বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও ধর্ষণসহ ফরমাল চার্জ- যুদ্ধাপরাধী বিচার - ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রবিবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে


কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই আদেশ দিয়েছে। অন্যদিকে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম পুনরায় প্রথম থেকে শুরু (রি-কল) করার আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে সাঈদীর পক্ষে তৃতীয় সাফাই সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হবে আজ। বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর পরবর্তী সাক্ষীর জেরা ১২ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ দিয়েছে। এদিকে আজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের সাক্ষী টিআইবি চেয়ারম্যান, তত্ত্ব¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল তাঁর জবানবন্দী প্রদান করবেন আজ। ৬ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল এ দিন নির্ধারণ করেছে। গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এর আগে দুই বিশিষ্ট ব্যক্তি সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন ও বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা মুজিবনগর সরকারের গার্ড অব অনার প্রদানকারী প্রথম অফিসার মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম (এসপি মাহবুব)।

আবেদন খারিজ
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিচার কার্যক্রম পুনরায় প্রথম থেকে শুরু (রি-কল) করার আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। রবিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল সাঈদীর পক্ষে তার আইনজীবীর করা এ আবেদন খারিজ করে দেয়। আবেদন খারিজের পর ট্রাইব্যুনাল বলেন, এই মামলার যে সব নথিপত্র আছে তা দেখেশুনে পর্যালোচনা করেছেন পরে নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিরা। সাঈদীর মামলার বিচারিক কার্যক্রম চালাতে কোন বাধা নেই। সুতরাং এই মামলার বিচারের বিষয়ে রায় দিতে পারবেন না মর্মে যে আবেদন করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয়।
অন্যদিকে সাঈদীর মামলা পুনরায় শুরু করার আবেদনে বলা হয়, বিচারপতি নিজামুল হকের নেতৃত্বে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বর্তমানে যে দু’জন সদস্য বিচারপতি রয়েছেন তারা উভয়েই মামলার কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে এসেছেন। এ দু’জন বিচারপতির একজন আনোয়ারুল হক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইওর) জেরার কার্যক্রম চলার মাঝামাঝি সময়ে এবং অপরজন বিচারপতি মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন প্রায় শেষদিকে সাফাই সাক্ষীর জবানবন্দী শুরু থেকে ট্রাইব্যুনালে এসেছেন। অর্থাৎ বিচারক জহির আহমেদ পদত্যাগ করার পরে তিনি ট্রাইব্যুনালে এসেছেন।

হাজিরের নির্দেশ
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাকে গ্রেফতার করে ২৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ রবিবার এই আদেশ দিয়েছেন।
এই তারিখের মধ্যে গ্রেফতার করতে না পারলে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছে ট্রাইব্যুনাল। ২ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার নাসিরউদ্দিন আহমেদের কাছে প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ দাখিল করেন। প্রসিকিউটর শাহিদুর রহমান রবিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ পর্যালোচনা করে আদালত তা আমলে নিয়েছে ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে আদালতে হাজিরের নির্দেশ দিয়েছে। যদি হাজির করা না যায় তবে এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।’
অভিযুক্ত বাচ্চু রাজাকারকে হাজির করা না গেলে সেক্ষেত্রে তার অনুপস্থিতিতে বিচার কাজ চলবে বলেও তিনি জানান। আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল শেষে প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ৬৪ পৃষ্ঠার ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা , ধর্মান্তরিতকরণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রসিকিউটর আরও বলেন, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে ১০টি ঘটনায় ২২টি অভিযোগের ভিত্তিতে মোট ৪৪৮ পৃষ্ঠার অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হলো একাত্তর সালের ২১ এপ্রিল ফরিদপুরে জগদ্বন্ধু আশ্রমে ৮ জন সাধুকে তার সহযোগিতায় পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। তদন্তের স্বার্থে এক আবেদনের প্রেক্ষিতে ৩ এপ্রিল ট্রাইব্যুনাল-২ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারকে গ্রেফতার করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। পলাতক থাকায় তাকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
২৬ জুলাই তদন্ত সংস্থা প্রথম বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করার কথা জানান। ঐ দিন এক সংবাদ সম্মেলন করে বলা হয়, বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অপহরণ, দেশত্যাগে বাধ্য করা ও নির্যাতনের ১০ ধরনের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক ঐ সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন।
তদন্ত সংস্থা কর্তৃক জানা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অন্যতম নৃশংস অপরাধী ছিলেন বাচ্চু রাজাকার। বিচারের মুখোমুখি অপর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের প্রধান সহযোগী বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মুজাহিদের সঙ্গে মিলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের প্রমাণ মিলেছে। গত বছরের ১০ এপ্রিল আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে সাক্ষীর সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ১৪টি হত্যাকা-, তিনটি ধর্ষণ, নয়টি অপহরণ, ১০ জনকে আটক, পাঁচটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ১৫টি বাড়িতে লুটপাট, নয়জনকে ধর্মান্তরিত করা, মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করাসহ অজ্ঞাত অনেক লোকের ওপর চালানো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে।
তদন্ত সংস্থার সূত্রে জানা যায়, বাচ্চু রাজাকার তার শ্বশুর চান আলীর হাত ধরে ফরিদপুর এলাকার রাজাকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার অপরাধের এলাকা ছিল শালতা, নগরকান্দা ও বোয়ালমারী এলাকা। হান্নান খান বলেন, বাচ্চু রাজাকার তৎকালীন ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র হিসেবে সে তৎকালীন জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এর আগে অগ্রগতি তদন্ত প্রতিবেদনে দেয়া হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, আবুল কালাম আজাদ মাদ্রাসায় লেখাপড়া করার কারণে ভাল উর্দু বলতে পারতেন। এটাকে পুঁজি করে অন্যায়ভাবে লাভবান ও অসৎ কামনা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে তিনি ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রারম্ভকাল হতে পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের মন জয় করার জন্য সচেষ্ট হন। ১৯৭০-১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী এবং পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের ফরিদপুর জেলা পর্যায়ের কমিটির সদস্য আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ ও আবুল কালাম আজাদ, ফরিদপুর স্টেডিয়ামে অবস্থানরত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করত।

No comments

Powered by Blogger.