গল্প- 'মহামানুষের গল্প' by রাসেল আহমেদ

মার আট বছরের মেয়ে টিকলী প্রায় ছুটতে ছুটতে এল। সামান্যতেই ওর খুব ছোটাছুটির স্বভাব। আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে রে, মা?

'বাবা, মহাপুরুষ অর্থ কি খুব বড় কোনো পুরুষ? বয়স্ক?'
আমি বললাম, না রে। কিন্তু কেন, বল তো?
'অর্থটা বলো না_'
'মহাপুরুষ মানে হলো মহৎ পুরুষ। যাঁরা পরোপকার করে বেড়ায়, নিজের কথা সামান্যও চিন্তা করে না_তাঁরাই মহাপুরুষ।'
টিকলী চোখ বড় বড় করে বলল, আর মহৎ মহিলা! যাঁরা শুধু অন্যের উপকার করতে চায়? তাঁরা কি মহামহিলা, বাবা?
আমার বড় ছেলে টোপন আমার পাশেই টিভি দেখছিল। সে অবিকল বড়দের মতো হো হো করে হাসতে লাগল। সোফাটাও নড়ে উঠল।
টিকলী অবাক হয়ে প্রথমে ভাইয়ের দিকে তাকাল, তারপর আমার দিকে।
'বাবা, মহামহিলা হয় না বাবা? মহিলারা অন্যের উপকার করে না?'
আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। তারপর মেয়েটাকে টেনে কোলের ওপর বসালাম। রেশমের মতো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, হবে না কেন মা? নিশ্চয়ই হয়, নিশ্চয়ই হয়! তুই কি মহামহিলা হতে চাস?
টিকলী আমার গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর লজ্জাবতী লতার মতো মিইয়ে যেতে যেতে বলল, হুঁ বাবা!
টোপন হাসতেই থাকল।
এরপর থেকেই দেখা যেতে লাগল আমার মেয়ের মহামহিলা হওয়ার চেষ্টা। কোনো ভিখিরি এলে দেখা গেল, সে তার কৌটায় জমানো সব টাকাই দিয়ে দিল। কিংবা দেড় মুঠো চালের বদলে কনডেনসড মিল্কের কৌটার এক কৌটা চাল দিয়ে দিল। মেয়ের মা পারতপক্ষে ওকে আর ভিক্ষে দিতে দেন না। আমি তখন ওর মাকে বাধা দিতে বারণ করলাম। বললাম, যা ইচ্ছা করুক।
একদিন দেখা গেল, আমাদের পাশেই যে বস্তি, সেখান থেকে একটা মেয়েকে এনে খাওয়ার টেবিলে বসিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছে। মেয়েটা গোগ্রাসে খাচ্ছে_আর টিকলী, আমার স্ত্রীর মতো গলায় বলছে, আরেক চামচ ভাত দিই?... এক হাতা ডাল নেবে?...সবজিটুকু নাও, শক্তি হবে খুব।...তোমার হাড় খুব ভালো লাগে? আচ্ছা, এই নাও।...
আমার স্ত্রী মাঝেমধ্যে গজগজ করে রাগে। তবু কিছু বলে না।
কিছুদিন পর দেখা গেল_মেয়েটা নিজে তো খাচ্ছেই, যাওয়ার সময় একটা পলিথিনে ভাত-তরকারি নিয়ে যাচ্ছে।
রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমার স্ত্রী বলল, অ্যাই, টিকলীর সঙ্গে যেই মেয়েটা আসে_বস্তির, ওকে আমার একটুও ভালো লাগে না। তুমি ওকে আসতে বারণ করে দাও।
আমি বললাম, কেন? মেয়েটাকে তো ভালোই মনে হলো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও। আর এক-দুবেলা খেলে বুঝি খুব সমস্যা হবে?
আমার স্ত্রী বলল, সমস্যা না। কিন্তু আজকাল মেয়েটাকে আমার একটুও ভালো লাগে না। আগে নিজে এসে খেত, ইদানীং নানির জন্যও নিয়ে যায়। সেটাও সমস্যা হতো না, কিন্তু কাল দেখলাম, পরপর তিনবার ভাত নিয়ে গেল।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তিনবার! তিনবার নেবে কেন? বাড়িতে তো ওর নানি একলা থাকে শুধু।
'তাই তো বলি, তুমি টিকলীকে একটু বোঝাও। ওর মহাপুরুষ হওয়ার দরকার নেই।'
'মহাপুরুষ না, মহামহিলা।' আমি হাসতে হাসতে বলি।
.২.
'কেমন আছ মা?'
মেয়েটি সসংকোচে বলল, ভালো আছি।
'তোমার নাম যেন কী?'
'আয়শা।'
'তোমার বাড়িতে কি শুধু তোমার নানিই থাকেন?'
এবার টিকলী কথা বলে উঠল, 'হ্যাঁ বাবা। ওর আব্বা-আম্মা ওকে ছেড়ে চলে গেছেন।'
আমি আয়শার দিকে তাকালাম। কিভাবে কথাটা বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আর টিকলীর সামনে বোধ হয় কথাটা বলা ঠিকও হবে না। তার চেয়ে বরং মেয়েটা যা করছে করুক না। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কারণ আছে।
মেয়েটা কিছু বুঝতে পারল কি না কে জানে। তবে আমাকে বলল, 'চাচা, আপনে আইজ দুপারে আমার লগে যাইবেন? আমাগো ঘরে?'
আমি ইতস্তত করছি দেখে টিকলী বলল, নিশ্চয়ই যাবে_আজ তো তোমার অফিস বন্ধ, তাই না বাবা?
আমি বললাম, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
আয়শার ঘরটা গোলপাতার। ঢাকা শহরে যে গোলপাতার ঘর আছে_জানতাম না। মাথা নুইয়ে ঘরে ঢুকে দেখলাম, এক বৃদ্ধা শুয়ে আছেন, তাঁকে ঘিরে চারজন ছেলেমেয়ে; হাড় জিরজিরে। আয়শা ঘরে ঢুকতেই বাচ্চারা সব হই হই করে উঠল এবং সবাই তখনই মাটির ছোট্ট বাটি নিয়ে বসে পড়ল। তারা বোধ হয় আগে থেকেই তৈরি ছিল। আয়শা তার হাতের পলিথিন থেকে সবাইকে ভাত-তরকারি দিতে লাগল। আমাকে বলল, 'অরা পাশের ঘরগুলায় থাহে। কেউর মা-বাপই দুপারে খাইবার দিবার পারে না। অরা কেউ খিদাও সইতে পারে না।' একটু থেমে বলল, 'আমার মতো।'
ইতিমধ্যেই একটা বাচ্চা চেঁচিয়ে উঠল, আর কয়টা ভাত। আর কয়টা ভাত।
আয়শা আজ ভাত বেশিই এনেছে। ওর সঙ্গে টিকলীও ভাত দিতে লাগল। আমি সিগারেট খাওয়ার কথা বলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। একটু পরই টিকলী এসে আমার পাশে দাঁড়াল। আমার হাত ছুঁয়ে বলল, আয়শাও মহামহিলা_তাই না বাবা?
আমি মাথা ঝাঁকালাম। তারপর আলগোছে হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছে ফেললাম। টিকলী যাতে দেখতে না পায়। বড়দের চোখের জল ছোটদের দেখতে দিতে নেই।
=============================
গল্পালোচনা- 'যেভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়!' by আলী হবিব  জলবায়ু সম্মেলনঃ আমি কেন কানকুনে যাচ্ছি? by মেরি রবিনস  ভ্রমণ- 'মেঘনায় যায় মেঘনা রানী' by সালেক খোকন  ভ্রমণ- 'গন্তব্য নাফাখুম' by জাকারিয়া সবুজ  আলোচনা- 'এখনো একটি গ্রেট গেইম অস্বস্তিকরভাবে প্রাসঙ্গিক' by এম আবদুল আজিজ  গল্পসল্প- জীবন ঢেকে যাচ্ছে বালুতে  প্রকৃতি- কোপেনহেগেন থেকে কানকুনঃ সময় এসেছে মুহূর্তটিকে কাজে লাগানোর by জেমস এফ মরিয়ার্টি  আলোচনা- দরিদ্র মানুষের পাঁজরের ওপর দুর্দান্ত পাজেরো  বিএনপির মিছিলে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের পিটুনি  খবর কালের কন্ঠের- হরতালের ধরপাকড় চলছেই  খবর- খুনের মামলা প্রত্যাহার, শীর্ষ সন্ত্রাসীর অব্যাহতি by নজরুল ইসলাম  প্রকৃতি- চট্টগ্রামে ঐতিহ্যের পাহাড় কেটে বহুতল ভবনঃ সুরক্ষার পরিকল্পনা ধ্বংসের অনুমোদন  প্রকৃতি খবর- জলবায়ু সম্মেলন আজ শুরু  রাজনৈতিক আলোচনা- 'পুলিশই কি হরতাল সফল করে দেয়' by আবেদ খান  আইন কানুন- 'বাহাত্তরের সংবিধান ফিরছে না' by আহমেদ দীপু  আইরিন খান বললেন,'নারীর মানবাধিকার রক্ষায় আরও সক্রিয় হতে হবে' সুত্র প্রথম আলো  আইন কানুন- চাই বিরোধের বিকল্প নিষ্পত্তি by রোমেল রহমান  আইন কানুন- ভরণপোষণ একটি আইনি অধিকার by মাসূমা তাসনীম  আইন কানুন- অর্থঋণ আদালত আইনে অনেক গলদ by এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম  আইন কানুন- গাড়ি আটক হলে মালিকের করণীয় by মো. রাশেদ খান  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'আমাদের রাজনীতিতে বখাটেপনা' by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম


দৈনিক কালের কন্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ রাসেল আহমেদ


এই গল্প'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.