রফিকুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে তদন্তকারীরা এখনও অন্ধকারে- সে ছিল ওয়াজিউল্লাহ হত্যা মামলার ৫ নম্বর আসামি by শংকর কুমার দে

রাজধানী ঢাকার ৫৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম মজুমদারকে হত্যার জন্য কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় তাঁর শ্বশুরবাড়িকে বেছে নেবে কেন? তিনি যে শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছেন তা হত্যাকারীরা জানল কিভাবে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের রাজধানীর মহানগর সুপার মার্কেটের সভাপতি ওয়াজিউল্লাহ হত্যার ৫ নম্বর আসামি হিসেবে রফিকুল ইসলামকে হত্যার বদলে হত্যার প্রতিশোধ নিতে খুন করা হয়েছে কি? তদন্তকারীদের সামনে এসেছে এই ধরনের নানা প্রশ্ন।
প্রশ্ন উঠেছে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শ্বশুরবাড়ি থেকে রফিককে র‌্যাব পরিচয়ে ডেকে নেয়ার খবরটি তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় তাঁর আত্মীয়স্বজনদের কাছে জানানো হয়নি। ড্রাইভারের মাধ্যমে খবরটি পেয়েছে ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর আত্মীয়স্বজনরা। তারপরের ঘটনাটি মর্মান্তিক বিয়োগান্তক। তদন্তকারীরা এখনও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। রফিকুল ইসলাম মজুমদার হত্যাকা-ের কারণ ও হত্যাকারী কারা তা উদঘাটনের জন্য তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্তকারী সূত্র জানান, শনিবার রাত ১১টায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়নের মাঠ থেকে হাতকড়া পরিহিত অবস্থায় রফিকুল ইসলামের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যা ৭টায় র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে তুলে নেয়া হয় ঝিনাইদহের শৈলকুপার আনন্দনগর গ্রামের শ^শুরবাড়ি থেকে। মাত্র চার ঘণ্টা পর উদ্ধার হয় তাঁর লাশ। এর আগের দিন শুক্রবার রাজধানী ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়িতে যায় রফিকুল ইসলাম। তাঁর শ্বশুরবাড়ি হচ্ছে ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আর লাশ পাওয়া গেছে কুমারখালী উপজেলার বাগুলাট ইউনিয়ন এলাকায়। তদন্তকারীদের সামনে এখন প্রশ্ন, হত্যাকারীরা কিভাবে আগেই জেনেছে যে সে শুক্রবার তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছে? রফিকুল ইসলামকে হত্যার জন্য তাঁর শ্বশুরবাড়িকে বেছে নিয়েছে কেন? শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর তাঁকে র‌্যাব পরিচয়ে ডেকে নেয়া হয়। র‌্যাব পরিচয়ে তাঁকে ডেকে নেয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় তাঁর পরিবারকে জানানো হয়নি। ড্রাইভারের মাধ্যমে এই খবরটি জানতে পেরেছে রফিকের স্বজনরা। এসব ঘটনায় তদন্তের সামনে রহস্যের জট পাকাচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকার পরিকল্পিতভাবে এই হত্যাকা- ঘটিয়েছে। এর সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশ শতভাগ জড়িত বলে আমরা মনে করি। নিহতের পরিবারের অভিযোগও র‌্যাব, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকেই। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যে কাউকে যদি হত্যা করতে হয় তবে রাজধানী ঢাকাসহ যে কোন স্থানকেই বেছে নিতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অতীতে যেসব ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গুম, খুনের অভিযোগ ওঠেছে তা রাজধানী ঢাকার বাড়ি বা কোথাও থেকে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ অন্যত্র ফেলে দেয়া হয়েছে কিংবা লাশ একেবারেই গুম করে ফেলা হয়েছে। রফিকুল ইসলাম হত্যাকা-ের ব্যাপারে ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী হত্যাকা- কেন? কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার বিষয়টি সাধারণত তাঁর পরিবারের সদস্যদের জানার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার খবরটি ফাঁস করে দিয়েছে কে বা কারা?
রফিকুল ইসলাম মজুমদার ছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঢাকা সুপার মার্কেটের সভাপতি হাজী ওয়াজি উল্লাহ গুম হত্যার ৫নং আসামি। রফিকুল গুম হত্যার বদলে গুম হত্যার শিকার কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রফিকুল ঢাকার ৫৬নং ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হলেও মার্কেট দখলের দিক দিয়ে তাঁর সখ্য প্রমাণ পাওয়া যায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ঢাকা সুপার মার্কেট ছিল হাজী ওয়াজি উল্লাহর নিয়ন্ত্রণে।
পাশের মার্কেট বাংলাদেশ সুপার মার্কেট ছিল বাবুলের নিয়ন্ত্রণে। ২০০৯ সালে রফিকুল ইসলাম মজুমার আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের সঙ্গে আঁতাত করে মার্কেটের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ঢাকা সুপার মার্কেট ও বাংলাদেশ সুপার মার্কেটকে একত্রিত করে মহানগর সুপার মার্কেট করার নেতৃত্ব দেয় রফিকুল ইসলাম। মহানগর মার্কেট ছাড়াও রাজধানীর বেশ কয়েকটি মার্কেটে তাঁর অংশীদারিত্ব, ব্যবসাসহ নানা ধরনের অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয় জড়িত ছিল সে। এরই মধ্যে ওয়াজিউল্লাহ নিখোঁজ হয়ে গেলে গুম হত্যার অভিযোগ এনে যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয় তার মধ্যে রফিকুল ইসলাম ছিলেন ৫নং আসামি। এখন প্রশ্ন ওঠেছে মার্কেট নিয়ে দ্বন্দ্বে প্রতিপক্ষের হাতে রফিকুল ইসলাম হত্যার শিকার কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, শুধু মার্কেট কেন্দ্রিক ব্যবসা নিয়েই রফিকুল গুম হত্যার তদন্ত সীমাবদ্ধ নয়। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রফিকুল ছিলেন প্রভাবশালী, বিত্তবান ও জনপ্রিয় নেতা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার প্রার্থীও ছিলেন তিনি। সরকারবিরোধী রাজনীতিতে ছিল তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তাঁর খুন হওয়ার পর মার্কেটের সাধারণ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিক্ষোভে, প্রতিবাদে ফেটে পড়ে নানা কর্মসূচীতে অংশ নিচ্ছে। এতে তাঁর জনপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়। জনপ্রিয়তাও কখনও কখনও কাল হয়ে দাঁড়ায়। তারপর তিনি ছিলেন ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার সম্ভাব্য প্রার্থী। পারিবারিক শত্রুতা, ব্যবসার বিরোধ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও তাঁর হত্যাকা-ের কারণে কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহল প্রতিপক্ষ মনে করে তাঁকে হত্যা করেছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
মামলা হয়নি ॥ মঙ্গলবার পর্যন্ত রফিকুল ইসলাম হত্যাকা-ের ব্যাপারে কোন মামলা দায়ের করা হয়নি। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। কে বা কারা কি কারণে তাঁকে হত্যা করেছে সেই ব্যাপারে তদন্তকারীরা অন্ধকারের মধ্যে আছে। তাঁকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেই ঘটনাস্থল থেকে এক জোড়া জুতা উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর শরীরে কোন বুলেটের আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তাঁর মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ঘটনাস্থলে পাওয়া গেছে একটি মাফলার। মাফলার দিয়ে শ্বাসরোধ ও মাথায় আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.