ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণের গলদেই হলমার্ক কেলেঙ্কারি ॥ বারকাত- ‘চার হাজার কোটি টাকা চলে গেল ব্যাংকের এমডি জানলেন না তা হতে পারে না’

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ও জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ছয় শ’ কোটি টাকার ডিপোজিটের শাখায় চার হাজার কোটি টাকা চলে গেল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানলেন না তা হতে পারে না। ব্যাংকের প্রধান নিয়ন্ত্রকের গলদ আছে। গলদ আছে ব্যাংকটির আর্থিক শৃঙ্খলায়।


তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণে গলদ থাকার কারণেই হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০২১’ শীর্ষক তিন দিনব্যাপী সম্মেলন সামনে রেখে অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আগামীতে যাতে হলমার্কের মতো ঘটনা না ঘটে সে জন্য ব্যাংকিং খাতে কঠোর নজরদারি রাখা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, চার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি হয়ে গেল আর ব্যাংকের পরিচালকরা জানল না তা হতে পারে না। তারা না জানলে এটা তাদের অদক্ষতা। যদিও হলমার্কের ঋণই শুধু পরিচালনা পর্ষদে গেছে। আর কিছু পর্ষদের জানার কথা নয়।
অধ্যাপক বারকাত বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে ২৬ ব্যাংক জড়িত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছাড়াও তিন বিদেশী ব্যাংকসহ বেশকিছু বেসরকারী ব্যাংক জড়িত। অথচ শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে। সোনালী ব্যাংকের পর বলা হচ্ছে জনতা ব্যাংককেও নাকি ধরা হবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে তিন দিনের ‘বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০২১’ শীর্ষক সম্মেলন শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে চার অর্থনীতিবিদকে এবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি স্বর্ণপদক সম্মাননা ২০১২ দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে দ’ুজন পাচ্ছেন মরণোত্তর। তাঁরা হলেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আখলাকুর রহমান (মরণোত্তর) ও অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমদ (মরণোত্তর)। এ ছাড়া পাচ্ছেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম।
সম্মেলন আয়োজনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, অভিন্ন মুদ্রা ব্যবহারকরী ১৭ দেশকে নিয়ে গঠিত ইউরো অঞ্চল আবারও মন্দার মধ্যে প্রবেশ করছে। ফলে প্রধান এই রফতানি বাজারের অর্থনৈতিক মন্দায় বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ বাড়ছে। ইউরোপ হচ্ছে বাংলাদেশের রফতানির অন্যতম বড় বাজার। গত তিন বছর ধরে এই বাজারে আর্থিক মন্দা চলছে। ওই মন্দায় ইতোমধ্যে ইউরো অঞ্চলের দেশগুলো তাদের চাহিদার সঙ্কোচন ঘটিয়েছে। ফলে ফের নতুন করে মন্দা দেখা দিলে ওই দেশগুলোর চাহিদায় আরও সঙ্কোচন দেখা দেবে। ফলে তা বাংলাদেশের রফতানি আয়ের জন্য বড় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন, রফতানির একক বৃহত্তম বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও সুবিধাজনক নয়। মন্দা কাটিয়ে উঠলেও দেশটির অর্থনীতি গতি পাচ্ছে না। কাক্সিক্ষত হারে বাড়ছে না চাহিদা। ফলে এটাও বাংলাদেশের রফতানিকারকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, ব্রিকস জোটের দেশ ব্রাজিল, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত এক সময় প্রচ- গতিতে চললেও, এখন থমকে গেছে। দ্রুত উদীয়মান এ দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন কমে গেছে। ফলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রিকসের বাজার ধরার যে প্রচেষ্টা চলছে, তাও কঠিন হয়ে পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জনশক্তি রফতানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। লিবিয়া ও সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজারে পড়েছে। ফলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়েও টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে।
সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্ববাজারে বিভিন্ন কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের দামে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। খাদ্য পণ্যের দাম নিয়ে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ২০০৭-০৮ সালের মতো বিশ্ব নতুন করে আরেকটি খাদ্য সঙ্কটে পড়তে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। সেই তাগিদ থেকেই বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি তাদের অষ্টাদশ দ্বিবার্ষিক সম্মেলনকে সামনে রেখে ‘বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রূপকল্প-২০২১’ শীর্ষক একটি সেমিনারের আয়োজন করতে যাচ্ছে। তিন দিনের এই সেমিনার শুরু হবে আজ বৃহস্পতিবার। আর শেষ হবে শনিবার।
এ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকার রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তার অন্যতম পূর্বশর্ত ছিল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতি এখন বড় ধরণের টালমাটাল অবস্থায় চলছে। বিশেষ করে ইউরো সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব অর্থনীতির এই অস্থিরতা কিভাবে রূপকল্পের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে তা পর্যালোচনা করার জন্য এই প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ১০ বছর মেয়াদী প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। বর্তমানে এ পরিকল্পনার আওতায় বাজেট দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার ও নানামুখী পরিবর্তনের কারণে এই উন্নয়ন কৌশলও সমন্বয় করা প্রয়োজন। সম্মেলনে আলোচনা পর্যালোচনায় সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.