রাজনৈতিক আলোচনা- দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য by ডা. ওয়াহিদ নবী

ডিসেম্বর দলীয় কার্যালয়ে সমমনাদের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপি ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া মন্তব্য করেন, 'অথচ প্রধানমন্ত্রীর আদেশেই তখন এই সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়' (আমাদের সময়, ৪ ডিসেম্বর ২০১০)। একজন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এত বড় একটা অভিযোগ করার আগে তিনি অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে দেখেছেন বলে আমরা আশা করি। কারণ, তিনি নিশ্চয়ই জানেন, এটা একটা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ। এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে।
বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে প্রধানমন্ত্রীকে গুরুতর শাস্তি পেতে হবে। আর এই বিচারের জন্য বিচারকরা নিশ্চয়ই বেগম জিয়ার কাছে তাঁর অভিযোগের জন্য প্রমাণ চাইবেন। প্রমাণ দিতে না পারলে শাস্তির কী বিধান, তা আমার জানা নেই। তবে জাতির সামনে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তিনি একটি দলের নেত্রী। এই দলটি দুবার নির্বাচনে জিতেছে, জিতে সরকার পরিচালনা করেছে। গত নির্বাচনে আসনসংখ্যা কম পেলেও ভোট পেয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। প্রায় ২৫ বছরের মতো হতে চলল এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর এই অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত না হলে দলটির অপূরণীয় ক্ষতি হবে। হয়তো এই ক্ষতি পূরণ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
এসব চিন্তাভাবনা করে তিনি অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে এই মন্তব্য করেছেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কবে তিনি এসব জানতে পেরেছেন। বিডিআর সদস্যদের বিচার শুরু হয়েছে বেশ কিছু দিন হলো। এর আগে জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রায় ৭০ জন বিডিআর সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। যদি তিনি 'সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হয়েছে'_এই তথ্য আগেই জেনে থাকেন, তবে এ কথা কি তিনি কর্তৃপক্ষের গোচরে এনেছেন? আর যদি তিনি ইদানীং এসব জেনে থাকেন, তবে তিনি ওই সব তথ্য নিয়ে কী করতে যাচ্ছেন? স্বভাবতই সবাই ভাববে, একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে তিনি এসব তথ্য কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করবেন। এতে ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে চলবে। প্রকৃত দোষী শাস্তি পাবে। শুধু তা-ই নয়, যদি তিনি এসব তথ্য কর্তৃপক্ষকে না জানান, তবে তাঁর বিরুদ্ধে কেউ হয়তো তথ্য গোপনের অভিযোগ আনবে। কিংবা হয়তো তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর বিরুদ্ধে গুরুতর অসত্য জনসমক্ষে প্রচারের অভিযোগ তুলবে। হয়তোবা মানহানির মামলা করবে। হয়তোবা সেনাবাহিনীকে উসকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপন করবে_যেটাকে দেশদ্রোহের শামিল বলে মনে করবে সবাই। পত্রিকায় খবরটি দেখে আমি দিশেহারা ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। পরদিন এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে তোলপাড় হবে বলে মনে করি। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, এ ব্যাপারটি নিয়ে কেউ কিছু বললেন না বা কেউ কিছু লিখলেন না। ভাবলাম এমনটা কেন হলো? বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা ভাবলাম, কেন এত বড় একটা খবর সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। অথবা কেন এত বড় একটা খবরকে গায়েই লাগালেন না। আমরা প্রবাসে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দেশের খবর পড়ে থাকি। কারণ, আসল কাগজ কয়েক দিন পরে আসে। আমরা জানি না, খবরটি কাগজের কোথায় ছাপা হয়েছিল? স্বভাবতই মনে হলো, খবরটি কি ভেতরের পৃষ্ঠায় ছোট করে ছাপা হয়েছিল, যে জন্য এটি সবার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। কিংবা খবরটিকে কেউ কি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেননি? ভাবলাম, তা কী করে হয়? বিরোধী দলের নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করেছেন ৫৭ সেনাকর্মকর্তাকে হত্যা করার আদেশ দেওয়ার জন্য। এটাকে সামান্য খবর মনে করতে পারা যায় কি? অবশ্য অতীতে বেগম জিয়া কিছু কিছু বিশাল আকারের মন্তব্য করেছিলেন। যেমন বহুবছর আগে বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে।' সেবার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেছিল; কিন্তু মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যায়নি। আরেকবার তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের একটি অংশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে।' তা হয়নি। হতে পারে এই যে বেগম জিয়ার বিশাল বিশাল উক্তি শুনতে শুনতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই কেউ আর তাঁর আরেকটি বিশাল মন্তব্য গায়ে মাখেননি। কিংবা সবাই হয়তো ভেবেছেন, বাড়ি হারানোর জন্য তিনি এতই মুহ্যমান যে তিনি যা বলেছেন, তাতে মনোসংযোগ করতে পারেননি। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে করা যেতে পারে আর তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী খবরটা দেখেননি। কারণ, তিনি অতি ব্যস্ত থাকায় পত্রিকা দেখার সময় পাননি। সংগত কারণ। কিন্তু সরকারের তথ্য বিভাগ রয়েছে, যাদের কাজ হচ্ছে পত্রপত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা। তারা এ কাজটি করেছে কি না আমাদের জানা নেই। এত বড় একটা অভিযোগের উত্তর না দিলে অনেকে হয়তো ভাববেন, অভিযোগটির মধ্যে কিছু সত্যতা রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হেনরি লুইস ডিরোজিও শিক্ষকতা করতেন। তাঁর অনুসারীরা 'ইয়ং বেঙ্গল' নামে বিখ্যাত হয়েছিল। তিনি তাঁর ছাত্রদের এই বলে শিক্ষা দিতেন, প্রমাণ ছাড়া কিছুই বিশ্বাস করবেন না। যুক্তির শক্তির কথা হল্যান্ডের ইহুদি দার্শনিক 'বারুচ স্পাইনজা' বলেছিলেন। কিন্তু 'কবি হেনরি লংফেলো'র কথামতো মহাজ্ঞানী মহাজনদের আমরা সব সময় অনুসরণ করি না। বরং আমরা ক্ষমতাধর কর্তাব্যক্তিদের অনুসরণ করি অন্ধ মানুষের মতো। কর্তাদের অন্ধ অনুসরণ করার ভয়াবহ পরিণতি আমরা দেখেছি ইতিহাসে অনেকবার।
হিটলারের অনুসারীদের ইহুদি নিধনযজ্ঞের একটা উদাহরণ: 'নিক কোহেন' তাঁর ইদানীং প্রকাশিত একটি বই 'হোয়াইট ইজ লেফট'-এ বলেছেন, 'রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা ফুটবল দলের সমর্থকদের মতা।' অর্থাৎ ফুটবল দলের সমর্থকদের মতো রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা নিজের দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করে। এসব কারণে দলীয় নেতাদের সাবধানে কথাবার্তা বলা উচিত, যাতে দলের সমর্থকরা অযথা উত্তেজিত হয়ে না পড়ে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী-সংক্রান্ত ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের সাবধান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী অতীতে জড়িত হয়ে পড়েছিল এবং এ জন্য রক্তপাত হয়েছে প্রচুর। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের এমন কথা বলা উচিত নয়, যাতে সেনাবাহিনীর উত্তেজিত হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। 'পাবলিক পার্সেপশন' রাজনীতিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো একটা বিষয়ে জনগণ যা ভাবে, তা হয়তো তথ্যভিত্তিক নয়; কিন্তু তবুও তাদের মতামত গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে হবে। তারপর তাদের সত্যটা জানাতে হবে। বাংলাদেশের কিছুসংখ্যক মানুষ মনে করে যে সেনাবাহিনী বিএনপিকে সমর্থন করে। হয়তো কথাটা সত্য নয়; কিন্তু বেগম জিয়ার মন্তব্যটি মানুষকে এমন ধারণা দিতে পারে। সময়ে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে। এক-এগারোর জন্য বিএনপি নেতারা কয়েকজন 'উদ্দিন'কে (ইয়াজউদ্দিনকে বাদ দিয়ে) দোষারোপ করে থাকেন, যাঁদের মধ্যে একজন সেনা নেতা ছিলেন। অধ্যাপক স্টানলি মিলগ্রাম গবেষণা দ্বারা দেখিয়েছেন, কেমন করে সাধারণ মানুষ কর্তাদের মান্য করে। 'ওবিডিয়েন্স টু অথরিটি; এন এঙ্পেরিমেন্টাল ভিউ' এই নামে তিনি একটি বই প্রকাশ করেন। সংক্ষেপে এবং সহজ করে তাঁর পরীক্ষাটি বর্ণনা করছি। মনোবিজ্ঞানের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা এই পরীক্ষাকার্যে অংশ নেন। একজন শিক্ষক ছাত্রদের একটি শব্দ বলেন, যাঁর উত্তরে ছাত্রদের চারটি শব্দের একটি শব্দ বেছে নিতে হবে যেটি সঠিক। ভুল উত্তর হলে ১৫ ভল্ট বিদ্যুৎ দেওয়া হবে (ছাত্ররা জানত না যে আসলে বিদ্যুৎ দেওয়া হয় না)। প্রতি একটি বেশি ভুলের জন্য ১৫ ভল্ট করে বেশি বিদ্যুৎ দেওয়া হয়। ছাত্ররা জানতে পারে কখন বিপৎসীমা পেরিয়ে যাবে। বিপৎসীমা পেরিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কেউ প্রশ্ন করেন। তাঁদের বলা হয় যে খারাপ কিছু ঘটলে তাঁদের দোষ দেওয়া হবে না। গবেষকরা দেখে আশ্চর্য হলেন, ৬৫ শতাংশ ছাত্র ৪৫০ ভল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ দিয়ে দিলেন। আর একটা কথা সবার মনে রাখতে হবে, অন্যকে দোষারোপ করা সহজ, কিন্তু এর পরিণতি সহজ না-ও হতে পারে। অভিযুক্ত ব্যক্তি আপ্রাণ চেষ্টা করবেন নিজেকে নিরপরাধ বলে প্রমাণ করতে। অভিযোগ গুরুতর হলে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাধ্যমতো সবই করবেন, নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কেউ মিথ্যা অভিযোগ করলে অভিযুক্ত ব্যক্তি পাল্টা আক্রমণ করতে পারেন। আরেকটা কথা হচ্ছে, এই যে নীরব সমর্থকরা যতই বাধ্য হোক কর্তাদের অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তাঁরা দুর্বল হয়ে পড়েন এবং গুরুতর পরিস্থিতিতে তাঁরা সমর্থন দেওয়ার জন্য এগিয়ে না-ও আসতে পারেন।
======================
নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?  জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ :নতুন যুগের বার্তাবাহক  প্রশাসনে জনগণের আস্থা অর্জন জরুরি


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ ডা. ওয়াহিদ নবী
লন্ডন প্রবাসী চিকিৎসক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.