শ্রমিক-ব্যবস্থাপনার তিনটি শিল্প নেতাদের হাতে জিম্মি by রফিকুল ইসলাম

শিল্পনগর টঙ্গীতে শ্রমিক-ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেওয়া তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান শ্রমিকনেতাদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই নেতারা দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল অওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত শ্রমিক সংগঠনের। শিল্প তিনটি হচ্ছে অলিম্পিয়া টেক্সটাইল, মন্নু কটন মিলস ও মেঘনা টেক্সটাইল। লক্ষ্য ছিল, শ্রমিকদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় শিল্পগুলো লাভজনক হবে। শ্রমিকেরা লাভজনক তিনটি শিল্পের মালিক হবেন। দেখিয়ে দেবেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প নামমাত্র দামে বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তরের বিকল্প আছে। শ্রমিকদের যৌথ ব্যবস্থাপনা ও মালিকানাই হতে পারে সেই বিকল্প।
কিন্তু শ্রমিক-ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তরের প্রায় এক যুগ পরে দেখা যাচ্ছে, দিনে দিনে শিল্পগুলো ধ্বংসের পথে এগোচ্ছে। দায়িত্বরত শ্রমিকনেতারাও বলেছেন, দেনার দায় আর লোকসানের ভারে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্বাধীনতার পর টঙ্গীর এ প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। আশির দশক পর্যন্ত এগুলো পরিচালনা করত বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন (বিটিএমসি)। একপর্যায়ে রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হলে ২০০১ সালে শ্রমিক ব্যবস্থাপনায় দেওয়া হয়।
তিন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হস্তান্তরের পর থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রমিকনেতাদের হাতে জিম্মি। হস্তান্তরের সময় আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শ্রমিকনেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও পরে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন বিএনপি-সমর্থিত শ্রমিকনেতারা। তিনটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতদের অনেকেই শুরু থেকে বিভিন্ন পদে রয়েছেন। বার্ষিক সাধারণ সভায় মূল নেতৃত্বের কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রতিষ্ঠানের হিসাব-নিকাশ জানার সুযোগ নেই সাধারণ শ্রমিকদের।
মন্নুর অবস্থা শোচনীয়: হস্তান্তরের পর মন্নু কটন মিলসের নাম দেওয়া হয় নিউ মন্নু ফাইন কটন মিলস। শুরু থেকে এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন টঙ্গী আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক গনি মিয়া। একই সংগঠনের সদস্য মিজানুর রহমান রয়েছেন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। পরিচালকদের মধ্যে আবদুল কাদির, নুরু মিয়া, মফিজউদ্দিন, আবু সাঈদ মোল্লা, আবদুল জলিল, কামাল হোসেন, মনির হোসেন ও নূরজাহান মনি আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এবং মফিজুর রহমান, সাইফুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, নাসির উদ্দিন ও আবদুস সালাম বিএনপি-সমর্থিত শ্রমিকনেতা।
বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়েছে।
শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, ব্যাংকে রাখা মন্নুর শেয়ারহোল্ডারদের ৫৪ লাখ টাকা অননুমোদিতভাবে বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের দাবির মুখে একবার মাত্র নির্বাচন হয়েছে। প্রতিবছর কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী নামমাত্র বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। তবে ক্ষমতার বদল হয় না। ঘুরেফিরে কয়েকজন শ্রমিকনেতাই দায়িত্বে থাকছেন। পরিচালনা পরিষদের বিধান অনুযায়ী, দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয় না।
তবে প্রথম আলোর কাছে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গনি মিয়া।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্নুর গুদাম ও কলোনি ভাড়া দিয়ে বছরে এক কোটি টাকার বেশি আয় হয়। কিন্তু সেই অর্থের সঠিক হিসাব শ্রমিকেরা পান না। প্রথমদিকে দু-তিন বছর আয়-ব্যয়ের হিসাব দেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে শ্রমিকেরা মিলের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের দাবিতে স্মারকলিপি দেন পরিচালনা পরিষদের কাছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, শিল্পটির ৯৭টি স্পিনিং মেশিনের মধ্যে চালু রয়েছে ৩০টি। অধিকাংশ মেশিন অকেজো হয়ে গেছে। একসময় এখানে মিহি সুতা (১২০ কাউন্ট) তৈরি হতো। আধুনিক মেশিনের অভাবে এখন তা হচ্ছে না। চালু মেশিনগুলোও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
হস্তান্তরের সময় ৪৪ কোটি টাকা ঋণ ছিল শিল্পটির। ১৮ বছরের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধের কথা ছিল। কিন্তু গত ১১ বছরে পরিশোধ হয়েছে মাত্র ৪২ লাখ টাকা।
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দেওয়া কাঁচামাল নিয়ে সুতা তৈরি করা হচ্ছে। বিনিময়ে কর্তৃপক্ষ পাচ্ছে সার্ভিস চার্জ। কর্তৃপক্ষের দাবি, হস্তান্তরের সময় শর্ত ছিল, মেশিনগুলো সংস্কার করে দেওয়ার, পরিচালনার জন্য ব্যাংকঋণ দেওয়ার। কিন্তু সরকার সে কথা না রাখায় শিল্পটির এই দুরবস্থা।
অলিম্পিয়া ও মেঘনা: আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শ্রমিকনেতা মতিউর রহমান (বিকম মতি) শুরু থেকেই অলিম্পিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিএনপি-সমর্থিত আবুল হাশেম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান পাঁচ বছর পর। পরিচালকদের মধ্যে শাহাবুদ্দিন মজুমদার, নুরু মিয়া, আবুল কাশেম, সফিউদ্দিন, আবদুল আজিজ আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এবং মজিবুর রহমান, আবদুল মমিন, আমানউল্লাহ বিএনপি-সমর্থিত শ্রমিকনেতা।
অলিম্পিয়া টেক্সটাইলে শুরুতে শ্রমিকদের শেয়ারহোল্ডার করা হয়। তবে চার-পাঁচ বছর শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়নি। শেয়ারহোল্ডাররা কোনো কথা বলারও সুযোগ পাননি। অনেক আন্দোলনের পর তাঁদের লভ্যাংশ দেওয়া শুরু হয়।
মেঘনা টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান জাহিদ আল মামুন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরুল ইসলাম আওয়ামী লীগ-সমর্থিত এবং পরিচালক শাহাবুদ্দিন ও মোবারক হোসেন বিএনপি-সমর্থিত শ্রমিকনেতা। মেঘনার সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জাহিদ আল মামুনের কাছে জানতে চাইলে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানান।
শিল্পটিতে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, টঙ্গী শিল্পনগরে ব্যাংকের মাঠের কাছে এ প্রতিষ্ঠানটি একসময় জমজমাট থাকলেও দিনে দিনে ঝিমিয়ে পড়েছে। যে পথ পেরিয়ে এ প্রতিষ্ঠানে শত শত শ্রমিক আসা-যাওয়া করতেন, সেখানে এখন আর কোনো প্রাণচাঞ্চল্য চোখে পড়ে না।
এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার ৬৭৪ জন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক শেয়ারহোল্ডার বলেন, তাঁরা লভ্যাংশও পাচ্ছেন না, আবার সরকারি দেনাও পরিশোধ হচ্ছে না। বার্ষিক সাধারণ সভা হলেও ক্ষমতার বদল হয় না। একটি চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে আছে প্রতিষ্ঠানটি। কোনোমতে স্পিনিং ও ডাইং বিভাগ চালু রাখা হয়েছে। অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.