আসামিদের পক্ষে বিদেশী আইনজীবী আনতে তৎপর জামায়াত- বার কাউন্সিল থেকে ফের ‘অনাপত্তিপত্র’ নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে by আরাফাত মুন্না

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক শীর্ষ জামায়াত নেতাদের পক্ষে মামলা লড়তে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তিন ব্রিটিশ আইনজীবী। তারা দেশের বাইরে থেকেই এ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ওই তিন ব্রিটিশ আইনজীবীর দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ীই সাক্ষীকে জেরা করছেন জামায়াতের পক্ষের


আইনজীবীরা। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়া শেষ হলে সেই জবানবন্দীর কপি দেয়া হয় আসামিপক্ষের আইনজীবীদের। সেই কপিই তাৎক্ষণিক ইংরেজীতে অনুবাদ করে ই-মেইলের মাধ্যমে ওই তিন ব্রিটিশ উপদেষ্টাকে পাঠানো হয় বলে একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছে। এদিকে, যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আটক শীর্ষ নেতাদের পক্ষে মামলা লড়তে বিদেশী আইনজীবী আনার চেষ্টা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। দু’দফা আবেদন নাকচের পর আবার নতুন করে বিদেশী আইনজীবী আনার বিষয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এ দলটি। এক্ষেত্রে তারা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল থেকে ‘অনাপত্তিপত্র’ নেয়ার চেষ্টা করছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আযম বা অন্য কারও পক্ষে খুব শীঘ্রই এ বিষয়ে বার কাউন্সিলে আবেদন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, বার কাউন্সিলের বিধিবিধান অনুমোদন না করলেও বর্তমান কমিটিতে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকদের পাল্লা ভারি হওয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই এবার সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে দলটি। সূত্রটি জনকণ্ঠকে আরও জানিয়েছে দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খ-ন করে নেতাদের নির্দোষ প্রমাণ চেয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণও এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম লক্ষ্য।
সূত্র মতে, মামলা পরিচালনায় জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবীদের সহায়তা দেয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তিন ব্রিটিশ আইনজীবীকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে জামায়াত। এরা হলেন স্টিভেন কে কিউসি, টবি ক্যাডম্যান ও জন ক্যামেগের। বর্তমানে আসামিপক্ষের আইনজীবী প্যানেলের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা এই তিন আইনজীবী জামায়াত নেতাদের হয়ে মামলা লড়তে সম্মতি দিয়েছেন। এদের মধ্যে স্টিফেন কে কিউসি আন্তর্জাতিক আদালতে সাবেক যুগোসøাভ প্রেসিডেন্ট সেøাবদান মিলোসেভিচের আইনজীবী ছিলেন। আর বসনিয়ায় যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত প্রসিকিউশনের আইনজীবী ছিলেন টবি ক্যাডম্যান। ওই ট্রাইব্যুনালে তিনি কিছুদিন আসামিপক্ষেও কাজ করেছেন। তিনি কয়েকবার বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা-সেমিনারে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন। আর সিয়েরালিওনে গৃহযুদ্ধের বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ আদালতে আসামিপক্ষের আইনজীবী ছিলেন জন ক্যামেগ। বার কাউন্সিল থেকে অনুমোদন বা অনাপত্তিপত্র পাওয়ার পরপরই এই আইনজীবীদের আনার প্রক্রিয়া শুরু করবে জামায়াতে ইসলামী।
একটি বিশ্বস্ত সূত্র জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে তাদের জবানবন্দী দেয়ার পর সেই জবানবন্দী তাৎক্ষণিক ইংরেজীতে অনুবাদ করে সহায়তাদানকারী ওই তিন ব্রিটিশ আইনজীবীদের কাছে ই-মেইল করে জামায়াতের পক্ষের আইনজীবীরা। পরে ফিরতি ই-মেইলে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এদিকে জামায়াত মনে করছে, ট্রাইব্যুনালে বিদেশী আইনজীবী আনতে পারলে মানবতাবিরোধী অপরাধের চলমান বিচার কার্যক্রমের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায় ও বিশ্ব পর্যবেক্ষকদের বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। তাছাড়া বিচারের প্রকৃতি নিয়ে এই আইনজীবীরা কথা বললে বিশ্ব মিডিয়ায় তার গুরুত্ব পাবে। মামলা পরিচালনায় লাভবান হওয়া এবং প্রসিকিউশনকে ‘কাবু’ করার বিষয়টি তো আছেই।
জানা গেছে, বার কাউন্সিলের বিধিমালায় এদেশে মামলা পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে বিধায় ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে বিদেশী আইনজীবীদের অংশ নেয়ার অনুমতি চেয়ে জামায়াতে ইসলামীর করা দুটি আবেদন ইতিপূর্বে খারিজ হয়েছে। এবার তাই বেশ বুঝেশুনেই এগোচ্ছে দলটি। ওই সময় ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, বার কাউন্সিল অনুমতি দিলে বিবেচনা করা হবে। জামায়াত নেতাদের আইনজীবী সূত্র বলছে, বার কাউন্সিল থেকে ‘বিশেষ অনাপত্তিপত্র’ পেলেই বিদেশী আইনজীবী আনা যাবে। তবে বিদেশী আইনজীবী আনার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বার কাউন্সিল এ্যাক্ট। ১৯৭২ সালের দ্য বাংলাদেশ লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স এ্যান্ড বার কাউন্সিল অর্ডার এ্যান্ড রুলসের ২৭(১) (এ) ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কোন আদালতে আইনজীবী হিসেবে মামলা লড়তে ওই ব্যক্তিকে এদেশের নাগরিক হতে হবে। এদিকে, গত ১৮ জুলাই অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবী প্যানেল বিজয়ী হয়। মূলত ওই নির্বাচনকে এসিড টেস্ট হিসেবে নেয় জামায়াতের নীতিনির্ধারক মহল। সে লক্ষ্যে নির্বাচনের সময় বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের পাশাপাশি জামায়াত সমর্থক আইনজীবীরাও সাধারণ আইনজীবীদের মধ্যে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রচারে অংশ নেন। নির্বাচনের আগে থেকেই সম্ভাব্য বিজয় মাথায় রেখে ট্রাইব্যুনালে বিদেশী আইনজীবী আনার বিষয়ে কার্যক্রম চালাতে শুরু করে দলটি। এ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত আইনজীবীদের জোট বিজয়ী হওয়ার পর গত ৪ আগস্ট সিনিয়র আইনজীবী এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর বেশ নড়েচড়ে বসেছে জামায়াতে ইসলামী।
তিন ব্রিটিশ আইনজীবী উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি স্বীকার করে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী এ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তিন ব্রিটিশ আইনজীবী আমাদের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। আমরা তাদেরই আমাদের পক্ষে মামলা লড়তে আনার চেষ্টা চালাচ্ছি। আমরা ওই আইনজীবীদের পক্ষে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে নিবন্ধন চাচ্ছি না। এটা হবে এক ধরনের ‘অনাপত্তিপত্র’। তাছাড়া ট্রাইব্যুনাল একটি বিশেষ আদালত। এখানে সাধারণ অনেক আইনই কার্যকর নয়। অভিজ্ঞতা ও ধারণা না থাকায় পূর্বের আবেদনে কিছু অসম্পূর্ণতা ছিল। তখন অনাপত্তিপত্রও চাওয়া হয়নি। এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার আমরা আবার চেষ্টা করব।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের আইনে কোন বিদেশী আইনজীবীর এদেশে এসে মামলা পরিচালনা করার কোন সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল একটা আইন করেছে যদি বার কাউন্সিল অনুমতি দেয় তাহলে বিদেশী আইনজীবীর বিষয়টি বিবেচনা করে দেখবে ট্রাইব্যুনাল। আমি মনে করি এ আইনটাও ঠিক হয়নি। তিনি আরও বলেন, বর্তমান আইনেই ট্রাইব্যুনালের অনুমতি সাপেক্ষে বিশেষ বিবেচনায় ট্রাইব্যুনালে বিদেশী আইনজীবীকে মামলা লড়ার ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের অনুমতি দেয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের অন্যতম সদস্য এ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান আইনে বার কাউন্সিলে কেউ কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বিদেশী আইনজীবীকে এ দেশের কোন আদালতে আইন ‘প্র্যাকটিস’ করার অনুমতি দিতে পারে না। অনাপত্তিপত্র দেয়ার বিধানও আইনে নেই। ট্রাইব্যুনালে সাক্ষীর দেয়া জবানবন্দীর কপি ইংরেজীতে অনুবাদ করে বিদেশী উপদেষ্টাদের পাঠানোকে তথ্য পাচার বলে আখ্যায়িত করে জেয়াদ আল মালুম বলেন, আমরা বিষয়টি অতি সম্প্রতি শুনেছি। তারা যদি ট্রাইব্যুনালে দেয়া সাক্ষীর জবানবন্দী অনুবাদ করে বিদেশে পাঠিয়ে থাকে তাহলে এটা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্টের ১১(৪) ধারা অনুযায়ী গর্হিত অপরাধ। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল সরল বিশ্বাসে তাদের সাক্ষীর জবানবন্দী দেয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই জবানবন্দী প্রিন্ট কপি দেয়, তারা যদি এ বিশ্বাসটাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ নেয় তাহলে এটা ঠিক হবে না।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, আমির মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলী কারাবন্দী রয়েছেন। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী কারাগারে এবং বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীম জামিনে রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.