আসতে-যেতে অস্বস্তি by অমিত বসু

পরিযায়ী পাখিদের স্বদেশে মন বসে না। ওড়ে এ দেশ-সে দেশে। ঘুরে-ফিরে আকাশ-বাতাসের ঘ্রাণ নেয়। ডানায় মাখে রোদ-বৃষ্টি। নদী-সরোবরে শরীর ডুবিয়ে স্নিগ্ধ হয়। ফুল-ফলের সঙ্গে নিবিড় আলাপে অক্লান্ত। তারা কি কখনো মানুষের মন ছোঁয়ার চেষ্টা করে! ইন্টারভিউয়ে জানার উপায় নেই। ইংরেজি-বাংলা কিছুই বোঝে না। যা বলার গান গেয়ে বলে।


হৃদয়তন্ত্রীতে ঝঙ্কার তোলে। তারা চলে গেলেও তার রেশ থাকে। পাখি যা পারে, মানুষ তা পারে না কেন? এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে হলে অনেক ঝক্কি। ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের ব্যারিকেড টপকাতে ধৈর্য-সময়- দুই-ই লাগে। পাখিদের সেসবের তোয়াক্কা নেই। সীমা মানে না, অসীমের যাত্রী। বিশ্বময় এখন মানুষের চেয়ে পণ্যের কদর। আমদানি-রপ্তানি করতে অসুবিধা নেই। বিপদ মানুষের। সন্দেহ-অবিশ্বাসের বেড়াজালে বন্দি। তার থেকে মুক্তি পাওয়া কী সোজা কথা!
ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে সকাল থেকে হাজার হাজার মানুষের ভিড়। ইচ্ছে ভারত সফরের। চিকিৎসা, শিক্ষা, মার্কেটিং, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা নিছক পর্যটন। অস্বস্তির ফাঁদ অনিবার্য। অনেক ক্ষেত্রেই ভিসা অধরা। বিশ্বনন্দিত প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কলিম শরাফীর মতো বরেণ্য মানুষকেও সেই ফাঁদে পড়তে হয়েছিল। কলকাতায় টেলিভিশনে বিশেষ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি আসতে পারেননি। এ লজ্জা ঢাকার মতো কাপড় কল এখনো পৃথিবীতে তৈরি হয়নি। তখনকার ভারতীয় কমিশনার বীণা সিক্রিকে প্রশ্ন করেছিলাম, এটা কী করলেন? তাঁর উত্তর ছিল, কী করব! তাঁকে চিনতাম না। কূটনীতিকের দায়িত্ব দুই দেশের মধ্যে সৌহার্দ্যের সেতুবন্ধটি শক্তপোক্ত করা। তার জন্য কর্মরত দেশের গুণী-জ্ঞানী মানুষদের জানা অবশ্য কর্তব্য। তাঁরাই সম্পর্ক নির্মাণের স্তম্ভস্বরূপ। তা ছাড়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনটাই বা বাদ যাবে কেন? তাঁদের ভয় সন্ত্রাসী ও দুষ্কৃতকারীদের নিয়ে। কূটনীতিকের ছাঁকনিতে কি তারা আটকাচ্ছে? যারা এসব কাজ করে, ভিসাটিসা তাদের কাছে কোনো ব্যাপার নয়। সব দেশেই যাওয়া-আসা ছন্দে-স্বচ্ছন্দে। বিশ্বজোড়া র‌্যাকেট। বিশ্বটাই তাদের দেশ। মাঝখান থেকে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি।
কৈফিয়ত হিসেবে বলা হয়েছিল, যারা যায়, তাদের অনেকে ফেরে না। এটাও অকাট্য যুক্তি নয়। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার। সেটা গলে দুই দেশের মধ্যে যাওয়া-আসাটা মোটেও কঠিন কাজ নয়। ইউরোপ, আমেরিকা যেতে হলে পাসপোর্ট-ভিসা জরুরি। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কেউ কেউ থেকে যায় অন্নসংস্থানের আশায়। থাকলেও শঙ্কার প্রহর কিন্তু কাটে না। ধরা পড়লে কঠোর শাস্তি। এসব অসুবিধা সত্ত্বেও সেখানে গ্রিনকার্ড বা নাগরিকত্ব দানের প্রথা আছে। সেটা পেলে অন্য দেশের মানুষের নিশ্চিন্তে বসবাসের সুযোগ আছে।
সার্ক দেশগুলোর মধ্যেও সে ব্যবস্থা চালু করার কথা উঠেছিল। বাস্তবায়িত হয়নি। জনসংখ্যার চাপের কথা ভেবে পিছিয়েছে। আয়তনে আমেরিকা ভারতের তিন গুণ। জনসংখ্যায় ভারতের তিন ভাগের এক ভাগ। ভারতের ১২০ কোটি, আমেরিকার ৪০ কোটিরও কম। ইউরোপ বেঁচে গেছে আমেরিকার জন্য। তাদের অতিরিক্ত জনসংখ্যা আমেরিকায় জায়গা পেয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায়ও থাকতে পারছে। সার্ক দেশগুলোর সে সুযোগ হয়নি। অতিরিক্ত ফাঁকা জমি তাদের বরাতে জোটেনি। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার না করলে এত দিনে ইউরোপের দেশগুলোরও নাভিশ্বাস উঠত। কী করা যাবে, ভূগোলে গোলমাল! সার্ক দেশগুলো থেকে আমেরিকায় অবৈধ বসবাস নিয়ে হৈচৈ হয় বটে, সেই সংখ্যা কিন্তু নগণ্য। আমেরিকা চিৎকার করলেও তাদের ঠাঁই দেওয়ার পেছনে স্বার্থও আছে। অবৈধ লোক দিয়ে অনেক সস্তায় কাজ করানো যায়। তারা কখনোই ন্যায্য মজুরি দাবি করতে সাহস পায় না।
আমেরিকায় অবৈধ বসবাসকারীর মধ্যে লাতিন আমেরিকায় লোক কম নয়। তাদের একটা বড় অংশ নির্মাণকর্মী। বাড়িঘর তৈরির কাজে তারা দক্ষ।
আমেরিকার বৃহৎ অট্টালিকা থেকে শহরের বাইরে সুদৃশ্য বাংলোর অধিকাংশই নির্মিত মেক্সিকোর রাজমিস্ত্রিদের নিপুণ হাতের কল্যাণে। কারিগররা বৈধ হলে খরচ বাড়ত চার গুণ। তবু আমেরিকা মেক্সিকানদের দেখলে চোখ রাঙায়। সীমান্তে দেয়াল তোলার হুমকি দেখায়।
কোনো দেশে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ আর সাধারণ মানুষের ভাগ্যান্বেষণ এক কথা নয়। স্বাভাবিক কারণটাকে গুরুত্ব দিতেই হয়। নইলে দেশে দেশে ভ্রাতৃত্বের আলো জ্বলবে কিভাবে? মৌলবাদী রজনীতি সে কথা বলে না। ব্যবধান তৈরিই তাদের লক্ষ্য। মানবদরদিরা সে কথা বলতে গেলে সেই রাজনীতিকরা উল্টো সুরে গান গাইতে শুরু করে। সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়। অবিশ্বাস-বিদ্বেষের আগুন জ্বালে। যাতে পোড়ে সম্পর্ক।
অদৃশ্য প্রাচীর দূরত্ব ঘোষণা করে। প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যাতায়াত সংকুচিত হয়।
আসামে দাঙ্গা অনভিপ্রেত। সমস্যা নির্বাপিত করার দায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের। সে কাজটা হচ্ছে না যে তা নয়। মৌলবাদী শক্তির সেটা পছন্দ নয়। খুঁচিয়ে ঘা করার সুযোগ ছাড়বে কেন?

লেখক : কলকাতার সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.