খা খা করে শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলা কমপ্লেক্স

ড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৯টা। সরকারি অফিস শুরুর সময়। অথচ শ্রীবরদী উপজেলা কমপ্লেক্সে তখন সুনসান নীরবতা। বেশির ভাগ সরকারি দপ্তরে তালা ঝুলছে। দু-একটির দরজা খোলা পাওয়া গেলেও ভেতরে উঁকি দিয়ে কর্মকর্তাদের দেখা মিলল না। শ্রীবরদী উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে গতকাল সোমবার সকালের দৃশ্য ছিল এমন।
স্থানীয় লোকজন জানান, বেশির ভাগ সরকারি কর্মকর্তা কর্মস্থল শ্রীবরদীতে থাকেন না। তাঁরা নিজেদের মর্জিমাফিক অফিসে আসা-যাওয়া করেন।
কর্তাব্যক্তিদের দেখাদেখি অধস্তন কর্মচারীরাও নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে অফিসে ঢোকেন। সব মিলিয়ে শ্রীবরদী উপজেলা কমপ্লেক্স সরব হতে হতে সকালের সূর্য চলে আসে প্রায় মাথার ওপর। জানা গেছে, অনেক দপ্তরে কর্মকর্তার পদও শূন্য রয়েছে। আর এসব কিছুর মাসুল শেষ পর্যন্ত সীমান্তবর্তী উপজেলার লোকজনকেই গুনতে হচ্ছে। শ্রীবরদী উপজেলা কমপ্লেক্সে ঢুকতেই হাতের বামপাশে পড়বে পল্লী ভবন। সেখানে উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তার অফিস।
গতকাল সকাল ৯টায় গিয়ে পল্লী ভবনের সব কক্ষই তালাবদ্ধ দেখতে পাওয়া যায়। পল্লী ভবন থেকে সামনে এগোলেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মূল অফিস ভবন। এ ভবনের নিচতলায় হাতের বাম দিকে প্রথমেই আছে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার অফিস। সেটি পার হলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) অফিস। সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত এ দুই অফিসে জনমানব দেখা যায়নি। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৯টা ৪৮ মিনিটের ঘর ছোঁয়ার সময় একটি মোটরসাইকেলে চড়ে অফিসে আসেন পিআইও মো. লুৎফর রহমান। কিন্তু সহকারী রুহুল আমিন তখনো না আসায় তিনি নিজের কক্ষে ঢুকতে পারেননি।
ভবনটির দোতলায় ওঠার সিঁড়ির হাতের ডান দিকে উপজেলা প্রকৌশলীর অফিস। সেখানে ৯টার দিকে এক নারী দুটি কক্ষের তালা খুলে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। তখনো কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অফিসে আসেননি। দোতলায় ইউএনওর অফিস কক্ষ খুলে অফিস সহকারীরা বসে ছিলেন। সোয়া ৯টার দিকে ইউএনও গুলশান আরা তাঁর কক্ষে প্রবেশ করেন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে উপজেলা প্রকৌশল অফিসের হিসাবরক্ষক মো. নুরুজ্জামান আসেন। তখনো সহকারী প্রকৌশলী ও উপসহকারী প্রকৌশলীরা আসেননি। মো. নুরুজ্জামান জানান, উপজেলা প্রকৌশলী মো. মোজাম্মেল হক কুমিল্লার বার্ডে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আর তিনি অফিসে এসেছেন ঝিনাইগাতীর তিনানী এলাকা থেকে। পথে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় কিছুটা দেরি হয়েছে।
ইউএনওর ভবনের উল্টোদিকে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলীর অফিস সকাল ৯টায় খোলা হয়। এর প্রায় ৪২ মিনিট পর সেই অফিসে গেলে নলকূপ মেকানিক মো. বুলবুল মিয়া জনান, উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী আবদুল মোতালেব হজে যাওয়ার কারণে ছুটিতে আছেন। শেরপুর সদরের প্রকৌশলী নেজামুল হক অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি তিন থানার দায়িত্বে থাকায় সব দিন আসেন না। তবে সকাল ১১টায় ফের ওই অফিসে গিয়ে প্রকৌশলী নেজামুল হককে দেখা যায়। তিনি বলেন, 'এখানে জনবল সংকট রয়েছে। কোনো অফিস সহকারী নেই। মেকানিককে দিয়ে অফিসের কাজ চালানো হচ্ছে।'
সকাল সোয়া ৯টার দিকে উপজেলা শিক্ষা অফিসে গিয়ে দেখা যায়, শিক্ষা কর্মকর্তার কক্ষ তালাবদ্ধ। অফিস সহকারী মোতালেব হোসেন ও পাঁচ সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার কক্ষ খোলা। কিন্তু তাঁরা তখন পর্যন্ত পেঁৗছাননি। সেখানকার এমএলএসএস মাজহারুল ইসলাম জানান, সাড়ে ৯টার দিকে কর্মকর্তারা আসবেন। অবশ্য সাড়ে ১০টায়ও ওই অফিসে কোনো কর্মকর্তা বা আর কোনো কর্মচারীকে দেখা যায়নি। দুপুর ১২টার দিকে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মাহবুব জামানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমি শেরপুর যাচ্ছি, জেলা অফিসে মিটিং আছে।'
সোয়া ৯টার দিকে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসটিও ছিল তালাবদ্ধ। অন্যদিকে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিসে গিয়ে জানা যায়, কর্মকর্তার পদটি শূন্য রয়েছে। অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন শেরপুর সদর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা দেবযানী ভট্টাচার্য পূজার ঐচ্ছিক ছুটিতে থাকায় তাঁর অফিসের সহকারীও দায়িত্ব থেকে 'ছুটি' নিয়েছেন। নতুন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রবিবার কাজে যোগ দিয়েছেন। গতকাল তিনি অফিসে না আসায় দুই পরিদর্শককেও দেখা যায়নি।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে পিডিবির উপজেলা আবাসিক প্রকৌশলীর অফিসে গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক প্রকৌশলী ছোরহাব আলী নেই। সেই সঙ্গে উধাও অফিস সহকারী আনিসুর রহমানও। অফিসের এলডিএ মো. ইদ্রিস আলীর কাছে তাঁদের অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আবাসিক প্রকৌশলী নষ্ট ট্রান্সফরমার পরিবর্তনের জন্য গতকাল (রবিবার) ঢাকায় গেছেন। আর অফিস সহকারী এখনো এসে পেঁৗছাননি।' ওই অফিসে বসা একটি বেসরকারি কলেজের একজন প্রভাষক বললেন, 'পিডিবির আবাসিক প্রকৌশলী আর অফিস সহকারী তো অফিসই করেন না। তিন দিন এসে আমি তাঁদের পাইনি।'
উপজেলা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের অফিস দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্ধ পাওয়া যায়। উপজেলা ভূমি অফিসের এসি ল্যান্ড পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূন্য রয়েছে। শ্রীবরদী উপজেলার আরো কয়েকটি সরকারি দপ্তরে গিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়সারা কাজ করতে দেখা যায়। তাঁদের কেউ সরকার নির্ধারিত অফিস সময়সূচি মানেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক কামরুজ্জামান আবু কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অফিসের কর্মকর্তারা আসেন অন্তত এক ঘণ্টা দেরিতে আর চলে যান এক ঘণ্টা আগে। এটাই এখানে নিয়মে পরিণত হয়েছে। আবার অনেক পদে কর্মকর্তা না থাকায় সাধারণ মানুষ ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে।'
শ্রীবরদী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এ কে এম ওবায়দুর রহমান বলেন, ইউএনওসহ মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা সময়মতো অফিস করেন। শ্রীবরদী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌর মেয়র মো. আবদুল হাকিম বলেন, 'ইউএনও ছাড়া অন্য সরকারি কর্মকর্তারা সময়সূচি মেনে অফিসে যাচ্ছেন না। এখানে অনেক কর্মকর্তাই বাইরে থেকে আসেন। যে কারণে সরকারি বন্ধ হয়ে যায় সপ্তাহে তিন দিন। বৃহস্পতিবার আধা বেলা থাকতে থাকতেই অনেকে চলে যান আবার রবিবার আধা বেলার পর অফিসে আসেন।' উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. সালাহউদ্দিন বলেন, 'কয়েকজন অফিসার ছাড়া সবাই মর্জিমাফিক অফিস করেন। এটাই এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।'
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গুলশান আরা অবশ্য দাবি করেন, কর্মকর্তারা যথাসময়েই অফিস করছেন। তবে নির্বাচন অফিসসহ কয়েকটি অফিসে কাজ এ মুহূর্তে কম থাকায় কেউ কেউ হয়তো কিছুটা দেরিতে আসছেন। তিনি বলেন, 'উপজেলা কোয়ার্টার জরাজীর্ণ হওয়ায় অনেকের কষ্ট হচ্ছে। তার পরও অনেকেই এখন উপজেলায় বাসা নিয়ে থাকছেন। অনেক সময় কর্মকর্তারা সন্ধ্যার পরও কাজ করেন।'

No comments

Powered by Blogger.