রধানমন্ত্রী

বিশ্বের সব জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরৰণ ও বিকাশে যাত্রা শুরু হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের। রবিবার এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
'৫২-এর ভাষা শহীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত এ ভবনটি পরিচিত হবে ভাষা ভবন হিসেবে। মাতৃভাষার চর্চা, প্রশিৰণ ও গবেষণার পাশাপাশি ভাষার সংরৰণ ও সুরৰা প্রদানেও সমান গুরুত্ব দেয়া হবে। বিশ্বের সকল ভাষার সম্ভ্রম রৰার ৰেত্রে ভাষা ইনস্টিটিউটকে ব্যবহার করা হবে। প্রতিষ্ঠানটি যাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান রূপেই একে গড়ে তোলা হবে। এছাড়াও এখানে পৃথিবীর সব ভাষার উপাদান ডাটাবেজে সঞ্চিত থাকবে। অডিওভিজু্যয়াল পদ্ধতিতে বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ভাষাসমূহকে দৃশ্যমান করা হবে। ভাষার ওপর লিখিত যাবতীয় বই, ব্যাকরণ সমৃদ্ধ একটি বিশ্বমানের লাইব্রেরী থাকবে। তাছাড়া আনত্মর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউট একটি ভাষা জাদুঘর ও আর্কাইভ পরিচালনা করবে। এ ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে ভাষা বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে চালকের আসনে উপনীত হবে। ভাষা ইনস্টিটিউটের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় প্রতিষ্ঠানটির উদ্দেশ্য ভূমিকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব কথা জানান।
তিনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে তার সরকারের পৰ থেকে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অচিরেই বাংলা জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্থান নেবে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামে বাঙালী জাতি কখনও মাথা নত করেনি। কারণ একুশ আমাদের শিৰা দিয়েছে মাথা নত না করার। প্রতিটি বাঙালীর কাছে একুশ অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রেরণা হয়ে আছে। বাংলা ভাষা যতদিন বেঁচে থাকবে একুশ আমাদের চেতনার বাতিঘর হয়ে থাকবে। একুশ আমাদের সাহস যোগায়, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখায়। আমরা যখন কোন সঙ্কটে পড়ি তখন শহীদ মিনারের পাদদেশে গিয়ে হাজির হই।
রবিবার সেগুনবাগিচার আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা প্রাঙ্গণে আয়োজিত এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিৰামন্ত্রী নুরম্নল ইসলাম নাহিদ। স্বাগত ভাষণ দেন শিৰা মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ আতাউর রহমান। দিবসটির গুরম্নত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে আলোচনা করেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এছাড়াও অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় আরও বলেন, ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকে মাতৃভাষার চর্চা, সংরৰণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধি থেকে ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। এজন্য ২০০১ সালের ১৫ মার্চ এ ভবনের ভিত্তিপ্রসত্মর স্থাপন করা হয়। মাত্র ২ বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু ২০১০ সালে এসে ভবনটির উদ্বোধন করতে হলো। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ৰমতায় এসে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে প্রতিষ্ঠানটির কাজ বন্ধ করে দেয়। যারা ভাষা, সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার মূল্য দেয় না, তারা মনে প্রাণে খাঁটি বাঙালী কিনা, দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তা না হলে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়া হতো না। দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার কারণে সময়ের অপচয় হয়েছে, সরকারে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে এবং ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে একুশের চেতনা। তবে তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারকে সাধুবাদ জানান এজন্য যে, তারা নির্মাণ কাজ বন্ধ না রাখলে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধনের সুযোগ হয়ত হাতছাড়া হয়ে যেত। তিনি বলেন, ভাষা ইনস্টিটিউট থেকে শুরম্ন করে, শিল্পকলা একাডেমী, বাংলা একাডেমী, শহীদ মিনার ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা নিয়ে একটি সংস্কৃতি বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি জোট সরকারের কারণে এ পরিকল্পনাও ভেসত্মে যায়। আবার এ কাজ শুরম্ন করা হবে।
পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সম্প্রতি বো ভাষার মৃতু্যর মধ্য দিয়ে যে ভাষা হারিয়ে গেল তার চর্চা আর কোন দিন হবে না। এমনিভাবেই পৃথিবী থেকে ধীরে ধীরে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট নৃ-গোষ্ঠীর বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষা ও কৃষ্টিও হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভবনের বাকি কাজ সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, অচিরেই ভবনের বাকি কাজ সম্পন্ন করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে চতুর্থ থেকে বারো তলা নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। এ টাকা দ্রম্নত ছাড় করতে তিনি অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। এছাড়া এ ইনস্টিটিউটের কর্মসূচী বাসত্মবায়ন করার জন্য শীঘ্র আইন প্রণয়ন ও দ্রম্নত লোকবল নিয়োগের কথা বলেন। এর মাধ্যমে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হবে যাতে কেউ কোনদিন এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে আর ষড়যন্ত্র করতে না পারে। এসব কর্মসূচী বাসত্মবায়নে ভাষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়ার কথা জানান তিনি।
শিৰামন্ত্রী বলেন, জাতির জন্য গর্বের এ প্রতিষ্ঠান নির্মাণে যেভাবে বাধাগ্রসত্ম করা হয়েছে এ ভবনটি তার নমুনা হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে যারা এমন ভবন নির্মাণ বাধাগ্রসত্ম করেছিল তারা জাতির রায়ে নিৰিপ্ত হয়েছে। একুশ ও একাত্তরের চেতনায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি সকলের প্রতি আহ্বান জানান। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যদি স্বায়ত্তশাসিত হয় তাহলে মেধা, মনন, পরিশ্রম সার্থক হবে। আর যদি পরিচালনা সরকারী কর্মকা-ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয় তাহলে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন সার্থক হবে না।

No comments

Powered by Blogger.