নেপথ্যে আমদানির চাপ-এক বছরে ডলারের দাম বেড়েছে সাড়ে ৯ টাকা by মজুমদার বাবু

জোগানের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় দেশে ডলারের সীমিত সঞ্চয়ে টান পড়েছে। ডলারের তুলনায় প্রতিদিনই কমছে টাকার মূল্যমান। গত এক সপ্তাহে দেড় টাকারও বেশি বেড়ে ডলার বিক্রি হয়েছে ৭৮ টাকা ৮০ পয়সায়। আন্তব্যাংক লেনদেনে গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই ডলারের দাম বেড়েছে ৬০ পয়সা। গতকাল রবিবার আরো এক ধাপ বেড়ে ডলারের বিনিময়মূল্য দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকা ১০ পয়সা।


জানা গেছে, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ও রপ্তানি আয় গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বাড়লেও তা দিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য উপকরণ ও ফার্নেস অয়েল আমদানি ব্যয় মেটানো হচ্ছে। ফলে তা দিয়ে ডলারের বাড়তি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া নানা ওজর-আপত্তি তুলে প্রতিশ্রুত ঋণ সহায়তা প্রদানে বিরত রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও জাইকা। দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের বন্ধ্যত্ব কেটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদা বাড়ার কারণেই ডলারের দাম বাড়ছে। আঞ্চলিক দেশগুলোতেও ডলারের সংকট প্রবল। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, এমনকি থাইল্যান্ডের মুদ্রাও মান হারাচ্ছে ডলারের বিপরীতে। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান এখন ৩৩ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। ইউরোপের চরম ঋণ সংকটের কারণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুদ্রার মান কমছে। তবে বাংলাদেশে এ সমস্যা সাময়িক_এ দাবি করে তাঁরা বলছেন, আইএমএফের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়া গেলে ডলারের ঘাটতি অনেকটাই কমবে।
গত ডিসেম্বরে ডলারের দাম ছিল প্রায় ৭১ থেকে সাড়ে ৭১ টাকা। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে চলতি ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকা ৪৫ পয়সা। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময়মূল্য কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দেশের আমদানি ব্যয়ের বেশির ভাগ অংশ পরিশোধ করা হয় মার্কিন ডলারেই। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে আমদানি প্রায় ২১ শতাংশ বেড়ে ৮১১ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি চাহিদা বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে ডলারের চাহিদা বেড়ে গেছে। এ কারণে বেড়েছে ডলারের দাম। এ বিনিময়মূল্য কমার নেপথ্যে রয়েছে চলতি হিসাবের ভারসাম্যে ঘাটতি। গত বছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত ছিল ১১১ কোটি ডলার। এখন সেখানে ঘাটতি ৩৭ কোটি ডলার, বছর শেষে যা ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শ্লথগতি, তেল কেনার জন্য বিপিসিসহ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ নির্ভরশীলতা, বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ না পেয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের অতিমাত্রায় ঋণ নেওয়াকে দায়ী করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উদাসীনতার সুযোগে দেদার পাচার হচ্ছে মার্কিন ডলার। স্বাভাবিক নিয়মেই তাই কার্ব মার্কেটে ডলারের মূল্যও বেশি। কার্ব মার্কেটে ডলারের উচ্চ মূল্য দীর্ঘদিন বজায় থাকায় বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) আসছে কম। নিজেদের ডলারের মজুদ তলানিতে এসে যাওয়ায় বেশি দামেও ডলার বিক্রি করতে ভরসা পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এমনিতেই ভাটার টান। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৮০ কোটি ডলার, গত ৭ ডিসেম্বর তা ছিল ৯৩০ কোটি ডলার। ক্ষয়িষ্ণু এ রিজার্ভ ভেঙে বাজারে ডলারের সংকট সামাল দিতে ভরসা পাচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কারণ ঘাড়ের ওপর রয়েছে আইএমএফ। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির মানি অ্যান্ড ক্যাপিটাল মার্কেট মিশন (এমসিএম) ঢাকা সফর করেছে। এ মিশনের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে আইএমএফের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়া না পাওয়া।
দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে, এর চেয়েও বেশি হারে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। ফলে বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতি। গত বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে আমদানি-রপ্তানির ব্যবধান ছিল ১৪৭ কোটি ডলার। এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮১ কোটি ডলার। ঘাটতি বাড়ায় চাপ পড়ছে রিজার্ভের ওপর।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কালের কণ্ঠকে বলেন, যদি আইএমএফ ১০০ কোটি ডলার সহায়তা দেয়, তাহলে শিগগিরই ডলারের দর নেমে আসবে। যদি না পাওয়া যায়, তাহলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে। আইএমএফের একটি মিশনের ঢাকা সফরের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রিজার্ভের ব্যাপারে আইএমএফের স্পর্শকাতরতার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের বাজারে বেশি ভূমিকা রাখতে পারছে না। এ কারণেও সংকট বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একটি সূত্র জানিয়েছে, মূলত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য আমদানি করা যন্ত্রপাতির বকেয়া পরিশোধ, এগুলোর চালিকাশক্তি তথা জ্বালানির মূল্য পরিশোধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য পরিশোধ, আন্তর্জাতিক বাজারে পুরনো জাহাজের দাম বাড়াসহ বিভিন্ন কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। তবে এ সমস্যা সাময়িক বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ ফরেন এঙ্চেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন ট্রেজারার ও এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকগুলো ডলারের দর বৃদ্ধি নিয়ে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তবে এটা সাময়িক। ডলারের দর বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট-কেন্দ্রিক আমদানির দায় পরিশোধের চাপ ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ সহায়তা কমে যাওয়া। এর সঙ্গে রয়েছে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের সীমিত প্রবৃৃদ্ধি, তেলের দর বাড়া। সব মিলিয়েই একটি সাময়িক অসংগতি দেখা দেওয়ায় ডলারের দাম বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'আমদানিনির্ভর দেশ হিসেবে আমাদের বাণিজ্য ভারসাম্য কিছুটা ঋণাত্মক থাকতে পারে। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স কমবে সাধারণত বৈদেশিক আর্থিক সহায়তার পরিমাণ কমলে এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গেলে। এর কারণ হতে পারে বৈদেশিক আর্থিক সহায়তা কমে যাওয়া। এডিপি বাস্তবায়িত না হলে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ সহায়তা দেবে না।'
সাবেক গভর্নর আরো বলেন, 'দীর্ঘ সময় ধরে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ঋণাত্মক থেকে গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে। এতে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাবে। এর প্রতিফলন ইতিমধ্যেই বাজারে পড়ছে বলে দেখতে পারছি। তাই বিওপি ধনাত্মক রাখা সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। আমি গভর্নর থাকাকালে বিওপিকে সব সময়ই ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। এ কারণে ডলারের বিপরীতে টাকার মান সর্বোচ্চ ৬৮ টাকা পর্যন্ত গিয়েছিল।'
মাত্র আট মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রায় চার টাকা অবমূল্যায়ন কতটা যৌক্তিক_এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা জানান, ২০০৩ সাল থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারের হাতে ডলারের দর ছেড়ে দিয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে বাজার স্থিতিশীল রাখতে ডলার ক্রয় ও বিক্রয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুপ্রবেশ করে থাকে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'ডলারের দর বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল এবং বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ডলারের দর বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার মনে হয়, ডলারের সংকট নয়, চাপ রয়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময়মূল্য কমে গেছে বাজারে ডলারের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে। চলতি অর্থবছরে আমদানি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। এটা অপরিহার্য ছিল। কারণ বিদ্যুতের জন্য প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। ভবিষ্যতের বিবেচনায় এ আমদানি চাপ আমাদের নিতেই হবে। একমাত্র ভরসা রেমিট্যান্স। এ ক্ষেত্রেও প্রবৃদ্ধি হয়েছে সীমিত মাত্রায়। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) চলতি বছরে আসেনি বললেই চলে। এর ফলে ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টও ঋণাত্মক ধারায়।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, 'আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে থেকে গেছে। সেটা ৪ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত স্বাভাবিক হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তা প্রায় ১০ শতাংশ। রপ্তানির অর্থ দেশে আনার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরো দক্ষ হতে হবে। যদি ডলারের উদ্বৃত্ত বেশি হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিনতে হয়, আবার কিছুটা চাপ এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই সরবরাহ করতে হয়, তাহলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা কোথায়? সুতরাং সামগ্রিক বিবেচনায় আমাদের এ চাপটা নিতেই হবে।'

No comments

Powered by Blogger.