সাদাকালো-রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার by আহমদ রফিক

এমনিতেই বাংলাদেশ তার জনসংখ্যা বিস্ফোরণ নিয়ে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। মুখে যতই 'মানব সম্পদ', 'মানব সম্পদ' বলে চিৎকার করি না কেন; আমরা ভালোভাবেই জানি, জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য কতটা জরুরি। বিশ্বের সবচেয়ে ঘনসতিপূর্ণ বাংলাদেশের অনেক সমস্যার পেছনে রয়েছে জনসমস্যা।


ষাটের দশক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রচার ও প্রচেষ্টা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়। তাতে কিছুটা সাড়াও মেলে। তবে দুর্ভাগ্যজনক যে তা শিক্ষিত শ্রেণীতে, উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্য স্তরে তা যথারীতি পূর্বাবস্থায়। এবং এখনো সেই ট্র্যাডিশন চলছে। যে কারণে হোক, জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে ভাটা পড়েছে অনেক দিন থেকে।
ওপরের কথাগুলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো এবং রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সম্বন্ধে অপ্রাসঙ্গিক শোনালেও বাস্তবে তা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ যেখানে নিজেই বহু সমস্যায় ভুগছে এবং বিশেষভাবে অর্থনৈতিক সমস্যা তো বটেই, সে ক্ষেত্রে তার কাঁধে নতুন করে সমস্যা চাপিয়ে দেওয়া যুক্তিসংগত নয়। কিছুদিন আগে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত বৌদ্ধ-মুসলমান সাম্প্রদায়িক সংঘাত আমাদের অবাক করে দিয়েছে।
কারণ এ উপলক্ষে নতুন করে শুরু হয় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়া। তখন বাংলাদেশ তাতে সাড়া দেয়নি বলে কেউ কেউ এটাকে মানবিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়ার নীতির জন্য বাংলাদেশ সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু আমরা এর আগে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। এখন তারা এখানে প্রায় স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের বাসিন্দায় পরিণত।
মনে পড়ছে, দু-একজন লেখক একাত্তরের বাঙালি শরণার্থীদের উদাহরণ টেনে শরণার্থীদের ঢুকতে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন। কিন্তু একটি কথা তো সত্য যে একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতার মুখে উদ্বাস্তু বাঙালি শরণার্থীরা ঠিকই যুদ্ধশেষে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু ফিরে যাননি কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। আমাদের দিক থেকেও বিষয়টা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো হয়নি, যাতে শরণার্থীরা আপন দেশে ফিরে যেতে পারেন।
মনে হয়, এসব দিক থেকে আমাদের পররাষ্ট্র তৎপরতা খুব একটা সবল নয়। সবল যে নয় তার আরেকটি প্রমাণ একাত্তর-পরবর্তী তথাকথিত 'বিহারি' ইস্যু। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় 'জেনিভা ক্যাম্পে' মানবেতর জীবনযাপনরত বিহারিদের অনেক চিৎকার সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার যেমন তাদের ফেরত নিতে গা করেনি, তেমনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সুষ্ঠু কূটনৈতিক তৎপরতা চালানো হয়নি, যাতে পাকিস্তান বাধ্য হয় তাদের নাগরিকদের ফেরত নিতে।
স্বঘোষিত ওইসব অবাঙালি পাকিস্তানি নাগরিক যুক্তিসংগতভাবেই পাকিস্তানি। তারা নিজেরাই তাদের পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে দাবি করে পাকিস্তানে তাদের পুনর্বাসন দাবি করেছে। এমনকি এ নিয়ে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনবসতির হার বাংলাদেশ থেকে কম হওয়া সত্ত্বেও ওই পাকিস্তানি নাগরিকদের পাকিস্তান ফেরত নেয়নি।
এভাবেই ৪০ বছর কেটে গেছে। বাংলাদেশও কেন জানি বিষয়টাকে মাথা থেকে প্রায় ঝেড়েই ফেলেছে। ওই পাকিস্তানি বিহারিদের নতুন প্রজন্ম অনেকে আর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে না। তবে বয়স্ক অনেকে এখনো পাকিস্তানে ফিরে যেতে ইচ্ছুক। কারণ সাতচল্লিশ-উত্তর সময়ের মতো এরা এখনো বাংলাদেশের মূল স্রোতের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি। আসলে বিষয়টার ফয়সালা হওয়া উচিত ছিল বাহাত্তর সালেই। পাকিস্তানে আটকেপড়া বাঙালিদের ফেরত আনা এবং ৯০ হাজার পরাজিত পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে পাকিস্তানে যেতে দেওয়ার সঙ্গে 'বিহারি' ইস্যুটাকে যুক্ত করা দরকার ছিল। পাকিস্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য এবং অমীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা নতুন করে চালানো উচিত এবং সেই সঙ্গে 'বিহারি' ফেরত পাঠানোর ইস্যুটাকে পুনরুজ্জীবিত করা দরকার।
রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বক্তব্যে অন্য বিষয়ে তিন কাহন বলা হয়ে গেলেও বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বহীন নয়। এমনি একাধিক বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক তৎপরতার ঢিলেঢালা ভাব আমাদের কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে না। পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক দরবারের শরণাপন্ন হতে পারত; কিন্তু তা করা হয়নি। এমনকি পারত চট্টগ্রাম সীমান্তে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়েও।
কারণ ওই রোহিঙ্গা শিবিরগুলো অনেক দিন ধরে হয়ে উঠেছে বিজাতীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের আখড়া। অনেক অসামাজিক কাজ থেকে আন্তর্ঘাতমূলক কাজেও তাদের ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এক ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাঝেমধ্যে সেসব বিষয় খবরের কাগজে বিশেষ সংবাদ হয়ে উঠতেও দেখা গেছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের টনক নড়েনি।
মিয়ানমার এখন তো আর ছকবদ্ধ রাষ্ট্র নয়। সামরিক জান্তার শাসন অব্যাহত থাকলেও সেখানকার রুদ্ধ দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে মূলত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কল্যাণে। এখন মার্কিন কূটনৈতিক তৎপরতা ভালোভাবেই চলছে মিয়ানমারের সঙ্গে। গণতন্ত্রের মানসপুত্রী সুচি এখন আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে রাখাইন রাজ্যের সংঘটিত দাঙ্গা ও উদ্বাস্তুদের নিয়ে তাঁকে তেমন সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না।
তা সত্ত্বেও দরকার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জোরদার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তুলে ধরা। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। এ বিষয়টি নিয়ে এক খণ্ড কালো মেঘ কিন্তু যথেষ্ট স্পষ্ট এবং তা যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়ে প্রকাশ পেতে যাচ্ছে বলে মনে হয়। না হলে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এত মাথাব্যথা কেন? কেন তাঁর বিশেষ তৎপরতা, যা কূটনৈতিক বিধিবিধানবহির্ভূত?
কয়েক দিন আগে কাগজে ছোট্ট একটি খবর- কিন্তু সব দিক বিচারে খবর ছোট হলেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ- আর সে জন্যই এই নিবন্ধ লেখা। খবরে বলা হয়েছে, 'রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও আলোচনা'র জন্য 'একসঙ্গে ঢাকায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের চার মন্ত্রী'। বিষয়টা কি তাঁদের জন্য এতই জরুরি? কী জন্য জরুরি? এটা কি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক আলোচ্য বিষয় নয়? তাহলে এটাকে কি 'আন্তর্জাতিক ইস্যু' তৈরি করার চেষ্টা চলছে না কি এসব তৎপরতার পেছনে রয়েছে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
দেখা যাচ্ছে, এর সঙ্গে ঢাকায় জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক কার্যালয়ও যুক্ত হয়ে পড়েছে। বিষয়টা এখনো যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। এ বিষয়ে মার্কিনি ভূমিকা স্পষ্ট নয়। কিন্তু যতটা দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক বলেও মনে হচ্ছে না। কারণ মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হোক। কিন্তু তা কেন? ওয়াশিংটনই তো গণতান্ত্রিক ও মানবিক নিয়মাদি মেনে নিয়ে মিয়ানমারের নাগরিকদের তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
কিন্তু তারা তা করছে না। উল্টো বাংলাদেশকে অনুরোধ করছে, যাতে তারা বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী শরণার্থীদের তাদের স্বদেশে ফেরত না পাঠায়। এর কারণ কি মিয়ানমারকে কিছুটা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিয়ে অন্য কিছু আদায়? মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নানাভাবে বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওদের সঙ্গে জঙ্গি যোগাযোগের বিষয় নিয়ে আগেই বলা হয়েছে। অনেক লেখালেখিও হয়েছে এ বিষয়ে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের নিয়ে অবাঞ্ছিত কার্যক্রম চলানোর অভিযোগে কয়েকটি এনজিও কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার, তাতেও বোঝা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস্তবিক বাংলাদেশের জন্য একটি রাজনৈতিক সমস্যা। এর কূটনৈতিক সমাধান জরুরি। যুক্তরাষ্ট্রের উচিত, যদি এ বিষয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট হতেই হয়, তাহলে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে বাংলাদেশকে সমর্থন জানানো। তবে আমাদের প্রশ্ন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট হতে ওয়াশিংটনের এত আগ্রহ কেন।
আর 'রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে রাখতে হবে'- এটাই বা জিং সং-এর কেমনতর আবদার। ওয়াশিংটন সু চির জন্য মিয়ানমার শাসকদের এত চাপ দিতে পেরেছে আর এটুকু পারে না, যাতে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অনাচার বন্ধ হয়? বার্মিজ জান্তা তো এ পর্যন্ত কঠোর হাতে সু চির গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন করে এসেছে। রাখাইন রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা তাদের জন্য মোটেই কঠিন কাজ নয়। আসলে তাদের পক্ষে সদিচ্ছার অভাব। তাই তারা এত দিনেও তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ঘরে ফেরানোর উদ্যোগ নিচ্ছে না।
দিন কয়েক আগে একটি দৈনিকে ড. ফেরদৌস আহমদ কোরেশী 'রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থান যুক্তিসংগত নয়' শীর্ষক একটি তথ্যনির্ভর ও যুক্তিসংগত দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন। তাতে অবশেষে বক্তব্য : 'আন্তর্জাতিক রীতি এবং সীমান্ত অঞ্চলের এপার-ওপারে জনমিতিগত সাযুজ্যের বিষয়টি খোলামনে মেনে নিয়ে মিয়ানমার সরকারের উচিত হবে- রোহিঙ্গা মুসলিমদের ন্যায়সংগত নাগরিক অধিকার নিশ্চিত এবং রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সহাবস্থানের ক্ষেত্র তৈরি করা। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই তাদের সেখানে থাকতে হবে।'
এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দরকার মিয়ানমারের সঙ্গে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের স্বদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া। এতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাই বোধ হয় যথেষ্ট। পরাশক্তিকে এতে সংশ্লিষ্ট হতে না দেওয়াই ভালো। আর সেই সঙ্গে দরকার পাকিস্তানের সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করা, যাতে পাকিস্তানে গমনেচ্ছু পাকিস্তানি বিহারিদের ফেরত পাঠানো যায়।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.