চরাচর-এক গানওয়ালা by বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

গানের সঙ্গেই বসবাস দীর্ঘদিনের। গান গেয়েই চলে তাঁর সংসার। জীবনের নানা টানাপড়েনের মধ্যেও গান গেয়ে সুখ-স্বস্তি খোঁজার নিত্য পথযাত্রী তিনি। তাতে যা আয় হয় তা দিয়েই সন্তুষ্ট হয় বাউল মন। গান গাইতে গাইতে চেনা পথের ধূলিতে ভরে ওঠে শরীর। বাতাসে ভর করে জীর্ণ পোশাকে ধূলিকণার পরশ লাগে।


প্রতিদিন চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শহরে এসে গান গেয়ে বেড়ানো এই মানুষটির নাম মণীন্দ্র শব্দকর। থাকেন শ্রীমঙ্গল উপজেলার ইছবপুর গ্রামে। চার-পাঁচ শতাংশের বসতভিটাই এখন তাঁর শেষ ঠিকানা। গান গেয়ে প্রতিদিন যা আয় হয়, তা দিয়ে কোনোমতে চলে তাঁর সংসার। সংসার বলতে এখন শুধু তাঁর বৃদ্ধ স্ত্রী ও এক ছেলে। তিন সদস্যের জরাজীর্ণ সংসারে দারিদ্র্য বাসা বেঁধেছে বহু দিন ধরে। এই বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে প্রথম স্ত্রী ও একে একে ছয় সন্তানের মৃত্যুস্মৃতি তাঁর গানের কণ্ঠকে বেদনায় ভরিয়ে দেয় বারবার। গান যেন তখন যন্ত্রণা লাঘবের এক মহামন্ত্র হয়ে দেখা দেয় তাঁর কাছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে গান শোনানোর এই কাজে কখনো ক্লান্ত হন না তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত চলে তাঁর এই গান শোনানোর কাজ।
তাঁর বয়স সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'ভারতবর্ষ যখন ভাগ হয় তখন আমার বয়স বাইশ-তেইশ ছিল। ছোটবেলা থেকেই গান শিখেছি। অমর দেব নামের এক ব্যক্তি আমাকে গান শিখিয়েছিলেন। গান ধরে রাখতে অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন আমাকে। পরে কলকাতায় গিয়ে শারীরিক অসুস্থতায় মারা যান তিনি। একসময় বাউল গানের আসরে নিয়মিত গান গাইতাম। কীর্তনের আসরেও ঘন ঘন ডাক পড়ত আমার। ওগুলোতে যেতাম, গান পরিবেশন করতাম। আহা! কী যে এক আনন্দের সময় ছিল সেই দিনগুলো।...' বলতে বলতে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন মণীন্দ্র। একটু থেমে আবার বলেন, 'এখন তো অসুস্থতার জন্য তেমনভাবে আর গান গাইতে পারি না। গলার সুরও আস্তে আস্তে যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এই শেষ বয়সে কিছুটা কষ্ট হলেও মানুষকে গান শুনিয়ে অনেক আনন্দ পাই, অনেক শান্তি পাই। সবাই যে আমার গান শোনে তা অবশ্য নয়। অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠরাই আমার শ্রোতা। এলাকার মনির মেম্বার আমাকে বয়স্কভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিন মাস পর পর ৯০০ টাকা করে ভাতা পাই।'
বৈবাহিক জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই অশ্রু যেন হঠাৎ একে একে বেরিয়ে এলো চোখ থেকে। তিনি জানান, 'বড় কষ্টে ভরা এই জীবন আমার। আমার বড় মেয়েটার জন্মের মাত্র তিন দিনের মাথায় সে ও তার মা সারদা চলে গেল। পরে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের চাপে আবার বিবাহ করলাম। এখানেও পাঁচ পুত্রসন্তানের মৃত্যুশোক ক্ষত-বিক্ষত করল আমাকে। এখন একমাত্র পুত্র বীরেন্দ্র ও স্ত্রী লক্ষ্মীকে নিয়েই বেঁচে আছি কোনোরকম। আমার স্ত্রী রাতে ভালোভাবে চোখে দেখতে পায় না। গানের ব্যাপারে আমাকে এখনো উৎসাহ দেয় সে।'
পল্লীগান সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এই গান কখনোই হারিয়ে যাবে না। যুগ যুগ ধরে এগুলো টিকে থাকবে আমাদের মতো গাইয়েদের প্রাণে। গানের সঙ্গে প্রাণের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। যারা গান গায় তারা তা বোঝে।...' একসময় কথা থামে তাঁর। কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে কিছু সুরধ্বনির অপূর্ব উচ্চারণ, 'যারে ডাকলে হয় রে প্রাণ শীতল...। '
বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন

No comments

Powered by Blogger.