মুক্তিযুদ্ধ- শোকের মাস, বিজয়ের মাস by মোস্তফা কামাল

নিশ শ একাত্তর। মার্চ থেকে ডিসেম্বর। মাত্র ৯ মাস। এই ৯ মাসে দেশে অনেক কিছুই ঘটেছিল। হায়েনাদের কালো থাবায় লণ্ডভণ্ড হয়েছিল এই দেশ, মাটি ও মানুষ। সারা দেশ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল পাকিস্তানি সেনাদের দল। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমাদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল ওরা। চেয়েছিল বুটের তলায় পিষে মারতে। মেরেছেও অনেককে। অনেক কিছু হারিয়েছি আমরা।
তার পরও আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। যেমনিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বায়ান্নতে। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য বাঙালি রক্ত দিয়েছিল। বিশ্বের আর কোনো জাতি এভাবে ভাষার জন্য রক্ত দেয়নি। আমরা দিয়েছি। আবার রক্ত দিয়েছি একাত্তরে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছি একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, বাংলাদেশ।
স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক সেই মাস ডিসেম্বর এলেই কেবল আমাদের চেতনা শানিত হয়। আমরা স্মৃতিচারণা করেই আমাদের কাজটি সীমাবদ্ধ রাখি। আমাদের এই অবহেলার কারণেই একাত্তরের পরাজিত শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। এখনো সেই প্রবণতা আমরা দেখতে পাই।
নিশ্চয়ই ডিসেম্বর মাসটি আমাদের জন্য আনন্দের, আবার গভীর শোকেরও। বিজয়ের আনন্দে আমরা যেমন উদ্বেলিত হই, আবার শোকে মুহ্যমান হতে হয় আমাদের। হারানোর বেদনায় চোখ ভিজে আসে।
১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর_এ দিনগুলো বাঙালির শোকের দিন। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্ত ঝরানোর দিন। এ দিনগুলোতে আমরা হারিয়েছিলাম আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। আসলে পাকিস্তানিরা বাঙালি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে চেয়েছিল। মেধায়-মননে বাঙালি জাতি যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য ওরা এ জাতিকে মেধাশূন্য করতে চেয়েছিল। তা না হলে বিজয় লাভের শেষ মুহূর্তে এসে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এত বড় সর্বনাশ কেন করল! কী অপরাধ ছিল তাঁদের! কেন তাঁদের পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হলো!
অপরাধ ছিল একটাই, তাঁরা মেধা-মননে অনেক বেশি অগ্রসরমাণ ছিলেন। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, বাঙালিকে মেধাশূন্য করতে পারলে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সে জন্য পরাজয় নিশ্চিত জেনেও পাকিস্তানি শাসকরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। তারপর সবাইকে গণকবর দেওয়া হয়। এ কাজে পাকিস্তানিদের সর্বতোভাবে সহায়তা করে তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। ওরা রাতের আঁধারে আমাদের সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।
প্রসঙ্গক্রমে আমি আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী জাহিদ রেজা নূরের কথা বলছি। আমার খুব কাছের মানুষ তিনি। প্রথমে তাঁর সঙ্গে সংবাদে কাজ করি। পরে তিনি চলে যান মুক্তকণ্ঠে। আর আমি প্রথম আলোতে। একটা সময় তিনিও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হন। দীর্ঘদিন একসঙ্গে ছিল আমাদের পথচলা। তাঁকে যখনই দেখতাম, চমকে উঠতাম। তাকে দেখলেই সিরাজুদ্দীন হোসেনের কথা মনে পড়ে। তিনি একাত্তরে ইত্তেফাকে কর্মরত ছিলেন। সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহিদ রেজা নূর। তাঁর বড় ভাই শাহীন রেজা নূর আছেন ইত্তেফাকে।
একবার কথা হচ্ছিল জাহিদ রেজা নূরের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কখনো সিরাজুদ্দীন হোসেন প্রসঙ্গে আলাপ করতাম না। যদি তিনি আবেগতাড়িত হয়ে যান। তার পরও লেখার প্রয়োজনে কথা বলতে হলো।
জাহিদ রেজা নূরের কাছে শুনেছিলাম, পাকিস্তানিদের নীলনকশা অনুযায়ী ১০ ডিসেম্বর তাঁর বাবা সিরাজুদ্দীন হোসেনকে হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু বুদ্ধিজীবীদের হত্যা। ৯ ডিসেম্বর তিনি ইত্তেফাকে একটি লেখা লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিল 'এতো দিনে'। এর মূল কথা ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত দিনে স্বীকার করল, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ছিল না। পরের দিন (১০ ডিসেম্বর) রাতে সিরাজুদ্দীন হোসেনের চামেলিবাগের বাসায় আলবদর বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্য আসে। তাদের সবার মুখে কালো কাপড় বাঁধা ছিল। শাহীন রেজা নূর দরজা খোলামাত্র হুড়মুড় করে সবাই ঘরে ঢুকে পড়ল।
তারপর সিরাজুদ্দীন হোসেনকে জিজ্ঞাসা করল, 'আপনি সিরাজুদ্দীন হোসেন?'
তিনি বললেন, 'হ্যাঁ।'
ওরা বলল, 'আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরা আবার আপনাকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।'
তখন সিরাজুদ্দীন হোসেনের পরনে ছিল লুঙ্গি ও গেঞ্জি। তিনি বললেন, 'পাঞ্জাবি পরে নিই?'
ওরা বলল, 'লাগবে না।'
তারপর তিনি গামছা হাতে নিলেন। ওই গামছা দিয়েই তাঁর চোখ বেঁধে গাড়িতে ওঠানো হলো। সেই যে গেলেন আর ফিরে আসেননি তিনি।
এর পরদিন ১১ ডিসেম্বর সাংবাদিক সৈয়দ নজমুল হক এবং ১২ ডিসেম্বর নিজামুদ্দিন আহমেদকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে যায়। তাঁরা কেউ আর ফিরে আসেননি।
পাকিস্তানি শাসকরা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে এই সময়টাকে কেন বেছে নিয়েছিল, সে তথ্য আমাদের জানা নেই। তবে ওরা তালিকা অনুযায়ী ১০ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।
আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করতে চাই। ২০০৫ সালে পাকিস্তান সফরে গিয়ে জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক হামিদ মীরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি জানান, পাকিস্তানের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পূর্ব পাকিস্তানে নির্বিচারে গণহত্যার তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভাও হয়েছিল। তিনি জানান, পাকিস্তানি শাসকরা যখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য পাকিস্তানের প্রশাসনের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল। যদিও এ হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানি শাসকদের বিদায় আরো ত্বরান্বিত হয়।
হামিদ মীর এই লেখককে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা ছিল পাকিস্তানি শাসকদের বড় ভুল।
স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর রাজাকার, আলবদর. আলশামস বাহিনী আমাদের স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। বারবার ওরা আমাদের স্বাধীনতার চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। দেশের শাসনক্ষমতার অংশীদার হয়েছে সেই পরাজিত শক্তি। রাতারাতি পাল্টে দিয়েছে বাঙালির ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস। সেই পাকিস্তানি ভূত এখনো প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির ঘাড়ে ভর করে আছে। এখনো ওরাই এ দেশের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। একটি মহল এখনো পাকিস্তানের চর হিসেবে দেশবিরোধী সুগভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
আমার মনে হয়, স্বাধীনতার পর সেই ভুল আমরাও করেছি। আমরা এ দেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ক্ষমতায় আসার সুযোগ করে দিয়েছি। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগীরা ক্ষমতায় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখনো সে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
বছর ঘুরে ডিসেম্বর এলেই আমরা চেতনায় উদ্ভাসিত হই। জাতীয় স্মৃতিসৌধ, আর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ ঘষামাজা হয়। দিবস দুটি এলে তাঁদের বেদিতে ফুল দিয়ে আমরা আমাদের কাজ শেষ করি। এটাই কি আমাদের করণীয়? আর কিছুই কি করার নেই?
আমরা এখনো কেন পারিনি বুদ্ধিজীবীদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করতে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকাও আমাদের হাতে নেই। অনেক ক্ষেত্রে খবর পাওয়া গেছে, রাজাকাররা তৈরি করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। বর্তমান সরকারও কি পারে না মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি করতে!
সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, রাজাকারদের তালিকা করবে। কিন্তু কবে? কেন দ্রুত এসব কাজ শেষ করা হয় না? উদ্যোগ নিয়ে আবার কেন থেমে যায়?
এই প্রবণতা আমাকে সত্যিই ব্যথিত করে। লজ্জায় মাথা নুয়ে আসে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানতে দেওয়া হয়নি। জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ এবং খালেদা জিয়া সরকার প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলরা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতকায় কোটিপতি হাজার কোটিপতি হয়েছে।
যুগে যুগে প্রমাণিত হয়েছে, ইতিহাস সত্যকেই গ্রহণ করে আর মিথ্যাকে বর্জন করে। দেরিতে হলেও সত্য ইতিহাস রচিত হয়ই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসও রচিত হবে। তবে আমাদের নতুন প্রজন্ম কিন্তু উপলব্ধি করতে পেরেছে যে যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করতে নেই। তাই নতুন প্রজন্ম আওয়ামী লীগের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তারা রায় দিয়েছে।
জাতীয় সংসদেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ দেখার জন্য জাতি অপেক্ষা করছে। আমরা আশা করি, বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ সম্পন্ন করার মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবে।
আমাদের সুপ্রিম কোর্টও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে বাঙালিকে আরেকবার দায়মুক্ত করতে হবে।
বর্তমান সরকারের কাছে আমার প্রত্যাশা, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হয়েছে। জাতিসংঘও বাংলাদেশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। এখন সরকারের সক্রিয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। সরকারের কাছে রয়েছে জনগণের বিশাল রায়। জনগণ সেই রায়ের প্রতিফলন দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।
======================
চীনা প্রধানমন্ত্রীর পাক-ভারত সফর  দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীন মন্তব্য  নতুন প্রজন্ম ও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা  খিলক্ষেতে আগুনঃ কয়েলের গুদামে রাতে কাজ হতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে  ভারতে বিহার রাজ্যের নির্বাচন  স্বপ্ন সত্যি হওয়ার পথে  আমাদের আকাশ থেকে নক্ষত্র কেড়ে নিয়েছিল যারা...  মুক্তির মন্দির সোপান তলে  আবেগ ছেড়ে বুদ্ধির পথই ধরতে হবে  বছর শেষে অর্থনৈতিক সমীক্ষা পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ  দুই কোরিয়ার একত্রিকরণ কি সম্ভব  গ্যাসের ওপর বিপজ্জনক বসবাস  উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ  সময়ের দাবি জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি  জনসংখ্যা বনাম জনশক্তি  ব্যাংকের টাকা নয়ছয় হওয়া উচিত নয়  একটি পুরনো সম্পর্কের স্মৃতিচিত্র  পাটশিল্প ঘুরিয়ে দিতে পারে অর্থনীতির চাকা  ড. ইউনূসকে বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে  সুশিক্ষার পথে এখনও বাধা অনেক  ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ ও মর্যাদাহানির পরিণাম কখনই শুভ হয় না ঘুষ ও লুটপাট উভয়ের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়তে হবে  সুনীতি ও সুশাসন  আমি কেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের পক্ষে  শ্রমিক অসন্তোষ বর্তমান প্রেক্ষিত  জীবন ব্যাকরণঃ দর্জির মুক্তিযুদ্ধ  তথ্যের অধিকার ও জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ  শালীন ও সংযত কথাবার্তা কি শুধু একতরফা হতে হবে?  একটি অসমাপ্ত গল্প  মুসলিম বিশ্বে সেক্যুলারিজমের বর্তমান ও ভবিষ্যত  চীন দেশের কথা  হিকমতে হুজ্জতেদের কথা  মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে বিশ্বসভায়  ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো  বধ্যভূমিতে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান  ভিক্ষাবৃত্তির মুখোশ  লন্ডন ভ্রমণ এবং সুখ-দুঃখের দু'টি কথা  শিক্ষার মানোন্নয়নে চাই যথার্থ মনিটরিং  পান্থজনঃ কী পাই নি তারি হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজী  বাঙালির বৌদ্ধিক ঐতিহ্য  ৭২-এর সংবিধানের আলোকে কি রূপকল্প বদল করা উচিত নয়?


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মোস্তফা কামাল
কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক


এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.