আলোচনা- 'পায়ে পড়ি বাঘ মামা, বেঁচে থাকো' by মহসীন হাবিব

মাত্র ১০০ বছর আগে পৃথিবী নামের এই গ্রহে মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫০ কোটি। এই ১০০ বছরেই বুড়িয়ে গেছে লাখ লাখ বছরের সবুজ যৌবনা ধরিত্রী। এ জন্য দায়ী আধুনিক মানুষ। মাত্র ১০০ বছরে পৃথিবীর লোকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০০ কোটির বেশি। আবাসন সংকট, খাদ্যের সন্ধান এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মানুষ তার থাবা ছড়িয়ে দিয়েছে মালভূমি, মরুভূমি, সাগর-মহাসাগর সর্বত্র। মানুষের এই বিস্তার, বন উজাড়সহ বহুমুখী অবিচারের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি একদিকে বিলুপ্তির পথে ইথিওপিয়ার জাতীয় প্রাণী হরিণ প্রজাতির ওয়ালিয়া আইবেঙ্, অন্য প্রান্তে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে মিঠা পানির কুমির, শকুন, কোবরাসহ অসংখ্য বিরল প্রজাতির জলজ, উভচর ও বন্য প্রাণী। একদিকে বিলুপ্তির মুখে ব্রাজিল উপকূলের নীল তিমি বা উরু নামের বনমোরগ, অন্যদিকে বরফাচ্ছাদিত সাইবেরিয়ার নেকড়ে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরুর জীবন পর্যন্ত মেশিনের শব্দে বিঘি্নত করে দিচ্ছে। আবার বাণিজ্যিক শিকার, ধর্মীয় কুসংস্কার ও বনৌষধির প্রয়োজনে নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে বিরল সব প্রাণী। মানুষ তার বুদ্ধিকে নিষ্ঠুর শক্তিতে পরিণত করে অনধিকারকে করছে অধিকার, খর্ব করে চলেছে প্রাণিকুলের টিকে থাকার পরিবেশ ও প্রয়োজনীয়তাকে। যতই মানুষের তথাকথিত উন্নয়ন বিস্তৃত হচ্ছে, ততই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে প্রাণিকুলের টিকে থাকার অপরিহার্য উপাদান প্রকৃতি। কেবল বিশ্বের সচেতন কিছু মানুষ এবং বণ্য প্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই এখন অনুধাবন করতে পারছে যে পৃথিবী নামের এ গ্রহের প্রাণিজগতের ভারসাম্য বা ইকো-সিস্টেম টিকিয়ে রাখতে হলে একটি চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। তাই তাদের মধ্যে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং প্রকৃতি ধ্বংস হওয়া নিয়ে উদ্বেগের কোনো সীমা নেই। প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হলেও পশ্চিমা বিশ্ব প্রাণী সংরক্ষণ ও প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি করতে উদ্যোগী হয়ে উঠেছে। আশার কথাই বটে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের বন ও প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, ভারসাম্য রক্ষায় বিভিন্ন অঞ্চলের ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বাঘ রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন, বাঘ না থাকলে প্রকৃতির ভারসাম্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। কিন্তু বাঘের টিকে থাকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা বর্ণনা করা কঠিন। যেমন বাংলাদেশের সুবিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কয়টি এখন বেঁচে আছে তার প্রকৃত হিসাব কারো জানা নেই। বলা হচ্ছে, ২০০ বাঘ আছে। অথচ এক সময় ৪০ হাজার মূল্যবান বাঘ ছিল এই ভুবনবিখ্যাত সুন্দরবনে। হিমালয় পর্বতমালায় পাকিস্তান থেকে শুরু করে চীন পর্যন্ত একটি ট্র্যাকে মাত্র ৫০ বছর আগেও দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেড়িয়েছে এক বিরল প্রজাতির স্নো টাইগার। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এখন সেখানে মাত্র ৩০টি বাঘ টিকে আছে। একমাত্র সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলে ৪০০ থেকে ৫০০ আমুর বাঘ টিকে আছে। এর প্রধান কারণ বরফের সে রাজ্যে মানুষের পদচারণা এখনো তেমনভাবে শুরু হয়নি। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন প্রকৃতি, বিশেষ করে বাঘের বিলুপ্তির ব্যাপারে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। পুতিনের এ প্রকৃতিপ্রেম নিয়ে আরো একবার লিখেছিলাম।
পুতিনের দেশ রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে এবার বসেছিল টাইগার সামিট। এশিয়ার বাঘ বসতির ১৩টি দেশ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। দেশগুলো হচ্ছে চীন, লাওস, নেপাল, ভুটান, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, রাশিয়া, মিয়ানমার, ভারত ও বাংলাদেশ। চার দিনের এ বাঘ সামিটে অংশগ্রহণ করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, জনপ্রিয় হলিউড তারকা লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং গিয়েছিলেন এ সম্মেলনে। এ ছাড়া প্রকৃতি রক্ষাবিষয়ক কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও অংশ নিয়েছে।
স্বাগতিক রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন। গান্ধী বলেছিলেন, A country that is good for the tiger is good for everybody অর্থাৎ যে দেশ বাঘের জন্য অনুকূল, সে দেশ সবার জন্য অনুকূল। সম্মেলনে উদ্বেগের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, পৃথিবীতে এক লাখ বাঘ ছিল, এখন টিকে আছে মাত্র ৩২০০ বাঘ। এর প্রধান কারণ বন উজাড় হয়ে যাওয়া, হত্যা করে বাঘের চামড়া বিক্রি করা, চীনের ঐতিহ্যবাহী ওষুধ তৈরির প্রয়োজনে বাঘ শিকার_এ সব। গ্লোবাল টাইগার রিকভারি প্রোগ্রাম হিসাব করে দেখিয়েছে, এ দেশগুলোর বাঘ সংরক্ষণে ১২ বছরের পরিকল্পনায় অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রয়োজন। এ সম্মেলন থেকে দাতাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে এগিয়ে আসতে। বাঘের প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল জনপ্রিয় হলিউড তারকা ডি ক্যাপ্রিও এক মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ১৩টি দেশ বাঘ রক্ষায় একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে একটি বাঘের কালোবাজারে মূল্য ৫০ হাজার ডলার। রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বাঘ শিকার করে তা কালোবাজারে, বিশেষ করে চীনের বাজারে, বিক্রি করা হয়ে থাকে। আর এ কাজটি করে থাকে একাধিক আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্র। সম্মেলনে দেশে দেশে বাঘ হত্যার শাস্তি কঠোর করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ সম্মেলন বাঘ রক্ষায় কতটা কার্যকর হয় সেটা এখন দেখার বিষয়। আলোচনা খারাপ হয়নি। সঠিক জায়গাগুলোতেই অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয়েছে সম্মেলন থেকে। কিন্তু তার পরও বাঘ শিকার বন্ধ হবে বলে মনে করা কষ্টকর। এর বহু কারণ আছে। যেমন ধরা যাক বাংলাদেশের কথা। সম্প্রতি বন্য পশু হত্যার জন্য তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান করা হয়েছে। এটিকে অনেকে মনে করছেন যথেষ্ট হলো। কিন্তু এ আইন কি বাঘ পাচারের সুযোগকে নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট? ৫০ হাজার ডলার লাভের লোভ কি আমাদের দেশে একজন অপরাধীর কাছে তিন বছরের শাস্তির (তাও আবার সম্ভাবনা মাত্র) চেয়ে অধিক আকর্ষণীয় নয়? প্রকৃতপক্ষে বাঘ রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন চীনের পান্ডা হত্যা আইনের মতো শাস্তির বিধান রাখা। চীনে পান্ডা হত্যার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এ আইন প্রণয়নের পর থেকে পান্ডা হত্যা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে! অধিকন্তু দেশে দেশে বাঘ রক্ষা করার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি খুবই জরুরি।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সময় যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার বারবার টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠে সেই বাঘকে যদি সত্যিই রক্ষা করতে হয় তাহলে শুধু সম্মেলনে যোগ দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলে চলবে না, প্রয়োজন সত্যিকার রেড অ্যালার্ট। তা না হলে কালক্রমে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বুক থেকে হারিয়ে যাবে বাঘ। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে ইকো সিস্টেম, ধ্বংস হয়ে যাবে এমনকি মানব সভ্যতাও। উইলিয়াম ব্লেইকের বিখ্যাত কবিতা আছে দি টাইগার। এখনো ছেলেমেয়েরা আবৃত্তি করে_
Tiger, tiger burning bright
In the forest of the night,
What immortal hand of eye
Could frame thy fearful symmetry?
ফিকে হয়ে যাবে এ কবিতা। ফিকে হয়ে যাবে গোপী গাইন বাঘা বাইনের সেই বিখ্যাত গান, পায়ে পড়ি বাঘ মামা... তুমি যে এ ঘরে কে তা জানত?
একবার মহাসত্য তাঁর ছোট ভাইকে নিয়ে পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ একটি হাড়সর্বস্ব বাঘিনীকে দুটি ছোট বাচ্চাসহ দেখতে পেলেন। বাঘিনী এতটাই ক্ষুধার্ত যে নিজের একটি বাচ্চা খেয়ে ফেলার উপক্রম করছে। মহাসত্য সঙ্গে সঙ্গে ভাইকে ত্যাগ করে বাঘের সামনে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু বাঘিনী এতটাই দুর্বল যে তাকে খাবার শক্তি পর্যন্ত তার নেই। মহাসত্য তাঁর শরীর ফুটো করে রক্ত বের করে দিলেন। বাঘ সে রক্ত পান করে শক্তি জুুগিয়ে তাঁকে ভক্ষণ করল। এবার মহাসত্য বোধিসত্যরূপে ধরাধামে পুনর্জীবন লাভ করলেন। এ কাহিনী পুরাণের। নিজেকে বাঘের সামনে খেতে দেওয়া কোনো বাস্তবসম্মত হিসাব নয়। কিন্তু পুরাণের এ কাহিনীতে একটি মেসেজ আছে। বাঘকে স্বাভাবিক জীবনধারণের অধিকার দেওয়া আমাদের কর্তব্য। লোকালয়ে বাঘ ঢুকলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়াই শ্রেয়, পিটিয়ে হত্যা করা নয়। এ কথা বাংলাদেশের মানুষকে এখন উপলব্ধি করতে হবে। তবে একটি কথা পৃথিবীর সব রাষ্ট্র, জাতি, সব সম্মেলনকারী, সব উদ্বিগ্ন মানুষকে বুঝতে হবে_যদি বন্য প্রাণী সংরক্ষণ করতে হয় তাহলে দেশে দেশে মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হবে। দারিদ্র্য কোনো আইন মানে না, কোনো সচেতনতা মানে না। পৃথিবীর যে সব দেশ প্রকৃতির বড় বড় ক্ষতিসাধন করে শিল্পোন্নত হয়েছে, তাদেরই ওই উন্নতির একটি ক্ষুদ্র অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শেয়ার দিতে হবে। এ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা না করে শুধু আইন, সচেতনতা ও সামান্য অনুদান দিয়ে প্রকৃতিকে রক্ষা করা যাবে না।
================================
আন্তর্জাতিক- 'পুরনো বন্ধুকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত চীন  আমরাই পারি 'দ্বিতীয় রাজধানী' গড়তে  খবর- পুলিশি হরতাল  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'উপদেশের খেসারত'  গল্প- 'স্বপ্নভঙ্গের ইতিবৃত্ত'  স্মরণ- 'জগদীশচন্দ্র বসুর কথা বলি'  যুক্তি তর্ক গল্পালোচনা- 'প্রধানমন্ত্রী কি হরতাল চান?  ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা রাজনীতির নতুমাত্রা  খবর, বিএনপি কর্মীদের দাঁড়াতে দেয়নি পুলিশ  গল্প- 'আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসারে'  গল্প- 'মহামানুষের গল্প' by রাসেল আহমেদ  গল্পালোচনা- 'যেভাবে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়!' by আলী হবিব  জলবায়ু সম্মেলনঃ আমি কেন কানকুনে যাচ্ছি? by মেরি রবিনস  ভ্রমণ- 'মেঘনায় যায় মেঘনা রানী' by সালেক খোকন  ভ্রমণ- 'গন্তব্য নাফাখুম' by জাকারিয়া সবুজ  আলোচনা- 'এখনো একটি গ্রেট গেইম অস্বস্তিকরভাবে প্রাসঙ্গিক' by এম আবদুল আজিজ  গল্পসল্প- জীবন ঢেকে যাচ্ছে বালুতে  প্রকৃতি- কোপেনহেগেন থেকে কানকুনঃ সময় এসেছে মুহূর্তটিকে কাজে লাগানোর by জেমস এফ মরিয়ার্টি  আলোচনা- দরিদ্র মানুষের পাঁজরের ওপর দুর্দান্ত পাজেরো  বিএনপির মিছিলে পুলিশ ও সরকার সমর্থকদের পিটুনি  খবর কালের কন্ঠের- হরতালের ধরপাকড় চলছেই  খবর- খুনের মামলা প্রত্যাহার, শীর্ষ সন্ত্রাসীর অব্যাহতি by নজরুল ইসলাম  প্রকৃতি- চট্টগ্রামে ঐতিহ্যের পাহাড় কেটে বহুতল ভবনঃ সুরক্ষার পরিকল্পনা ধ্বংসের অনুমোদন


দৈনিক কালের কণ্ঠ এর সৌজন্যে
লেখকঃ মহসীন হাবিব
সাংবাদিক

এই আলোচনা'টি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.