একদার রফতানিমুখী চা শিল্প হাবুডুবু খাচ্ছে সমস্যাসাগরে- চা শিল্পে সঙ্কট ১ by রহিম শেখ

এক সময়ের রফতানিমুখী চা-শিল্প এখন অনেকাংশই আমদানিনির্ভর। রফতানি দূরের কথা দেশে উৎপাদিত চা অভ্যন্তরীণ চাহিদাই মেটাতে পারছে না। এদিকে নতুন নিলাম কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে চায়ের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষীণ সম্ভাবনা থাকলেও সেই প্রক্রিয়াটি ঝুলে আছে বাগান মালিকদের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে। অন্যদিকে ক্ষয়িষ্ণু চা শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা দিন দিন শোচনীয় হয়ে উঠছে।


চা বোর্ড সূত্রমতে, ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেটের মালিনীছড়া বাগানে চা চাষ শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ অঞ্চলে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। দেশের ছোটবড় ১৬৪ চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩, হবিগঞ্জে ২২, সিলেটে ২০, চট্টগ্রামে ২২, রাঙ্গামাটিতে ১ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি অবস্থিত। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও এলাকায় আরও ৫ চা বাগান তৈরি করা হয়েছে। মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩ বাগানের মধ্যে ১৯ বাগান রয়েছে শ্রীমঙ্গলে। এসব চা বাগানের রয়েছে ৪৪ ফাঁড়ি বাগান। দেশের ১৬৪ মূল বাগান এবং ৪৪ ফাঁড়ি বাগান কেন্দ্রিক মোট জনসংখ্যা সাত লক্ষাধিক।
চা-শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের সমস্যা পর্বতপ্রমাণ। তারা যেন নিজ দেশেই পরবাসী। যাদের রক্ত, ঘাম আর নরম হাতের স্পর্শে তৈরি এ দেশের চা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত, সেই চা-শিল্পে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা আজো অবহেলা, অনাদর এবং বঞ্চনার শিকার। দীর্ঘ দিনেও চা শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হয়নি। চা শ্রমিকদের শ্রমে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হলেও তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশ নিম্ন থেকে নিম্নমুখী হচ্ছে। চা-শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না মূলত অল্প রোজগারের কারণে। এর মধ্যে গত তিন বছর ধরে চায়ের উৎপাদন কম হওয়ায় শ্রমিকদের বাড়তি আয়ও কমে গেছে। সমস্যার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে শ্রমিক ও শ্রমিক পরিবারগুলো। এ যেন তাদের দাসত্বের ঋণ। সমস্যার মধ্যে প্রধান সমস্যাগুলো হলো বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য, পানীয়জল ও কর্মসংস্থান। বর্ষা মৌসুমে অনেক চা বাগানে ঝড়ে শ্রমিকদের ঘর বিধ্বস্ত হলেও বাগান কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তা মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। ফলে অনেক শ্রমিক পরিবার পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে।
সূত্র মতে, চা শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ বাগানেই কোন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ফাঁড়ি বাগান মিলিয়ে মোট ২৪০ চা বাগানে সরকারী ও স্যাটেলাইট বাগানে রয়েছে মাত্র ৯ বিদ্যালয়। গত দেড় বছরে অন্যান্য চা বাগানে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকাওয়াস্তে করা হলেও সেখানে নেই ছাত্র এবং শিক্ষকদের বসার কোন আসবাব। নেই শিক্ষা উপকরণ। বেঞ্চ-ডেস্ক না থাকায় অধিকাংশ বিদ্যালয়ে মাটিতে চট বিছিয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করছে। শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দিন দিন এগিয়ে গেলেও চা বাগানের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের অধিকাংশ চা বাগানে কর্মরত শ্রমিক পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন নেই। নেই ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা। বিশেষ করে ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগানগুলোতে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন হাতেগোনা। চা-শিল্পাঞ্চলে বসবাসরত ৭ লক্ষাধিক জনসংখ্যার অধিকাংশই খোলা স্থানে এবং চা বাগানের অভ্যন্তরে পায়খানা-প্রস্রাব করে থাকে। একটি বেসরকারী সংস্থার জরিপ অনুয়ায়ী দেখা যায়, চা বাগানের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ৪৩.৩৭ শতাংশ খোলা স্থানে, চা বাগানের অভ্যন্তরে পায়খানা-প্রস্রাব করে। ১৬.৮৭ শতাংশ ব্যবহার করে কাঁচা বা উন্মুক্ত ল্যাট্রিন। বাকিরা রিং সø্যাব লেট্রিন এবং স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মকর্তা পরিমল সিং বাড়াইক জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের শ্রমআইন অনুযায়ী কাজের স্থানে প্রয়োজনীয় পায়খানা-প্রস্রাবখানা রাখার বিধান থাকলেও কোন বাগানেই শ্রমিক লাইনের ল্যাট্রিন ছাড়া আর কোন ব্যবস্থা নেই। তাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এমনও দেখা গেছে ১০ থেকে ১৫ শ্রমিক পরিবার একটি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে, যা অত্যন্ত অমানবিক। অপরদিকে বাগান কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, চা বাগানের শ্রমিকরা স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়। তারা খোলা বা উন্মুক্ত স্থানেই প্রাকৃতিক কাজ সেরে থাকে। চা শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ বাগানে নিরাপদ খাবার পানির তীব্র সঙ্কট। শ্রমিক পরিবারগুলোর খাবার ও রান্নাবান্নার জন্য নলকূপ নেই বললেই চলে। যেসব নলকূপ রয়েছে তার অধিকাংশই বছরের বেশিরভাগ সময় অকেজো থাকে। বাগানের কূপের পানিই একমাত্র ভরসা।
জানা গেছে, এক সময় বিভিন্ন বাগানে কীটনাশক ছিটানোর কাজে নির্দিষ্ট চা শ্রমিক ছিল। বর্তমানে এই নিয়ম মানছে না অধিকাংশ চা বাগান। চা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিষাক্ত কীটনাশক ছিটানোর কাজ যারা করছে তাদের অনেকেরই মাথা ব্যথা, চোখ জ্বালাপোড়া, নাক-কান জ্বালাপোড়া এমনকি হৃদকম্পন, শ্বাসকষ্ট, শরীর কাঁপা, বমিভাবসহ অসংখ্য উপশমে ভুগছে। আর এসব হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্যের প্রতিক্রিয়ার কারণে। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ নিরক্ষর-অসচেতন চা শ্রমিককে বিষক্রিয়া সম্পর্কে কোন রকমের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত চা বাগানে গড়ে ওঠেনি। জানা যায়, আগাছা দমনের ওষুধ শরীরের জন্য খুবই বিষাক্ত।
এদিকে চা-শিল্পের সঙ্গে জড়িত চা শ্রমিকদের বিভিন্ন পদ খালি থাকলেও সে সব স্থানে অনেক কর্মক্ষম শ্রমিক থাকা সত্ত্বেও তাদের নিয়োগ দেয়ার কোন উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। চা চাষ এলাকা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও প্রায় দুই যুগ ধরে নতুন শ্রমিক নিয়োগ দান বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সূত্র মতে, দেশের ১৬৪ চা বাগানের মোট জনসংখ্যা সাড়ে ৬ লাখ। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৫ হাজার অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও বৃদ্ধ। এসব চা শ্রমিক জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার সঠিক দিক নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত।
অপরদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ চা বাগানগুলোর নিয়মিত পরিদর্শন না করার ফলে শ্রম আইন পুরোপুরি লঙ্ঘিত হচ্ছে। পদ মর্যাদার অবস্থান, বিভাগীয় লোকবল, অর্থ বরাদ্দ ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধার অভাব ইত্যাদি কারণে চা শ্রমিকগোষ্ঠীর কল্যাণে নিয়োজিত শ্রম পরিদর্শন বিভাগ কার্যকর ভূমিকা পালন না করায় শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজ করে তীব্র সন্তোষ। অপরদিকে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ মনে করেন, সংশ্লিষ্ট চা কোম্পানি, চা বাগান কর্তৃপক্ষ ও সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করলে চা উৎপাদনে তাদের নিরলস শ্রম আরও বৃদ্ধি পাবে।

No comments

Powered by Blogger.