পাবলিক ভার্সিটি অস্থির করার চেষ্টা ভিসিদের সতর্ক থাকতে হবে- বৈঠকে নির্দেশ শিক্ষামন্ত্রীর ॥ মৌলবাদীদের কৌশল ও ছাত্র সংগঠনের মধ্যে সংঘাতে উদ্বিগ্ন সরকার

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদীদের উত্থান এবং ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের সংঘাতে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন সরকার। নানা কৌশলে অস্থিরতা সৃষ্টির আর চেষ্টা হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে তাই উপাচার্যদের সর্বদা সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।


একই সঙ্গে তিনি যে কোন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এড়াতে বিশ্ব¦বিদ্যালয় আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে উপাচার্য ও সিন্ডিকেটকে নির্দেশ দিয়েছেন। বুয়েট, জাহাঙ্গীনগর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চ শিক্ষাঙ্গনের সম্প্রতি অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে বুধবার মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত জরুরী বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, অস্থিতিশীল পরিবেশ যেন সৃষ্টি না হয় সেজন্য সর্বদা সতর্ক থাকুন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইন ও নীতি অনুসরণ করে পরিচালনা করুন। দায়বদ্ধতার বিষয়টি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, জনগণের টাকায় ছাত্ররা লেখাপড়া করে। যারা এই টাকার যোগান দিচ্ছেন সেই গরিব সাধারণ মানুষ অনেকেই নিজের সন্তানকেই লেখাপড়া করাতে পারছেন না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও উন্নয়ন কার্যক্রম সংক্রান্ত বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী বুধবার উপাচার্য, সিন্ডিকেট সদস্যসহ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের এ নির্দেশ দেন। শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে এ বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধরী, শিক্ষাসচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) কাজী সালাউদ্দিন আকবর এবং দেশের ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উপস্থিত ছিলেন। দেশে মোট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪টি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে উপাচার্য নেই এবং অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী থাকায় বৈঠকে উপস্থিত হতে পারেননি। জানা গেছে, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সরকারকে উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে বিশেষত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াত, শিবির, হিযবুত তাহ্রীরসহ মৌলবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। বিশেষত বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতপন্থ’ী শিক্ষকদের বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছে। এরই মাঝে কয়েকটি স্থানে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সংঘর্ষের ঘটনায় অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠকে বসেন শিক্ষামন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান। এর আগে সরকারের কাছে দেয়া গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়, বুয়েটের ২২ ভাগ শিক্ষক বর্তমান সরকার ও প্রগতিশীল মতাদর্শের অনুসারী। ৭০ ভাগ শিক্ষকই বিএনপি-জামায়াত ও হিযবুত তাহ্রীরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৮ ভাগ শিক্ষক মোটামুুটি নিরপেক্ষ। ১৩ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষক সমিতির অধিকাংশই সরকারের ঘোরতরবিরোধী এবং তারাই হিযবুত তাহ্রীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের মদদ দিচ্ছেন। অন্য এক প্রতিবেদনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাত ও এর মদদদাতা সম্পর্কে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে প্রায় একই চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেখানেও সরকারবিরোধী শিক্ষকদের দাপট ও কর্মকা- সম্পর্কে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের ওপর হামলা করে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বুয়েটে সঙ্কট চলছে। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার বৈঠকে উপাচার্যরা নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, উন্নয়ন ও সমস্যা তুলে ধরেন। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ক্যাম্পাসে মৌলবাদী সংগঠনগুলোর উত্থানের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিচ্ছে মৌলবাদী ছাত্র সংগঠন এমনকি সরকারবিরোধী শিক্ষকরাও।
এক উপাচার্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কর্মকা- সম্প্রতি বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি সংঘর্ষের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এরাই। কিছু শিক্ষক আছেন যারা এদের মদদ দিচ্ছেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। এই বিষয়টিই বৈঠকে তুলে ধরেছি। উপাচার্যরা বুয়েটের সঙ্কট কাটানোয় শিক্ষামন্ত্রী তথা সরকারকে সাধুবাদ জানান। একই সঙ্গে তাঁরা শিক্ষামন্ত্রী, ইউজিসি চেয়ারম্যান ও শিক্ষা সচিবকে মাঝে মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসার অনুরোধ করেন। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, অস্থিরতার ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেন কোন বাধা না থাকে উপাচার্যরা দ্রুত তা নিশ্চিত করবেন। আমরা সেগুলো তদারকি করব। তবে ছাত্র সংগঠগুলো মধ্যে সংঘাতের ঘটনা ‘অতীতের ধারাবাহিকতা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, চাইলেই তা রাতারাতি সমাধান করা যাবে না, তবে আমরা এ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কট সমাধানের পর আর কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় ধরনের কোন সমস্যা নেই বলে দাবি করেন শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন করতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুসরণে উপাচার্যদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আমাদের ছাত্র বেশি কিন্তু অর্থ কম। চাহিদা অনুযায়ী অর্থ পাওয়া যায় না। তবে একটি প্রকল্পের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার জন্য ১৮৯ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। আধুনিক শিক্ষায় ছাত্রদের দক্ষ করে তুলতে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিনামূল্যে ওয়াইফাই সার্ভিস চালু করা হবে। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যবস্থা সীমিত আকারে থাকলেও সব বিশ্ববিদ্যালয়কে শীঘ্রই এর আওতায় আনা হবে। মৌলবাদী সংগঠনের তৎপরতা ও ছাত্রলীগের কোন্দল সম্পর্কে উপাচার্যদের মতামত সম্পর্কে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলেন, যেখান থেকেই সঙ্কট তৈরি করার চেষ্টা হোক তা মোকাবেলা করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় আইন যথাযথভাবে কার্যকর করে শিক্ষা নিশ্চিত করতে উপাচার্যদের বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.