আন্তর্জাতিক- চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর : একটি পর্যালোচনা by মুহম্মদ মাছুম বিলস্নাহ

ন্তর্জাতিক রাজনৈতিক, সামরিক ্এবং বাণিজ্যিক অঙ্গনে চীন ও ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বর্তমান বিশ্বে একটি আলোচিত বিষয় । এশিয়ার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে কৌশলগত কারণে তিক্ত সম্পর্ক বিরাজ করছে বহুদিন ধরেই ।তা ছাড়া ভারত পাকিস্তানের মধ্যে তিক্ত সম্পর্ক এবং পাকিস্তানকে চীনের সমর্থন ভারত চীনের মধ্যে তিক্ততার আর একটি কারণ।
সীমান্ত বিরোধ, বাণিজ্যিক অসমতা, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চীনের শিল্প-কারখানা স্থাপন এবং ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরিদের ' স্টাপল ভিসা' প্রদান চীন ও ভারতের মধ্যে তিক্ততার কারণও উলেস্নখ করার মত । জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউেিন্সলে স্থায়ী সদস্যলাভের জন্য ভারতের ইচ্ছে চীনের জন্য খুব একট শুভ সংবাদ নয় । অমীমাংসিত রাজনৈতিক ইসু্যসমূহ এবং বর্তমান বাস্তব বিশ্ব পরিস্থিতিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও তিনদিনের এক রাষ্ট্রীয় সফর করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারতে। তার ভ্রমণের পূর্বে ভারতে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, ভারত ও চীনের মধ্যে অত্যন্ত নাজুক সম্পর্ক বিরাজ করছে, এই সম্পর্ক যে কোন সময় ভেঙ্গেও যেতে পারে। অতএব দু'পক্ষকেই অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এবং কৌশলে এগুতে হবে। ওয়েন ভারতের পর-পরই পাকিস্তান সফর করেন। কোন কোন রাজনৈতিক বিশেস্নষক বলছেন ওয়েন জিয়াবাও-এর পাকিস্তান সফর ওবামার ভারত সফরের জবাব ।
আমরা জানি যে, দেশ চীন ও ভারতের মধ্যে অরুণাচল, তিব্বত এবং কাশ্মীরের লাদাখ নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিরোধ চলছে । দেশ দু'টির সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে। সীমান্ত বিরোধ নিয়ে দেশ দু'টির মধ্যে ১৯৬২সালে যুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে চীনের বিজয় হয়। তারপর বিশ্বের নানান ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সব বিরোধের মধ্যেও বাণিজ্য সম্পর্ক সৃষ্টির নতুন যে উদ্যোগ দেশে দেশে দেখা যায় তারই ধারাবাহিকতায় এক সময়ের বৈরী দুই দেশের মধ্যেও বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বপ্রথম ২০০৫ সালে কৌশলগত এবং সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের যাত্রা শুরু হয়। তারপর থেকে দেশ দু'টির মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রতিবছর বেড়েই চলছে। জিয়াবাও সামপ্রতিক ভারত সফরের সময় তিনি ভারতের সঙ্গে এক হাজার ছয়শত কোটি ডলারের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও টপকিয়ে গেছেন। ওবামা তার সামপ্রতিক সফরকালে দেশটির সাথে এক হাজার কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করেন । উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে অগ্রসর দেশ হিসেবে ভারত বিশ্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে । এ কারণে এ দেশটির সাথে বিশ্বের বড় বড় দেশগুলো বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুধুমাত্র আগ্রহী নয় উদগ্রীবও বটে । ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এর শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ভারত সফর করে বিভিন্ন অঙ্কের চুক্তি স্বাক্ষর করে।সেক্ষেত্রে চীন পেছনে থাকলেও অর্থের দিক থেকে সবার চেয়ে বেশি অর্থের চুক্তি চীনই স্বাক্ষর করতে সক্ষম হলো। চীনের প্রধানমন্ত্রী ৪০০ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নিয়ে তিনদিনের ভারত সফর করেন এবং প্রথম দিনই প্রায় ৫০টি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।পারস্পরিক অবিশ্বাসের মধ্যেই বাণিজ্য সম্পর্ক সহযোগিতা বাড়াতে ভারত সফর করেন ওয়েন জিয়াবাও । এর মাধ্যমে পারস্পরিক অবিশ্বাস কমে আসবে বলে মনে হয় । জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ, ইস্পাত, বায়ুশক্তি, নৌসংক্রান্ত যন্ত্রপাতি খাদ্যসহ বিভিন্নখাতে দুই দেশের কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রায় এক হাজার ছয়শত কোটি ডলারের ৫০টি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । ভারত ও চীন ২০১৫ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১০ হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করার বিষয়ে একমত হয়েছে এ বছর যা ৬ হাজার কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ ছিল । চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে উভয়পক্ষ তাদের শক্তি ও সামথ্যর্ের যৌথভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবে বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন । তবে একথা সত্য যে, ভারত ও চীন বাণিজ্যিকভাবে অনেকদূর এগিয়েছে কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেশ দ'ুটির মধ্যে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি । ঝানু রাজনীতিক ওয়েন ভারতের পর পরই পাকিস্তান সফর করেন।পাকিস্তানের সাথেও প্রচুর পরিমাণ বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন । পাকিস্তানের সাথে তিন হাজার ৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে । বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সমপ্রসারণে দেশ দু'টি ৩১টি চুক্তি ও একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বর এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো চীনের কোন প্রধানমন্ত্রী ইসলামাবাদ সফর করেছেন। ইসলামাবাদে ১৮ডিসেম্বর পাকিস্তান-চায়না ফ্রেন্ডশীপ সেন্টার উদ্বোধন করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী । এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী বলেন, "ভারতের সঙ্গে সব ইসু্যতে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় পাকিস্তান।" পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী কামার জামান কয়রা সাংবাদিকদের জানান যে, দু্ই দেশের মধ্যে ৩১ টি চুক্তি ও একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে । জ্বালানি, রেলযোগাযোগ, অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং কৃষিখাতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সমপ্রসারণের লক্ষ্যেই এসব চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে । তথ্যমন্ত্রীর বরাত দিয়ে পাকিস্তানের পত্রিকা ডন জানায় ,এসব চুক্তির আওতায় আগামী পাঁচ বছরে ৩৬টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চীন পাকিস্তানকে সহায়তা দিয়ে যাবে । মূলত এটি পাঁচ বছরের উন্নয়ন পরিকল্পনা । তথ্যমন্ত্রী বলেন এক হাজার পাঁচ শ কোটি ডলার আসবে যৌথ অর্থনৈতিক সহযোগিতা গ্রুপের কাছ থেকে এবং দুই হাজার কোটি টাকা আসবে বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি থেকে । তথ্যমন্ত্রী কামার জানান, চীন সব মিলিয়ে তিনি হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে।
পাকিস্তান চায়না ফ্রেন্ডশীপ সেন্টারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী গিলানী বলেন, আমাদের স্বার্থে, আমাদের জনগণের জীবনমানের উন্নয়নের স্বার্থে আমরা এই অঞ্চলের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আশা করি । এই আকাঙ্ক্ষা থেকে ভারতের সঙ্গে সব ইস্যুতেই শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় পাকিস্তান। জম্মু ও কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও ইসলামাবাদ একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে। এই অঞ্চলের শান্তি ও উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করে পাকিস্তান এমন যেকোন নীতির বিরোধিতা করে । আমরা সার্কের সদস্য হিসেবে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সকল অমীমাংসিত বিষয়গুলোর আশু সমাধান দেখতে চাই । তাদের কাগুজে কথা এবং মৌখিক বিবৃতি আর দেখতে চাই না । আমরা দেশ দু'টোর নেতৃবৃন্দের কথা ও কাজের মিল দেখতে চাই, দেখতে চাই অত্র এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত জনসাধারণের দারিদ্র্যবিমোচন, শান্তি ও নিরাপত্তা । এক্ষেত্রে চীনও উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা আশা করি। শুধু বাণিজ্য চুক্তি নয়, অর্থনৈতিক, সামরিক, সামাজিক এবং শিক্ষা বিনিময় চুক্তিও দেখতে চাই বৃহৎ দুই প্রতিবেশীর মধ্যে।
==========================
দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক


দৈনিক ইত্তেফাক এর সৌজন্যে
লেখকঃ মুহম্মদ মাছুম বিলস্নাহ
আন্তর্জাতিক বিশেস্নষক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.