বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মাঘী পূর্ণিমা- শতদল বড়ুয়া

আজ শুভ মাঘী পূর্ণিমা। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে আজকের পূর্ণিমা তিথি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং পূত-পবিত্র। কারণ এই পূর্ণিমা তিথি গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ দিন ঘোষণার স্মৃতিবিজড়িত।
তাছাড়া এ তিথিতে বুদ্ধের আয়ু সংস্কার তিথিও পালন করা হয়। তবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে সকল পূর্ণিমা তিথি কোন না কোনভাবে গুরুত্ববহ।
বৈশালীরা চাপাল চৈত্র্যে মল্লদের শালবনে তথাগত শিষ্য পরিবেষ্টিত অবস্থায় ঘোষণা করলেন, তিনি আগামী পূর্ণিমা অর্থাৎ মাঘী পূর্ণিমা তিথি থেকে তিন মাস পর বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে পরিনির্বাণ লাভ করবেন। স্মরণীয় এ দিনে বুদ্ধ ভিু সংঘের উদ্দেশে বলেছিলেন, ভিুগণ অপ্রমত্ত, স্মৃতিমান, শীলবান সুসমাহিত স্থির চিত্তে সর্বদা এক উদ্দিষ্ট ল্যে চালিত হবে। আমার দ্বারা প্রকাশিত, সুব্যাখ্যাত, প্রত্য, ফলপ্রদ ও ফলদানে কালাকাল মানে না এমন ধর্ম বিনয় যে অপ্রমত্ত হয়ে বিহরণ করবে, সেই সংসার চক্র অতিক্রম করে বিমুক্তি আস্বাদন করবে।
বুদ্ধ তাঁর পঁয়তালি্লশ বছরব্যাপী ইহজগতের কল্যাণার্থী ধর্মকে অপ্রমত্তশীল সমাধি ও প্রজ্ঞার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তারই স্নিগ্ধ আলোয় জীবন পরিচালিত এবং স্বাবলম্বী করার যে অমোঘ বাণী ঘোষণা করেছেন, তা পালনেরও তিথি আজকের মাঘী পূর্ণিমা।
বৌদ্ধদের সামাজিক জীবনধারায় মাঘী পূর্ণিমা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আজকের এ শুভণে 'ত্রিপিটকম্ব বিষয়ে আলোকপাত করছি। ত্রিপিটকের অর্থ হলো ভগবান বুদ্ধের আদি, মধ্য ও অন্তিম বাণী। শাক্য দুলাল কুমার সিদ্ধার্থ গয়ার বোধিতলে বুদ্ধত্ব লাভের পর উদান গাথার মাধ্যমে অনাবিল আনন্দ প্রকাশ করে বলেছিলেন, এই দেহরূপ গৃহপতির অনুসন্ধানে কত অনন্ত জন্ম পরিগ্রহ করেছি, অসীম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছি। হে গৃহকারক, এবার তোমাকে দেখলাম, তুমি আর আমার দেহরূপ গৃহ তৈরি করতে পারবে না। সকল তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণরূপে ধবংস করে তোমার সকল খুঁটি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছি। এই আনন্দনির্ঝর বাণীই বুদ্ধের আদি বাণী।
তারপর থেকে দীর্ঘ পঁয়তালি্লশ বছর ধরে দেব-মানুষের হিত সুখ কামনায় যা সুন্দররূপে ব্যাঘাত ধর্মদেশনা করেছিলেন, সেগুলো হলো মধ্যম বাণী। আর মহাপরিনির্বাণের পূর্বমুহূর্তে বলেছিলেন, "হে ভিুগণ, তোমাদের নিশ্চিতভাবে অবহিত করছি যে, সংসারের যাবতীয় সংস্কার ধর্ম (উৎপন্ন বস্তু) য়িষ্ণু ও ব্যয়শীল। সুতরাং তোমরা, অপ্রমাদের সহিত আমার দেশিত বাণী সম্পাদন বা পালন কর।ঃ এগুলো তথাগতের অন্তিম বাণী। এই ত্রিবিধ বাণীর সমষ্টিকে বলে, 'ত্রিপিটক।ম্ব এটি তিনভাগে বিভক্ত। সেগুলো হলো: (১) বিনয় পিটক, (২) সূত্র পিটক এবং (৩) অভিধর্ম পিটক।
বিনয় পিটক: বিনয়ের অর্থ হলো কায়মনোবাক্য দ্বারা সংযত করার নিয়ম। এগুলো ভিু শ্রমণের প্রতি পালনীয় শীল বা নীতি। গাথায় এর সংখ্যা নির্ণয় করা হয়েছে সতেরো হাজার কোটি পঞ্চাশ লাখ ছয়ত্রিশ।
সূত্র পিটক: এটি ভিু-গৃহীদের প্রতিপালনীয় বিষয় এবং বুদ্ধ শ্রমণের সারা সংগ্রহ বশে ব্যবহারিক দেশনা। এই সূত্র পিটক নিকায় ভেদে পাঁচ প্রকার। দীর্ঘ নিকায়, মধ্য নিকায়, সংযুক্ত নিকায়, অঙ্গত্তর নিকায় ও খুদ্দক নিকায়।
অভিধর্ম পিটক: অভিধর্ম পিটক অতিশয় দার্শনিক তত্ত্ব। জনগণের ধারণার অতীত বিধায় ভগবান বুদ্ধ তা তাবতিংস স্বর্গের দেবগণের সম্মুখে প্রথম দেশনা করেছিলেন। এতে জটিল মনোবিজ্ঞান ধ্যানের বিষয় যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন।
গৃহীদের প্রতি ভগবান বুদ্ধের উদ্দেশ্যের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি। একদিন অন্নাথপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠী জেতবন বিহারে গিয়ে ভগবান বুদ্ধকে বন্ধনা করে এক প্রান্তে গিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। বুদ্ধ শ্রেষ্ঠীকে ল্য করে বললেন, "হে গৃহপতি, বুদ্ধ সামনে আর্যশিষ্যগণ স্বর্গসম্পত্তি ও যশঃকীর্তি লাভের যোগ্য চারটি বিষয় পূর্ণ করে থাকেন। সেগুলো চতুঃপ্রত্যয় দান অর্থাৎ ভিুসংঘকে চীবর, আহার, শয্যাসন ও ওষুধপথ্য দ্বারা সেবা করা। যারা এ চারটি বিষয়ে তৎপর হয়ে কর্তব্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করবেন তাদের অহরহ পুণ্য বৃদ্ধি হয়। এতে সুগতি লাভের পথ প্রশস্ত হয়। দুঃখ থেকে মুক্তির পথ উন্মোচিত হয়। গৃহীদের জন্য ইহজীবনের মঙ্গলজনক ও সুখময় চারটি নির্ধারিত বিষয় হলো- উৎসাহ, সংরণ, কল্যাণ মিত্রের সংশ্রব, শৃক্মখলাবদ্ধ জীবন। উৎসাহ গার্হস্থ্য জীবনে কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য যেভাবে যারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকুক না কেন, তাতে পরিশ্রমী ও উপায়কুশলী হতে হয়। যথাযথভাবে কার্য সম্পাদন করতে হয় এবং সকল বিষয়ে পূূর্ণ উৎসাহ রাখতে হয়।
সংরণ : পরিশ্রমলব্ধ সঞ্চিত ধন-রত্ন যেন অন্য কেউ অন্যায়ভাবে নিয়ে যেতে না পারে অথবা চুরি হয়ে না যায়, অগি্নতে দগ্ধ না হয় কিংবা বন্যায় ভেসে না যায়, ঈর্ষাপরায়ণ আত্মীয় যেন তিসাধন না করে সেই বিষয়ে তৎপর হওয়া একান্ত কর্তব্য।
কল্যাণমিত্রের সংজ্ঞা: যারা পুণ্যবান, শ্রদ্ধাবান, পরোপকারী, সুপরামর্শ দিয়ে অপরকে পুণ্য কাজের দিকনির্দেশনা দেয়, বিপথগামীকে সুপথে চলার অনুপ্রেরণা যোগায়, জগতে তারা কল্যাণমিত্র। তাদের সংশ্রবে থেকে আলাপ আলোচনা করে সৎ গুণাবলী স্বীয় জীবনে প্রতিফলিত করা একান্ত কর্তব্য। এতে নিজের সুবুদ্ধি জাগ্রত হয়ে দুর্লভ মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। পরকালে সুগতি লাভের হেতু হয়।
শৃক্মখলাবদ্ধ জীবনযাপন: নিজের আয়-ব্যয় বুঝে কৃপণতা ত্যাগ করে আয়ের তুলনায় ব্যয় সীমাবদ্ধ রেখে মিতব্যয়ী হতে হবে। অর্থের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে ব্যয় অপো আয়ের মাত্রা যাতে বাড়ে সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে। অপরিণামদর্শীরা জীবনে উন্নতি লাভ করতে পারে না। দুঃখ-কষ্ট তাদের জীবনে লেগেই থাকে। ভোগশালী হয়ে অথবা কৃপণতার আশ্রয়ে গেলে কল্যাণকর কোন কাজের সন্ধান পাওয়া যাবে না।
ইহজগতে মানুষ যা কিছু করে অনেক কষ্টের বিনিময়ে, তা সাধারণত চারটি কারণে ধবংস হয়ে যায়। তাহলো বেশ্যাসক্তি, নেশাপান, জুয়াখেলা এবং দুঃশীল কুসঙ্গীর সাথে মিত্রতা। সুন্দর জীবন গঠনের মূল গুণাবলী হলো শ্রদ্ধাগুণ, শীলগুণ, দানগুণ ও প্রজ্ঞাগুণ।
মাঘী পূর্ণিমার আর এক উল্লেখযোগ্য অংশ হলো 'মেলাম্ব। প্রাচীনকালের সেই ঐতিহ্য যদিও আমরা নানা কারণে হারাতে বসেছি, তবুও কিছু কিছু জায়গায় তা বহমান। চট্টগ্রামের বুড়া গোঁসাই মেলা, পটিয়ায় ঠেগরপুনিমেলা, বিনাজুরীর পরিনির্বাণ মেলা, আবদুল্লাপুরের মাঘী পূর্ণিমা মেলা উল্লেখযোগ্য।
শেষ কথা- বর্তমানে আমাদের সমাজে যে নৈতিক ও ধর্মীয় অবয় নেমে এসেছে, তা রোধকল্পে ভিু সংঘসহ দায়ক-দায়িকাদের এগিয়ে আসতে হবে। আজকের অমানিশা যাতে কেটে ওঠা যায়, তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসা। তাই আসুন, আজকের মাঘী পূর্ণিমার দিনে শীলে পরিশুদ্ধ হয়ে শপথ গ্রহণ করি_ 'বুদ্ধনীতি অনুসরণ করব, নৈতিক অবয় রোধ করব।ম্ব
'ভবতু সব্বমঙ্গলংম্ব।

No comments

Powered by Blogger.