বাগান সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়ানো হলে জৌলুস ফিরবে- চা শিল্পে সঙ্কট শেষ by রহিম শেখ

গুণগতমানের কারণে চা আমদানিকারক দেশগুলোর পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশী চায়ের স্থান ছিল অনেক ওপরে। কিন্তু চায়ের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে আশঙ্কাজনকহারে কমে গেছে রফতানিবাণিজ্য। চায়ের উৎপাদন ও রফতানিতে শীর্ষ দশে নেই বাংলাদেশের নাম।


সূত্র মতে, চায়ের উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান পনেরোতম হলেও রফতানিতে কোন অবস্থানে নেই। এই অবস্থায় চা শিল্পের উন্নয়ন করতে হলে সরকারের সঠিকভাবে মনিটরিং প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে চা বাগানের সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়ানো হলে আগের জৌলুস ফিরে পেতে পারে এই শিল্পটি।
জানা গেছে, গুণগতমানের কারণে চা আমদানিকারক দেশগুলোর পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশী চায়ের স্থান ছিল অনেক ওপরে। সেই সুবাদে বাংলাদেশ এ খাত থেকে বছরে গড়ে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা পযন্ত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশের উৎপাদিত চা চীন, ভারত, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হতো। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে জাতীয় অর্থনীতিতে চায়ের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও এখন আর সেই অবস্থা নেই। অধিকাংশ বাগানে চা-চারার পরিবর্তে রাবার চাষ করা হচ্ছে। এছাড়া বাঁশ, বন, শণ, শস্য চাষ করার পাশাপাশি কিছু জমি রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। সম্প্রতি চা-বাগান থেকে অবাধে শেড ট্রি উজাড়, ব্যাপক হারে কাঁচা চা পাতা, সার ও কীটনাশক পাচার হওয়ার পাশাপাশি চা-শিল্পের মূল চালিকাশক্তি চা শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজিত ক্ষোভ-বিক্ষোভও উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে গত দশ বছরে চায়ের মাথাপিছু চাহিদা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে মাথাপিছু চায়ের চাহিদা ছিল ২৩০ গ্রাম, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪০ গ্রাম। চায়ের রফতানি কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে চায়ের ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যাওয়া। দেশী বাজারে চায়ের দাম বেশি হওয়ায় গত বছর এমএম ইস্পাহানি, আবুল খায়ের গ্রুপসহ কয়েকটি কোম্পানিকে চা আমদানি করতে হয়েছে। গত মৌসুমে বিদেশ থেকে ৩০ লাখ কেজি চা আমদানি করা হয়েছিল এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাসে ৫০ লাখ কেজি চা আমদানি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চা উৎপাদন মৌসুমে দেশে ৫ কোটি ৯১ লাখ ৭০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৯ সালে দেশে মোট চা উৎপাদিত হয়েছিল ৫ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার কেজি। উৎপাদন সারণি থেকে দেখা যায়, ১ বছরে দেশে চায়ের উৎপাদন কমেছে ৮ লাখ ২০ হাজার কেজি। ফলে একদিকে যেমন দেশের নাম চা রফতানিকারক দেশের তালিকা থেকে মুছে যাচ্ছে অন্যদিকে আমদানিকারক দেশের তালিকায় নাম লেখাতে যাচ্ছে।
চা শিল্পের সঙ্কট নিয়ে শ্রীমঙ্গলের চা পাতা ব্যবসায়ী, অকশনার ও প্যাকেটিয়ার গুপ্ত টি হাউসের স্বত্বাধিকারী পীযূষ কান্তি দাশগুপ্ত জনকণ্ঠকে জানান, চা শিল্পের উন্নয়ন করতে হলে সরকারকে সঠিকভাবে মনিটরিং করতে হবে। কিন্তু সরকার চা শিল্পের উন্নয়নের কথা বলে ব্যবসায়ীদের ওপর অতিরিক্ত কর চাপিয়ে দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। এতে দেশী চা থেকে ব্যবসায়ীরা মুখ ফিরিয়ে নেবে।
চায়ের আন্তর্জাতিক নিলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত পূর্ববাংলা টি ব্রোকার্সের ব্যবস্থাপক আরিফুর রহমান শাহীন জানান, একসময় বাংলাদেশের চায়ের বড় ক্রেতা ছিল পাকিস্তান। তাছাড়া আফগানিস্তান, সিআইএসভুক্ত দেশ তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ বাংলাদেশ থেকে চা ক্রয় বা আমদানি করে থাকে। এখন পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশ উচ্চমূল্যের কারণে বাংলাদেশ থেকে চা আমদানিতে বিরত রয়েছে। আরিফুর রহমান শাহীন জানান, বাংলাদেশে মাঝারি ভাল মানের চায়ের নিলাম মূল্য প্রতিকেজি ১৪৫ দশমিক ৬৩ টাকা। ভ্যাট ও বিক্রয় কর যুক্ত হয়ে মূল্য আবারও কিছুটা বাড়ে। চা ব্যবসায়ী ও নিলামকারীরা জানান, চলতি মৌসুমে গত ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত চায়ের ২০টি আন্তর্জাতিক নিলামের একটিতেও কোন বিদেশী ক্রেতা বা তাদের প্রতিনিধি অংশ নেননি। নিলামের সব চা স্থানীয় ক্রেতারাই প্রতিযোগিতামূলক দরে কিনে নিচ্ছেন। তাঁরা বলেন, দেশীয় বাজারে চায়ের চাহিদা গত দশ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু সে অনুযায়ী দেশে চা বাগানের সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বাড়েনি। অন্যদিকে বাড়ছে স্থানীয় ভোগান্তি। এ কারণে বিদেশে চা রফতানির পরিমাণও ঠেকেছে তলানিতে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৪৫টি দেশে চা উৎপন্ন হয় বাণিজ্যিকভাবে। তবে অনেক দেশই চা উৎপাদন করে মূলত দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য। চীন ও ভারত চা উৎপাদনে শীর্ষে থাকা সত্ত্বেও রফতানিতে শীর্ষে নেই। কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ চাহিদা অনেক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, চা উৎপাদনে শীর্ষে রয়েছে এশিয়ার দেশগুলো। এর পরই রয়েছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো। ২০১০ সালের হিসাবে চা উৎপাদনে শীর্ষ রয়েছে চীন এবং দশম অবস্থানে রয়েছে ইরান। বাংলাদেশ চা উৎপাদনে শীর্ষ পনেরোর স্থানে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের দেয়া তথ্য মতে, ২০১০ সালে মোট ৬০,৬৪৪ টন চা উৎপাদন হয়েছিল। বিশ্বের মোট চাহিদার মাত্র ১ ভাগ চা উৎপাদন বাংলাদেশে হয়।
সূত্র মতে, চা রফতানিতে দীর্ঘদিন শীর্ষ অবস্থানে থাকা শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলে কেনিয়া এখন শীর্ষে অবস্থান করছে। চা রফতানির ১৯ ভাগ আসে শ্রীলঙ্কা থেকে। অপরদিকে কেনিয়া এককভাবে মোট রফতানির ২৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। কেনিয়া টি বোর্ডের তথ্যানুসারে, এই রফতানির সিংহ ভাগই যায় আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, মিসর, সুদান, লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। কেনিয়ার সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় এই চা শিল্প থেকে। বাংলাদেশ চা রফতানিতে এখন কোন অবস্থানে নেই, কারণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে এ দেশে। শ্রীলঙ্কা থেকে গেল বছর চা রফতানি হয়েছে মাত্র ৬ মিলিয়ন টন। শ্রীলঙ্কার শতকরা ৯০ ভাগ চা-ই নিজস্ব চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। আর মাত্র ১০ ভাগ রফতানি হয় পাকিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে।

No comments

Powered by Blogger.