জীবনের ৪০ বছর নাটকে নিবেদন, এখনও অফুরন্ত প্রাণশক্তি- ষড়ৈশ্বর্য লাকী ইনামের নাট্যোৎসবের সমাপ্তি by মোরসালিন মিজান

প্রচার একটু কম পেয়েছেন। কিংবা এসবের ভেতর দিয়ে যেতে আগ্রহী হননি লাকী ইনাম। কোনটি বেশি সত্য? চটজলদি উত্তর করার সুযোগ নেই। তবে এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, তিনি মঞ্চে ছিলেন, আছেন এবং এই এখনও ভরপুর প্রাণশক্তি তাঁর। ছিঁটেফোটা ক্লান্তি নেই চোখেমুখে। এভাবে পা রেখেছেন ষাটে।


এর থেকে চল্লিশ বছর তুলে নিয়ে নাটকে নিবেদন করেছেন তিনি। ফলে আজ ষড়ৈশ্বর্যের নতুন এক আঙ্গিক তাঁর মধ্যে খুঁজে পান শিষ্য ও বন্ধু নাট্যকর্মীরা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নাট্যনৃত্য, নাট্যগীত, নাট্যাভিনয়, নাট্য রচনা, নাট্য নির্দেশনা ও নাট্য শিক্ষকতা। সবগুলোর সমন্বয় করে নাট্যোৎসবের নাম দেয়া হয়েছিল ষড়ৈশ্বর্য লাকী ইনাম নাট্যোৎসব ২০১২। লাকী ইনামের জন্মদিন উপলক্ষে ছয় দিনব্যাপী এ নাট্যোৎসবের আয়োজন করে নাগরিক নাট্যাঙ্গন ও উৎসব নাট্যস্বজন পর্ষদ। শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালায় গত ৪ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া উৎসব রবিবার শেষ হয়েছে। ছয়দিনব্যাপী উৎসবে লাকী ইনাম নির্দেশিত ছয়টি নাটক মঞ্চস্থ হয়। অধিকাংশ নাটকে অভিনয়ও করেন তিনি। লাকী ইনামের নাটকের দল নাগরিক নাট্যাঙ্গন এসব নাটক মঞ্চস্থ করে। দর্শকও ছিল প্রচুর। উৎসব উপলক্ষে দারুণ দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমীর জাতীয় নাট্যশালার ভেতর ও বহিরাঙ্গন। আর তারপর রবিবার পর্দা নেমেছে উৎসবের।
সমাপনী দিনে মঞ্চস্থ হয় শিল্পকলা একাডেমী প্রযোজনা ‘বিদেহ।’ নির্দেশনা দেয়া ছাড়াও নাটকে অনবদ্য অভিনয় করেন লাকী ইনাম। তাঁর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন মোমেনা চৌধুরী ও জ্যোতি সিন্হা। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় সব সময়ই একটু পেছনে পড়ে থাকা বীরাঙ্গনাদের সামনে আনার প্রয়াসটি এ নাট্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। স্বাধীন দেশে কেমন আছেন বীরাঙ্গনারা? তাঁদের শরীরে পচন ধরেছিল নাকি এই সমাজে? এই রাষ্ট্র কি দাঁড়াতে পেরেছে তাঁদের পাশে? বুকের ক্ষত, বিসর্জনের ব্যথাগুলো কি ভাগ করে নিতে পেরেছি আমরা? হালিমা, শান্তিকুমারী চরিত্রের মধ্য দিয়ে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তরুণ নাট্যকার শাহমান মৈশান।
নাট্য প্রদর্শনী ছাড়াও এদিন সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয় কয়েকটি জাতীয় সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে। তবে তালিকাটা একটু নতুন। এতে এমন কিছু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের নাম স্থান পায় যেগুলো নাটকসহ শিল্প সংস্কৃতির চর্চাকে এগিয়ে নিতে, নির্বিঘœ করতে জাতীয় পর্যায়ে কাজ করে থাকে। একই সঙ্গে সত্য যে, সংগঠনগুলোর কোন আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি সাধারণত জোটে না। এ দিকটি বিবেচনায় নিয়েই হোক কিংবা নিজেদের উৎসবের সঙ্গে সংগঠনগুলোকে সম্পৃক্ত করার ইচ্ছে থেকে ব্যতিক্রমী এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্মাননা ক্রেস্ট পায় শিল্পকলা একাডেমী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষে ক্রেস্ট গ্রহণ করেন লিয়াকত আলী লাকী, গোলাম কুদ্দুছ, ঝুনা চৌধুরী, মান্নান হীরা প্রমুখ। নাট্যজন আতাউর রহমান তাঁদের হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন।
এর আগে উৎসবের বিভিন্ন দিনে মঞ্চস্থ হয় আরও পাঁচটি নাটক। উদ্বোধনী দিন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাট্যশালায় মঞ্চস্থ হয় আর্থার মিলার ও প্রৈতী হক অনূদিত ‘পুসি বিড়াল ও একজন প্রকৃত মানুষ।’ বুধবার মঞ্চস্থ হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প অবলম্বনে নির্মিত নাটক ‘মুক্তির উপায়।’ বৃহস্পতিবার মঞ্চস্থ হয় দীপক সেন রচিত নাটক ‘সরমা।’ দলের অন্যতম আলোচিত প্রযোজনা ‘প্রাগৈতিহাসিক।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে নাটকটি রচনা করেন মাহুমুদুল ইসলাম। এটি মঞ্চস্থ হয় গত শুক্রবার। শনিবার পরিবেশিত হয় দলের প্রাণপুরুষ ড. ইনামুল হক রচিত ‘সেইসব দিনগুলো।’
নাট্য প্রদর্শনী ছাড়াও নাট্যশালার লবিতে লাকী ইনামের কর্মময় জীবনের ওপর নির্মিত ভিডিওচিত্র, আলোকচিত্র ও পুস্তক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। সব মিলিয়ে অনবদ্য উৎসব। কিন্তু যাকে ঘিরে এত আয়োজন তাঁর কি অনুভূতি জানতে চাইলে বেশ সতর্ক মনে হয় লাকী ইনামকে। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, চল্লিশ বছর ধরে নাটক করছি। সময়টা সেলিব্রেশন করতেই এ উৎসব। পুরোটা সময় নীরবে কাজ করতে চেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, এ জন্যই উৎসবের সেøাগান ঠিক করা হয়েছে তোমার মাভৈঃ বাণী বাজে নীরব নির্ঘোষণে। এর পর তিনি বলেন, পথচলা কতটা সফল বা ব্যর্থ সে মূল্যায়ন করবেন দর্শক ও সমালোচকরা।
বলা বাহুল্য, লাকী ইনামের নামে এত বড় পরিসরে বর্ণাঢ্য নাট্যোৎসব আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের মূল্যায়ন জানিয়ে দিয়েছেন দলের নাট্যকর্মী ও বিদগ্ধজনেরা। আয়োজকদের এই দলে আছেন স্বামী ড. ইনামুল হক, মেয়ে হৃদি হকসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও। তবে তারাও লাকী ইনামকে নাট্যকর্মী হিসেবেই মূল্যায়ন করতে চান। সে কথা জানিয়ে মেয়ে হৃদি হক বলেন, গত চল্লিশ বছর ধরে মঞ্চে কাজ করছেন লাকী ইনাম। তাঁর কাছ থেকে প্রতিনিয়ত আমরা শিখছি। তাঁর মতো গুরুজনদের সামনে রেখেই তরুণ প্রজন্মের নাট্যকর্মীরা এগিযে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। আমাদেরও তাই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.