পার্টনারশিপ ডায়ালগ তিন ইস্যুতে দেশের স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে- ০ গ্রামীণ ব্যাংক- ০ গার্মেন্টস- ০ টিকফা by নাজনীন আখতার

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব সংলাপে আবারও প্রাধান্য পেতে যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংক, পোশাকশিল্প এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তি (টিকফা)। সংলাপে এ তিন বিষয়ে সরকারের বর্তমান অবস্থানের পরিবর্তন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।


এদিকে বিশ্বের ক্ষমতাধর এ দেশটির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ইতিবাচক সম্পর্ক রক্ষার্থে সংলাপ শুরুর আগেই এ তিন বিষয়ে সর্বোচ্চ স্বার্থ আদায়, সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অকাট্য যুক্তি পেশ ও কিছু সমঝোতার মানসিকতা নিয়ে ‘হোমওয়ার্ক’ শুরুর পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। ওয়াশিংটনে সেপ্টেম্বরে এ সংলাপ হতে পারে।
কূটনীতিক অলিউর রহমানের মতে, সংলাপের আগেই ওই তিন ইস্যুতে সুরাহা হয়ে যাবে। সরকার নমনীয় হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, ওই তিন ইস্যুতে সমস্যার সমাধান না হলে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সংলাপের প্রস্তুতি হিসাবে তিনি তিন ইস্যুতে বাংলাদেশকে হোমওয়ার্ক শুরুর তাগিদ দিয়েছেন। শনিবার জনকণ্ঠের কাছে তাঁরা এ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ৫ মে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফরে আসার পর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই অংশীদারিত্ব সংলাপ বা পার্টনারশিপ ডায়ালগ আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। সে প্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েসের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজেনা সাংবাদিকদের জানান, সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের আগামী সম্মেলনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পার্টনারশিপ ডায়ালগ অনুষ্ঠিত হবে। এই পার্টনারশিপ ডায়ালগে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। তবে ডায়ালগে গ্রামীণ ব্যাংক ও গার্মেন্টস ইস্যু এবং টিকফা চুক্তি প্রাধান্য পাবে বলে নিশ্চিত করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, হিলারির ২০ ঘণ্টার ঢাকা সফরে তিনি যে তিনটি বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে গেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত সেসব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পেতে গত প্রায় ৪ মাস ধরে সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। বিগত মাসগুলোতে তিনি সেসব বিষয়ে সরকারের এখনও অবস্থান পরিবর্তন না হওয়ায় হতাশাও প্রকাশ করেন।
গত ১০ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ডিকাবের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে মাকির্ন রাষ্ট্রদূত এ তিন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ও হতাশার কথা তুলে ধরেন। তিনি গার্মেন্টস শিল্পে কাজের নিরাপত্তা দেয়া ও শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলাম হত্যার ঘটনা তদন্তের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের গ্রামীণ ব্যাংক পরিস্থিতি ও পোশাকশিল্প কারখানায় কাজের পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারকে আলোচনার মাধ্যমে এ ইস্যুটি সমাধানে উপায় খুঁজে বের করতে বলেছি। আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার এ্যান্ড কংগ্রেস অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল অর্গানাইজেশনস (এফএলসিআইও) শ্রমিক পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্য প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করতে চায়। তারা এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে আবেদনও করেছে। চলতি বছরেই এ সিদ্ধান্ত হবে। সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গেলে তা বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ মনোভাবের বিরোধিতা করে একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
গত ২৯ জুলাই টিকফা নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস। এর আগের সপ্তাহে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ আয়োজিত এক আলোচনাসভায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজেনা টিকফাকে একটি ‘অস্বস্তিকর’ বিষয় উল্লেখ করে বলেন, এতে খারাপ কী আছে? আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। চার বছর আলোচনার পরও টিকফার বিষয়ে অগ্রগতি না হওয়ায় আন্তর্জাতিক শ্রমআইন মেনে চলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার বার্তাই যাচ্ছে ওয়াশিংটনের কাছে। টিকফা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে না।
২৯ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সাংবাদিকরা পররাষ্ট্র সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কারণে টিকফা আটকে নেই। কাদের কারণে সমঝোতা হচ্ছে না সেটা রাষ্ট্রদূতের কাছেই জানতে চাওয়া উচিত। অল্প একটি জায়গায় চুক্তিটি আটকে আছে। কেউ অনড় হয়ে থাকলে তো সমস্যা। পণ্যের ওপর আমাদের বাড়তি শুল্ক দিতে হয়। সেটা কেন তারা ছাড় দেন না। সচিব প্রশ্ন রাখেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রমআইন মেনে চলার ক্ষেত্রে আইএলও কনভেনশনে যতটি স্বাক্ষর করেছে যুক্তরাষ্ট্র কী তা করেছে?
তবে গ্রামীণ ব্যাংক ও পোশাকশিল্প ইস্যুতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র সরকারই নয়, সে দেশের মিডিয়াগুলোও গত চার মাস ধরে সরব ভূমিকায় রয়েছে। তারা বাংলাদেশের অগ্রগতির ভূয়সী প্রশংসা করলেও এ দুই ইস্যুতে সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে।
সর্বশেষ গত ২২ ও ২৩ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমসে টানা দুইদিন বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২৩ আগস্ট শীর্ষ সংবাদ হিসাবে প্রকাশিত ‘এক্সপোর্ট পাওয়ার হাউস ফিল্স প্যাঙ্গস অব লেবার স্ট্রাইফ’ শিরোনামের দুই পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষে ওবামা প্রশাসন উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের আমদানিকারকরাও উদ্বিগ্ন। তাঁরা চান শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হোক। কিন্তু এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে মালিকপক্ষ। আর সরকারের ওপর গার্মেন্টস মালিকদের প্রভাব ব্যাপক। শ্রমিকদের দমনে সরকার তার পুরো নিরাপত্তা যন্ত্রকে নিয়োজিত করেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি গার্মেন্টস খাত তদারকি করে থাকেÑযে কমিটিতে রয়েছে সামরিক বাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শ্রমিক নেতাদের ওপর নজরদারি করে থাকে। কড়া গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকা শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামকে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছে। ওই হত্যার কূল-কিনারা হয়নি এখনও।
এছাড়া ২২ আগস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ড. ইউনূসকে অপসারণের পর এমডি নিয়োগে সরকারের পদক্ষেপকে বেহায়াপনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এ্যান এ্যাটাক অন গ্রামীণ ব্যাংক এ্যান্ড দ্য কজ অব উইমেন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ইউএস সিনেটরদের উদ্বেগ, আবেদন-নিবেদনের প্রতি কোন ধরনের তোয়াক্কা না করে শেখ হাসিনা ও তার সরকার সারাবিশ্বে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য অনুকরণীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। এসবই করা হচ্ছে ড. ইউনূসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তি-আক্রোশ থেকে।
এ অবস্থায় সংলাপকে গুরুত্ব দিয়ে সমস্যা সমাধানে সরকারকে জোর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত অলিউর রহমান। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এ ধরনের সংলাপের সুবিধা হলো দুই দেশের মধ্যকার যত ধরনের আলোচনা থাকে, সবই করা সম্ভব হয়। আমি আশাবাদী সংলাপের আগেই গ্রামীণ ব্যাংক ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা দূর হবে। তিনি বলেন, ড. ইউনূস-ইস্যু একটি মন্ত্রণালয় ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কর্তাব্যক্তিদের প্রতি আমার পরামর্শ, যত দ্রুত সম্ভব সমস্যার সমাধান করুন। কারণ যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতিতে অত্যন্ত পরিপক্ব একটি দেশ। টিকফা নিয়ে সমঝোতায় বাংলাদেশকে আরও কৌশলী হওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, একাধিক দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পার্টনারশিপ ডায়ালগ হয়। সে হিসাবে বাংলাদেশের জন্য এই সংলাপ থেকে কতটুকু স্বার্থ আদায় করা সম্ভব হবে তা নিয়ে হোমওয়ার্ক শুরু করতে হবে। বিভিন্ন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে যেন না যায় যাতে আমরা সামলাতে না পারি। কারণ একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পোশাকশিল্প বাজার। গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে সরকার জোরালো কোন যুক্তি দেখাতে পারেনি। আর টিকফার বিষয়ে বাংলাদেশকে সমঝোতা করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ঝুঁকি নিতেই হবে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে থাকলে উন্নয়ন সম্ভব হবে না।

No comments

Powered by Blogger.