'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' by ওয়াহিদ নবি

অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য সংবাদমাধ্যমে পড়ে ও দেখে অনর্থক বলে উপসংহারে পৌঁছানোর আগে ভাবলাম, সম্পূর্ণ খবরটা পড়ে নেওয়া উচিত। হাজার হলেও সবাই বলে, সংবাদমাধ্যম সংবাদকে উত্তেজনাকর করে তুলতে ভালোবাসে। এ জন্য এটা স্বাভাবিক যে তারা উত্তেজনাকর হেডলাইন পছন্দ করে।


সংবাদটি বিস্তারিত পড়ে মনে হলো, অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের উপহার দিয়েছেন একটা মুখরোচক শিরোনাম। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, প্রতিবছর সরকার ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়, এর মধ্যে চার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম হয়েছে। ৪০ হাজার কোটির জায়গায় চার হাজার কোটি টাকা এমন কিছু নয়, এটাই তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। তিনি আবার সংবাদমাধ্যমকে দোষারোপ করেছেন উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য। এমন ভাষাবিভ্রাট রাষ্ট্রের একজন অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কাছে আশা করা যায় না। জাভাডি বারবু তাঁর 'ডেমোক্রেসি ও ডিকটেটরশিপ' বইতে রাজনীতিবিদদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে।
আমরা সাধারণ মানুষ (কবিগুরুর ভাষায় 'পনেরো আনা'রা) এক কোটি সংখ্যায় লিখতে হিমশিম খেয়ে যাই। ৪০ হাজার কোটি টাকা আমাদের কাছে প্রায় একটা কাল্পনিক সংখ্যা। দেশের মেধাবীরা অর্থনীতি অধ্যয়ন করেন। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা সংবাদমাধ্যমে এসে নানা রকমের নসিহত বিতরণ করেন। আমাদের তেমন একটা লাভ হয় বলে মনে হয় না, কারণ এই কঠিন ব্যাপারস্যাপার আমাদের মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। বাংলাদেশের জন্মের সময় একজন সরকারি জুনিয়র চিকিৎসক (এবং সমকক্ষরা) যে বেতন পেতেন, এখন তার ৫০ গুণ বেতন পান। সংসারের খরচ সম্ভবত ৫০ গুণের বেশি বেড়ে গেছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চোখে যেটা পড়ে তা হচ্ছে তুলনামূলকভাবে অপেক্ষাকৃত কম উপার্জন করেও এখন অনেকের গাড়ি, বাড়ি, সন্তানদের প্রাইভেট পড়া, হজ ইত্যাদি হয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক বছরে অনেকে সামান্য অবস্থা থেকে অসামান্য অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আমরা এসব বুঝি না বলেই আমরা সাধারণ। অর্থনীতিবিদরা নিশ্চয়ই এসব বোঝেন। আর সে জন্যই বোধ হয় চার হাজার কোটি টাকা অর্থমন্ত্রীর কাছে সামান্য টাকা বলে মনে হয়।
পত্রিকায় পড়লাম, ছাত্রদলের কমিটি গঠিত হয়েছে বিএনপি কার্যালয়ে মিটিং হওয়ার পরে এবং বিএনপির নেত্রীর বাসায়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক 'নির্বাচিত' হয়েছেন প্রায় ৪৫ বছর বয়স্করা। তাঁরা নাকি নিয়মিত ছাত্র নন। অনিয়মিত ছাত্র কি না তা স্পষ্ট করে সংবাদমাধ্যমে বর্ণিত হয়নি। সাধারণ সম্পাদক নাকি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেছেন। তাঁর সন্তানরা নাকি নবম ও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। নির্বাচিত সভাপতি নাকি ছাত্রদল কার্যালয়ে ভাঙচুর করার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক 'বহিরাগত' বলে বিবেচিত হয়েছিলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে নাকি মামলা করা হয়েছিল। তাঁদের দুজনের এবং নির্বাচিত অন্য কর্মকর্তাদের গুণাগুণ সবিস্তারে বর্ণনা করার ইচ্ছা আমাদের নেই। তাঁরা যদি ছাত্রদলের সদস্য-সদস্যাদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন, আমরা কিছু না বলেই তা মেনে নিতাম। ছাত্রদলের নেতারা অছাত্রদের দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত হলেন। তাঁরা আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগের নেতাদের বয়সসীমা ২৯ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক বলেছেন, ছাত্রলীগের ছাত্র-বয়ঃকনিষ্ঠরা ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। কথাটার মধ্যে এক ধরনের যুক্তি আছে বৈকি।
র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন পত্রিকা মারফত জানিয়েছে, বিএনপির ডাক্তার সংগঠন ড্যাবের ভেতর অন্তর্কলহের ফলে সেই সংগঠনের একটি উপদল কয়েকজন নেতাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। গোপন সূত্রে জানতে পেরে সম্ভাব্য কয়েকজন হত্যাকারী ও হত্যার পরিকল্পনাকারীকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করেছে। এরপর ড্যাবের একটি সভায় কয়েকজন নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। র‌্যাবের এই গ্রেপ্তারকে কেউ ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেনি এখন পর্যন্ত। র‌্যাবের এ কাজকে ড্যাব বা বিএনপির পক্ষ থকে অসদুদ্দেশ্যমূলক বলেও বর্ণনা করা হয়নি। নেতাদের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার হওয়া একজন নেতার কার্যকলাপকে আধিপত্য বিস্তারের প্রয়াস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। একজন বলেছেন, দুই উপদলের ভেতর কিছু বাগ্বিতণ্ডা হয়েছিল; কিন্তু তার পরিণতিতে এমন ভয়াবহ ঘটনা ঘটবে এমনটা কেউ ভাবেনি। ডাক্তারদের সংগঠনে আধিপত্যকে কেন্দ্র করে হত্যার পরিকল্পনা করা হবে- এমনটা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। আমাদের রাজনীতি ও সমাজ কোথায় চলেছে- এ ঘটনা তার ইঙ্গিত বহন করে।
যোগাযোগমন্ত্রী জনগণের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁর এবং নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর চেষ্টায় ঈদের সময় মানুষ কম ভুগেছে বলে পত্রপত্রিকায় লিখেছে। দেখা যচ্ছে, যে কেউ ভালো কিছু করলে তার স্বীকৃতি মেলে। মতিয়া চৌধুরী ও নাহিদ সাহেবকে সবাই ভালো বলেন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, "রেলের ছয় হাজার একর জমি অন্য লোকজন দখল করে আছে। শুধু পাকশীতেই ২০০ একর জমি জবরদখলে আছে। আমরা 'মগের মুলুক' নামের এক কাল্পনিক দেশের কথা শুনেছিলাম। মনে হয়, এখন বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি। এসব জমির দাম কত হবে আমরা জানি না। আমরা এটাও জানি না, কোথায় কতটুকু জমি জবরদখল হয়ে আছে। কারা এই জবরদখলকারী তা আমরা জানি না।" কাদের সাহেব যদি এ কথা না বলতেন, তবে তাঁকে এ সম্পর্কে কেউ কছু বলতেন না। কিন্তু বলে ফেলে নিজের জন্য তিনি সমস্যা ডেকে নিয়ে এসেছেন। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কেউ যদি কিছু না করে তবে ঠিক আছে। কিন্তু কেউ কিছু করার চেষ্টা করলে তখন 'এটা করা ঠিক হয়নি', 'এভাবে করা উচিত হয়নি' ইত্যাদি কথা শুরু হয়ে যায়। যোগাযোগমন্ত্রীর এখন উচিত হবে দখল করা জমি চিহ্নিত করা। কারা এসব জমি দখল করেছেন তাঁদের খুঁজে বের করা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্যই ক্ষমতাধর ব্যক্তি হবেন। শুনেছি, খোদ ঢাকায়ই একজন সাবেক মন্ত্রী দখল করা রেলের জমিতে বাড়ি তৈরি করেছেন। তাঁর উচিত হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যে এ জমির কী করা হবে। কাদের সাহেব বলেছেন, এ জমির টাকা দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে এই সেতু নির্মাণে। জমির দাম নির্ধারিত হলে তবে আমরা জানতে পারব, সেতু নির্মাণ করা সম্ভব কি না এ টাকায়। অর্থমন্ত্রী যেখানে চার হাজার কোটি টাকাকে সামান্য বলে বর্ণনা করেন, সেখানে 'মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকার' বিশ্বব্যাংকের এত লম্ফঝম্প সরকার দেখছে কেন?
বিভিন্ন পেশায়ও রাজনীতি চরম আকার ধারণ করেছে বলে মনে হয়। পেশাগত আচার-আচরণ উগ্র রাজনীতির দ্বারা কলুষিত হচ্ছে। উগ্রতা সাধারণ সভ্যতা-ভব্যতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে আইনজ্ঞদের ব্যবহার কী আমরা আগে দেখতাম। শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকদের আচরণ দেখে ছাত্রদের আচরণ সম্পর্কে কোনো আলোচনা করা যায় কি? রাজনৈতিক নেতার পুলিশ কর্মচারীর প্রতি গালাগালি এবং পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক নেতাদের লাঠিপেটা সভ্য দেশে ঘটা উচিত কি?
রাস্তায় যানজট, বেপরোয়া গাড়ি চালানো, ভেজালের আধিক্য, নারী নির্যাতন, সামান্য কারণে মারামারি, এমনকি হত্যা (মুড়ি খাওয়া নিয়ে)- এসব তো সরকার ঘটাচ্ছে না। আমরা 'পনেরো আনা'র দল সরকারকে সব কিছুর জন্য দায়ী করি। আমাদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? আমাদের লোকসংখ্যা প্রচুর হলেও দেশটি আয়তনে ছোট। এখানে যারা এসিড নিক্ষেপ করে তারা সমাজে পরিচিত। অন্যান্য অপরাধ যারা করে, তাদের প্রায় সবাই সমাজে পরিচিত। সমাজের কি করার কিছু নেই? সমাজ আজ এত অসহায় কেন? টাকা নিয়ে ভোট বিক্রি করার দায়ভার নিতে হবে সমাজকে। কবি শামসুর রাহমান অনেক দুঃখে লিখেছিলেন- 'উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ।' এই অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার আমরাও।
লেখক : ফেলো, রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রি, লন্ডন

No comments

Powered by Blogger.