গল্প- 'স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত' by এম ইব্রাহিম মিজি
তাঁর
কাঁধে সব সময় দেখা যাবে বেশ বড় একটা বোঁচকা। খুবই নোংরা, খুললেই উৎকট গন্ধ
বের হয়। বোঁচকার ভেতরে থাকে রাজ্যের জিনিস, নানা রকম ওষুধপথ্য। একটা হাড়ও
আছে। কিসের কে জানে। কতকগুলো পুঁটলি আর নানা রকম ছালবাকল হাত দিয়ে ঘাঁটতে
ঘাঁটতে সবুজ, হলুদ আর কালো তেলতেলে কিছু পদার্থ শুক্কুরী বেগম যত্ন করে
বিভিন্ন শিশিতে ভরে রাখেন। এগুলো দিয়ে ওষুধ বানাতে আজকাল তাঁর খুব কষ্ট হয়।
বয়স ও দারিদ্র্যের কশাঘাতে দৃষ্টিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তাই শুক্কুরী বেগম
খুব কম দেখেন। চোখের ওপর পর্দা পড়েছে_ধূসর একটা কষ্টের, অভাবের আর
স্বপ্নভঙ্গের। একসময় কত স্বপ্ন ছিল তাঁর দুচোখ জুড়ে! কত রঙের স্বপ্নঘর হবে,
সংসার হবে, দুবেলা দুমুঠো ভাত পেট ভরে খেতে পারলেই হলো, পরনের শাড়িটি
ছেঁড়া হবে না! একে একে সব আশাই শেষ হয়েছে। স্বপ্নরা কেবলই থেকে গেছে স্বপ্ন
হয়ে, সত্য হয়নি একটিও। শুক্কুরী বেগম চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বাতাসে তাঁর
রুক্ষ চুল ওড়ে, চোখের কোনায় জমে ওঠে দুফোঁটা নোনা জল। বাইরে থেকে কে যেন
ডেকে ওঠে_এদিকে আয় শুক্কুরী। কী অদ্ভুত নাম! তাঁর বাবা ভেবেছিলেন, ওর নাম
শুক্কুরী রাখলে আর কোনো কষ্ট হবে না। ছোটবেলায় সবাই তাঁকে শুকু বলে ডাকত।
আহা! শৈশবের সেই আদরের ডাক। কত দিন চলে গেছে তাঁর অবহেলা আর অনাদরে! খুব
ভোরবেলায় তাঁর ঘুম ভেঙে গেল, বুকের ভেতর কেমন যেন হাঁসফাঁস করে, কামার যেমন
হাতুড়ি পেটায়। ভোরে উঠেই একটু দূরে বড় মাঠে চলে যান, কাঁপা কাঁপা হাতে ইট
ভাঙেন। কষ্ট হয়, খুব কষ্ট। তবু করতে হয়, জীবিকার তাগিদে। এটি তাঁর নেশা ও
পেশা নয়। হ্যাঁ, অদ্ভুত এক পেশা আছে তাঁর, বোঁচকার ভেতর ছোটখাটো অফিস।
কিন্তু তাঁর এ পেশা আজকাল চলে না বললেই হয়। মানুষ এখন অন্য রকম আবিষ্কারের
নেশায় ছুটছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। তার পরও সকাল একটু গড়াতে শুক্কুরী বেগম
বের হন। ক্লান্ত পায়ে ঘুরে বেড়ান শহরের অলিগলি। মাথার ওপর ঝলমলে সূর্যটাকে
সাক্ষী রেখে চিৎকার করেন শিঙ্গা দেবেন কেউ, শিঙ্গা। এই তাঁর পেশা। তিনি
শিঙ্গাওয়ালি। পরনের শাড়িটি শতচ্ছিন্ন, পায়ে জোড়াতালি দেওয়া একটা চপ্পল আর
কাঁধে একটা বোঁচকা। বোঁচকার ভেতর কালো বাঁকানো একটা শিং। শুক্কুরী বেগমের
এটাই মূলযন্ত্র। কেউ কেউ তাঁকে ডাকে, নানা রকম ব্যথার কথা বলে। তিনি ব্যথার
জায়গায় শিঙ্গাটা বসান, কিছু তন্ত্রমন্ত্র পড়েন, টেনে বের করে আনেন রক্ত।
তারপর ওষুধ দেন। সে কত রকম ব্যাপারস্যাপার! মাঝে মাঝে কাঁধের বোঁচকাটাকে
পাহাড়সমান ভারী মনে হয়, পা চলতে চায় না, খিদেয় কথা বন্ধ হয়ে আসে। আকাশের
দিকে তাকান তিনি, ওখানে নাকি ঈশ্বর থাকেন। তিনি সব কিছু দেখেন। সবার
দুঃখকষ্ট বোঝেন, কই, তাঁকে তো দেখেন না? দুঃখের সাগরে ভাসতে ভাসতে শুক্কুরী
বেগম আজ আর শূন্য আকাশের দিকে মুখ তোলেন না। তাঁর চোখের সামনে একে একে
ভেসে ওঠে ভয়াবহ বন্যা, মাতব্বরের শয়তানি, স্বামীর প্রতারণা, অভাবের
অত্যাচার, কষ্ট_কত কষ্ট! সব ভুলে সামনে চলেছেন শুধু এই জীবনটার জন্য। জীবন
তো এগিয়ে চলে জীবনের মতোই। আজকাল মানুষও তাঁকে আগের মতো ডাকে না। লতাপাতা,
শেকড়বাকড়ের ওষুধে আর বিশ্বাস নেই কারো। তবু মধ্যদুপুরে রাজধানীর পথে পথে পা
ফেলে চলেন। অদৃশ্য কারো উদ্দেশে চিৎকার করেন_শিঙ্গা দেবেন গো, শিঙ্গা।
হয়তো জবাব আসে, আনন্দ ঝিলিক দেয় তাঁর চোখে-মুখে। দ্রুত গন্তব্যের উদ্দেশে
পা বাড়ান। গন্তব্যহীন এক নিঃশব্দ নারী শুক্কুরী বেগম। তারপর সময় গড়ায়,
সূর্য ডোবে, আসে রাত। হাঁড়িতে টগবগ করে চাল ফোটে_শুক্কুরী বেগম আগামীকালের
কথা ভাবেন। কোনো প্রত্যাশায় নয়, শুধু বেঁচে থাকার জন্য। আগামীকাল আরো একটি
দিন, শূন্য হাঁড়িতে এ চাল কালকেও ফুটবে তো?
=========================
দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ এম ইব্রাহিম মিজি
দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ এম ইব্রাহিম মিজি
No comments