নিবন্ধ- অন্ধত্ব ও আরোগ্য পরম্পরা by দ্বিজেন শর্মা

বাংলাদেশ হবে পৃথিবীর প্রথম পরিবেশবাদী নতুন ধরনের এক সমাজতান্ত্রিক দেশ_এমন অদ্ভুত ভাবনাকে 'সকল অসম্ভবের দেশ' বাংলাদেশে অসম্ভব বলা যাবে কি? না, তেমন অসম্ভবের সম্ভাবনাও আছে এ দেশে। আমাদের অনন্যতার তালিকা বেশ দীর্ঘ। প্রাকৃতিক ও মানুষী পরিবেশের কিছু দিক থেকেও আমরা শীর্ষে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ।
জনঘনত্ব ও আশঙ্কিত পরিবেশ বিপর্যয়ের হিসাবেও আমরা প্রথম সারিতে; এবং মাথাপিছু সম্পদের অঙ্কেও। বাংলা একাডেমীর 'উত্তরাধিকার' মাসিকে (ফাল্গ-ন, ১৪১৬) প্রকাশিত 'জনঘনত্ব : জীবতাত্তি্বক সমীক্ষা' প্রবন্ধে অধ্যাপক জিয়া উদ্দিন আহমদ লিখেছেন, 'জনঘনত্বে আমরা বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে।ঃপ্রথমেই পরিবেশ দূষণের ঘনত্ব। এটির মূলে রয়েছে অল্পস্থানের বিরাট জনসংখ্যার সামগ্রিক জাগতিক কর্মকাণ্ড। মাটিতে ও পানিতে, প্রতি একর পরিমাণ জমিতে, যেমন প্রতি বর্গমিটার বা বর্গকিলোমিটারে রাসায়নিক দূষণের পরিমাণ জনবসতির ঘনত্বের আনুপাতিক হারেই হবে এবং তা হবে অতু্যচ্চ মাত্রায়।'
তিনি আরো লিখেছেন, 'স্থলচর স্তন্যপায়ী জীবের এত অধিক ঘনত্বের দৃষ্টান্ত আমাদের জানা নেই। এটি কল্পনাতীত ব্যাপার হলেও এমনটি যখন ঘটবে তখন বংলাদেশে আর প্রাকৃতিক পরিবেশের কোনোকিছু থাকবে না_প্রায় সারা দেশ একটি অতিকায় শহরে রূপান্তরিত হবে।' বলাবাহুল্য, তেমন পরিস্থিতিতে আমাদের সন্তান ও পৌত্র-পৌত্রীরা কীভাবে বেঁচে থাকবে, তা কল্পনাতীত। এমন অনিবার্য বাস্তবতা সম্পর্কে কিন্তু আমরা মোটেও উদ্বিগ্ন নই, স্বপ্ন দেখছি 'এক অশেষ সম্ভাবনা'র দেশের। তা হলে কি কোথাও ভুল হচ্ছে জিয়া উদ্দিনদের? অন্যথা দেশের দলীয় রাজনীতির অব্যাহত বিরোধ তো এতটা উত্তুঙ্গ থাকার কথা নয়।
আমাদের দেশে কেন, উন্নত বিশ্বেও পরিস্থিতি প্রায় অনুরূপ। সেখানকার লোকজন বেশ সুখেই আছে, আরো ভোগবিলাসের স্বপ্ন দেখছে, নতুন নতুন পণ্যবস্তুর উৎপাদন ও যথেচ্ছা অপচয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বর্জ্য সৃষ্টি করে চলেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস উদ্গীরণ, মেরুতুষার গলন, ওজোনস্তর ক্ষয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লন্ডন-নিউইয়র্ক-টোকিও ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা জলবায়ুর সম্ভাব্য পরিবর্তনে কৃষির বিপর্যয় ইত্যাদি নিয়ে তারা তেমন ভাবিত নয়, যেন এসব সংকট মোকাবিলার মতো সামর্থ্য তাদের আছে। বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের ভয়ঙ্কর সব পূর্বাভাস সম্পর্কে তারা বড়ই নিষ্পৃহ। রাজনীতিতে গ্রিন পার্টিগুলির তেমন কোনো প্রভাব নেই। কর্পোরেট সংস্থাগুলি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অর্থব্যয়ে অনিচ্ছুক। তারা হন্যে হয়ে তেল-গ্যাস খুঁজছে, নতুন নতুন মারণাস্ত্র বানাচ্ছে, বশংবদ রাজনীতিকদের সাহায্যে বিশ্বায়নের নামে নয়া-সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ঘনীভূত করছে, ধরিত্রী সম্মেলনগুলোতে মহাজনী কতর্ৃত্ব দেখাচ্ছে। এটা হলো, একধরনের প্যারাডাইম, তাতে আছে প্রকট নৃকেন্দ্রিকতা, সেখানে কোনো শিফ্ট খুবই কঠিন।
অন্ধ হলেও যেহেতু প্রলয় বন্ধ থাকে না, তাই পশ্চিমের এই নিশ্চিন্ত সুখভোগ স্থায়ী হবে না। মার্কস ১৮৬৭ সালে 'ক্যাপিটাল' লিখে এবং লেনিন ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতাত্তি্বক বিপস্নব ঘটিয়ে পুঁজির শাসকদের হুঁশিয়ার হওয়ার যে সুযোগ দিয়েছিলেন সেগুলোর কল্যাণেই নানা কৌশলের আশ্রয়ে আজও তারা টিকে আছে। শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের স্বরূপ তারা উপলব্ধি করতে পারলেও মার্কসের অন্যতম সমীক্ষা_প্রকৃতি ও মানুষের দ্বন্দ্বের বিষয়টিতে কোনো দিনই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত চার্লস ডারউইনের 'অরিজিন অব স্পিসিজ' বইটির বার্তাও তারা বোঝেনি, বরং অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যৌক্তিকতা প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছে। শিল্পবিপস্নব মানুষকে প্রকৃতির ওপর বিজয় অর্জনের স্পর্ধা জুগিয়েছে, সাফল্যও এসেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা দুষ্টচক্রে আটকা পড়ে গেছি। আমরা যে প্রকৃতির সৃষ্ট বাস্তুসংস্থানের বাসিন্দা এবং নিজস্ব বাস্তুসংস্থান নির্মাণ যে আমাদের সাধ্যাতীত, প্রকৃতির মধ্যে বসবাসই যে আমাদের নিয়তি সেই বাস্তবতা আমরা বিস্মৃত হয়েছিলাম এবং তারই ফল আজকের পরিবেশ সংকট তথা প্রকৃতির প্রত্যাঘাত। স্মর্তব্য, প্রকৃতি একটি নির্মুখ শক্তি। মানুষসহ কোনো জীবের প্রতিই তার প্রেম-অপ্রেম কোনোটাই নেই। প্রকৃতিই প্রজাতির স্রষ্টা ও বিনাশক। সে ভূতাত্তি্বক কালে লক্ষ লক্ষ প্রজাতির বিনাশ ঘটিয়েছে, মনুষ্যপ্রজাতির বিনাশও তার সাধ্যায়ত্ত।
রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের পতনের পরও মার্কসবাদী পণ্ডিতরা পুঁজিতন্ত্রের অনিবার্য পতন এবং নতুন একধরনের কমিউনিজমের নিশ্চিত জন্মলাভের কথা বলছেন। তাঁদের ধারণা জ্বালানির অভাব, প্রকৃতির প্রত্যাঘাত এবং আরো নানা সামাজিক কারণে আগামী পঞ্চাশ বছরের সময়সীমায় পুঁজিতন্ত্রের বৃদ্ধিহার শূন্যের কোঠায় পেঁৗছবে। মানুষ পুঁজিতন্ত্রের পতন এবং একটি নতুন সমাজব্যবস্থার অভু্যদয় দেখার জন্য কিছুকাল অবশ্যই অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু পরিবেশবাদীরা সেটুকু সময় দিতেও নারাজ। বিখ্যাত পরিবেশবিদ ও গ্রন্থকার হেলেন ক্যালডিকট তাঁর 'ওং ণড়ঁ খড়াব ঞযরং রঃধ চষধহবঃ্থ (২০১০) বইয়ের শেষ অধ্যায়ে লিখেছেন, 'এখনই শুরু করা প্রয়োজন। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই, আছে মাত্র দশ বছরেরও কম সময় এবং প্রতিটি মুহূর্তও অত্যন্ত মূল্যবান। সর্বদাই আলোকে বেষ্টিত থাকুন, আশাবাদী থাকুন, বাধাগুলো মাড়িয়ে চলুন।ঃভবিষ্যবোধ থাকলে, অমঙ্গলের ওপর মঙ্গলের বিজয় সম্পর্কে বিশ্বাস রাখলে আমরা অবশ্যই পৃথিবীকে বাঁচাতে পারব।'
হেলেনের বইতে বিশ্বপরিবেশ দূষণের সবগুলো কারণই উলিস্নখিত ও আলোচিত হয়েছে, এমনকি তুষারগলনে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির (সঞ্চিত মিথেইন গ্যাসের ভাণ্ডার উন্মোচন, উন্মুক্ত মাটির তাপশোষণ বৃদ্ধি ও সূর্যালোক প্রতিফলনের বিনাশ) কারণগুলোও বাদ পড়েনি। কিন্তু পুঁজিতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি ততটা সোচ্চার নন। হেলেন মনে করেন, নির্বাচনে ভালো লোকদের ক্ষমতাসীন করতে পারলেই সমস্যা সমাধানের সূচনা ঘটতে পারে; আর সে জন্য তিনি ওবামা সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী। তাঁর বইতে পশ্চিমা কর্পোরেট সংস্থাগুলোর সমালোচনা আছে প্রচুর, কেননা তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে শুধু নিরুৎসাহীই নয়, প্রকৃষ্ট প্রতিবন্ধকও। পরিবেশ আন্দোলনের নরমপন্থী ধারার তিনি প্রতিনিধি, যারা পুঁজিতন্ত্রের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান দেখতে পান। কঠোরপন্থীরা বর্তমান উৎপাদন ও পরিভোগ পদ্ধতির, অর্থাৎ পুঁজিতন্ত্রের উৎখাত চান, কিন্তু বিকল্প আর্থ-রাজনৈতিক পরিকল্পনার কোনো নীলনকশা তাদের নেই। এটাই র্যাডিকাল গ্রিনপার্টিগুলোর প্রধান সমস্যা।
পুঁজিতন্ত্রের পতন ও নতুন সভ্যতার সূচনা কবে ঘটবে, সে অপেক্ষার সময় সম্ভবত বাংলাদেশের নেই। আসন্ন ত্রিশ কোটি জনসংখ্যা এবং উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রের আগ্রাসন এখনই আমাদের দারুণ দুশ্চিন্তার বিষয়। উন্নত বিশ্বের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সম্ভাব্য সাহায্যের আশা ক্রমাগতই দুরাশা হয়ে উঠছে। আমাদের এখনই দীর্ঘমেয়াদি একটি থিংক-ট্যাংক গঠন প্রয়োজন, যা শুধু আমাদের আয়াসসাধ্য পরিবেশ দূষণ রোধের বিষয়গুলো নিয়েই নয়, ভাববে দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন নিয়েও; এবং তাতে আশা করি স্থান পাবে প্রবন্ধের শুরুর উপাত্তটিও।
===========================
খুলে যাক সম্ভাবনার দুয়ার  কক্সবাজার সাফারি পার্কঃ প্রাণীর প্রাচুর্য আছে, নেই অর্থ, দক্ষতা  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের গুপ্ত জীবন  ছাব্বিশটি মৃতদেহ ও একটি গ্রেপ্তার  ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি  সাইবারযুদ্ধের দামামা  সরলতার খোঁজে  সেই আমি এই আমি  আমেরিকান অর্থনীতি ডলারের চ্যালেঞ্জ  বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইশতেহার- আশানুরূপ সুফল নেই এক বছরেও  ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাজনীতি  মাস্টারদা সূর্যসেন ও যুব বিদ্রোহ সাতাত্তর  রসভা নির্বাচন ২০১১: একটি পর্যালোচনা  ড. ইউনূস অর্থ আত্মসাৎ করেননি  প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ৩৯ বছর  স্বাধীনতাযুদ্ধের 'বিস্মৃত' কূটনৈতিক মুক্তিযোদ্ধারা  আতঙ্কে শেয়ারবাজার বন্ধঃ বিক্ষোভ  আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম হয়েছে  মানবকল্যাণ আমাদের মন্ত্র  ট্রানজিট নিয়ে সবে গবেষণা শুরু  ভারতের একতরফা সেচ প্রকল্পঃ বাংলাদেশের আপত্তিতে বিশ্বব্যাংকের সাড়া  আমলাদের যাচ্ছেতাই বিদেশ সফর  সরকারের ব্যর্থতায় হতাশাঃ বিরোধী দলের ব্যর্থতায় বিকল্পের অনুপস্থিতি  ক্ষমতা ও গণতন্ত্র  পানি সংকট পানি বাণিজ্য  ২০১০ সালের অর্থনীতি কেমন গেল  গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে বাধা অনেক  কপাটে তালা দিয়ে কেন এই মৃতু্যর আয়োজন  বিজয়ের অর্থনীতি ও সম্ভাবনা  মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লক্ষ্মীর মুখোমুখি  একেই কি বলে আমলাতন্ত্র?  আত্মসমর্পণের সেই বিকেল  আমরা তাঁদের ভুলতে পারি না  সংবিধানের অনেক বক্তব্য পারস্পরিক সংঘাতমূলক  পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক ‘ভবঘুরের’ স্পর্ধা  আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলো না  শুভ নববর্ষ ২০১১- দিনে দিনে বর্ষ হলো গত  এরশাদের বিচারে দুই দলেরই আগ্রহ কম  কিশোরদের সাদামাটা ফল  জিপিএ-৫ পেয়েছে আট হাজার ৫২ জন 

দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ দ্বিজেন শর্মা

নিসর্গবিদ

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.