প্রকৃতির অপূর্ব নিদর্শন অবাক করা শালবন আলতাদীঘি- নওগাঁয় নয়নাভিরাম নিসর্গ হতে পারে পর্যটন কেন্দ্র by বিশ্বজিৎ মনি

নওগাঁ শহর থেকে মাত্র ৬৩ কিলোমিটার পথ পেরুলেই ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা ধামইরহাট উপজেলার নয়নাভিরাম শালবন আর প্রকৃতিকন্যা আলতাদীঘি দেখা যাবে। পথে পড়বে মহাদেবপুর ও পতœীতলা উপজেলা সদর। তারপর জেলার সীমান্তবর্তী ধামইরহাট উপজেলা সদর।


ধামইরহাট উপজেলা থেকে ৬ কিলোমিটারের কাঁচা লাল মাটির রাঙ্গা পথ। দূর থেকেই নজরে পড়বে শালবনটি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গত ১৪-১২-১১ তারিখের জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে এটিকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। অত্যন্ত সুন্দর ও মোহনীয় প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে দর্শক ও পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ে এই জাতীয় উদ্যান এলাকা। প্রকৃতিপ্রেমী বনের দিকে যতই এগিয়ে যাবেন ততই সৃষ্টি হবে রোমাঞ্চকর অনুভূতি। পথের ধারে ছোট-ছোট বসতবাড়ি। সেখানে আদিবাসীদের বসবাস। ঠাঠা বরেন্দ্র ভূমির চারদিকে শুধু উঁচু-উঁচু শালগাছ। ভারত সীমান্তঘেঁষা এই বন আর দীঘি। প্রায় তিন শ’ একরের বনভূমি সরকারের রিজার্ভ ল্যান্ড ফরেস্ট আর এক শ’ একরের দীঘি। প্রাকৃতিক এই বনভূমির মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতা। নওগাঁর বরেন্দ্রভূমি ধামইরহাট উপজেলার মইশর মৌজার বিশাল শালবনটি অবাক করার মতো।
মেঠো ও বুনোপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই দেখা মিলবে শালবনের মাঝে বিশাল টলটলে জলের আলতাদীঘি। দীঘির চারপাশে শালবন আর ঝোপঝাড়। এই প্রাকৃতিক বনভূমি আর দীঘি দেখতে এবং পিকনিক করতে প্রতিদিনই আসে প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতি এখানে নিজ হাতে সবকিছু সাজিয়ে দিয়েছে। দীঘির টলটলে জলের মাঝে ছোটাছুটি করতে দেখা মিলবে লাল রঙের বড়-বড় কার্প ও নানা প্রজাতির রুপালি মাছ। দীঘির মিষ্টি শীতল পানিতে হাত-মুখ ধুয়ে ক্লান্তি দূর করেন পর্যটকরা। শালবনের মাঝে জায়গা করে নিয়ে ছোট-বড় ঢিবি গড়ে তুলেছে উইপোকা। লাল রঙের ওই ঢিবিগুলো প্রবল বর্ষণেও নষ্ট হয় না। উইপোকারা নির্বিঘেœ তাদের কর্মকা- চালিয়ে যায় বর্ষা মৌসুমেও। শাল গাছকে জড়িয়ে উঠে গেছে হিংলোলতা, গুরঞ্চলতা, অনন্তমূল, ঝারিশত, বনবড়ইসহ নানা লতাগুল্ম আর বনফুল। মাঝে-মাঝে আছে ঘন বেতবন। বেত গাছের সবুজ চকচকে চিকন পাতায় চোখ জুড়িয়ে আসে। এই বনে আছে সাপ, শিয়াল, খরগোশ, বাঘডাশা, বনবিড়াল, বনরুই, বেজি, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আর পাখি। এলাকার আদিবাসী নারী-পুরুষ সারাবছরই বনের ভেতর থেকে জ্বালানির জন্য মরা কাঠ সংগ্রহ করে। পথ যেখানে শেষ সেখানেই ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। কাছাকাছি সীমান্ত পিলার। বেড়ার ওপারে দেখা যায় ভারতীয়দের কৃষিকর্ম আর বিএসএফ-এর টহল। ধামইরহাট বনবিট কর্মকর্তা লক্ষ্মণ চন্দ্র ভৌমিক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শালবনে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সহযোগিতার জন্য ৩০ জন জনবল নিয়োগ দেয়া আছে। বর্তমানে এটি পর্যটন কেন্দ্র না হলেও প্রতিদিনই মুখরিত হয় বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা দর্শনার্থীদের পদচারনায়।’
নওগাঁ জেলা প্রশাসক ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানম বলেন, ‘শালবন ও আলতাদীঘিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। এটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের দ্রুত আকৃষ্ট করবে। পাশাপাশি দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে একটি বড় ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শালবন ও আলতাদীঘি ছাড়াও নওগাঁয় যেসব দর্শনীয় স্থান রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আত্রাই উপজেলার পতিসরে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারি কাছারিবাড়ি, বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, পতœীতলা উপজেলার দীবরদীঘি, সাপাহার উপজেলার জবইবিল, মান্দা উপজেলার কুসুম্বা মসজিদ, সদর উপজেলার দুবলহাটী ও বলিহার রাজবাড়ি। এছাড়া নওগাঁ শহরেও মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ানো ও বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি আধুনিক উদ্যান।’ জেলার প্রবেশ দ্বারেই প্রধান শহর। শহরে রয়েছে থাকা ও খাওয়ার সু-ব্যবস্থা। রাতযাপনের জন্য সার্কিট হাউস ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলোর পাশাপাশি বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি আবাসিক হোটেল রয়েছে। আবাসিক হোটেলগুলোর কাছাকাছি রয়েছে একাধিক খাবার হোটেল, রেস্তরাঁ ও মিনি চাইনিজ রেস্তরাঁ।
প্রকৃতির বনভূমি শালবন ও আলতাদীঘিতে কোন বিশ্রামাগার না থাকলেও বনের উত্তর ধারে অনেকটা ফাঁকা জায়গা আছে। যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁরা ওই ফাঁকা জায়গায় বসে নির্মল বাতাসে আরাম করেন। অনেকে সেখানে রান্না করেও খাবারের পর্ব সারেন। শালবনে গেলে চোখে পড়বে চারদিকে নিঝুম স্তব্ধ বন। দু’চোখে শুধুই সবুজ আর সবুজ। কানে আসবে জানা-অজানা পাখির কিচিরমিচির। নওগাঁর এই প্রকৃতিরাজ্যে যাঁরা আসবেন তাঁদের হৃদয়-মন ভরে উঠবে প্রকৃতির অকৃত্রিম ভালবাসায়।

No comments

Powered by Blogger.