জম্মু ও কাশ্মীরের সহিংসতা থামাতে গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানো প্রয়োজন

ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মীরের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শ্রীনগরে চলমান সহিংসতা দমনে দাঙ্গা দমন বাহিনীকে সাহায্য করতে ৭ জুলাই রাজপথে নেমে আসে সেনাবাহিনী। এই প্রথম বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরে বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী ব্যবহার করছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সহিংসতা বন্ধের কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না।
এই সংকট সমাধানের উপায় খুঁজে পেতে সমস্যায় পড়েছেন কাশ্মীরের রাজনীতিকেরা। তাঁদের মতে, এই সংকট সমাধানের জন্য সেখানে দরকার বড় ধরনের নগরায়ণ কর্মসূচি, বিক্ষোভ দমনে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্থানীয়ভাবে আরও বেশি গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানো।
গত জুনে শুরু হওয়া সাম্প্রতিক এই বিক্ষোভে এ পর্যন্ত সেখানে কমপক্ষে ১৪ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। আশঙ্কা রয়েছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান অমরনাথগামী তীর্থযাত্রীরা বিক্ষোভকারীদের হামলার শিকার হতে পারেন। এতে জম্মুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
শ্রীনগরের রাজপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে পাথর নিক্ষেপকারী এই বিক্ষোভকারীদের পরিচয় কী? জানা গেছে, এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত পুলিশের হামলায় নিহত ২১ জনের অর্ধেকের বেশি শ্রীনগরের স্থানীয় বাসিন্দা। এই সময়ে আহত ৭২ জনের মধ্যে ৩২ জনই এই শহরে বসবাস করেন। পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষে শ্রীনগরে ১৪১ জন কর্মকর্তা ও ৬২ জন সিআরপিএফ (সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স) সদস্য আহত হয়েছেন। পুরো কাশ্মীরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আহত হয়েছেন ৬২৩ জন।
গত প্রায় সাত মাসে কাশ্মীরে ২৬৯টি সংঘর্ষের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে কাশ্মীরের উত্তরাঞ্চলীয় বন্দরনগর বারামুল্লাতে ৪৬টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আপেল কেনাবেচার জন্য প্রসিদ্ধ পাশের সোপোরে শহরে ২১টি সংঘর্ষ হয়েছে। এবারের গ্রীষ্মে মোট সংঘর্ষের সাড়ে ৬৯ শতাংশ ঘটেছে শ্রীনগরসহ এই তিন শহরে। গত বছরও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। জম্মু ও কাশ্মীরে ওই সময় ২৯০টি সংঘর্ষ হয়েছিল।
সহিংসতার ধরন দেখে ধারণা করা হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে নয় বরং হতাশা থেকে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় স্থানীয় তরুণেরা রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। ভারতের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়েবা-সমর্থিত নেতা সৈয়দ আলী শাহ গিলানির পক্ষে তাঁরা স্লোগান দিচ্ছেন।
গিলানির নেতৃত্বাধীন দল তেহরিক-ই-হুরিয়াতের নেতারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য স্থানীয় কর্মীদের অর্থ দিয়েছেন—এমন প্রমাণ পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ। জানা গেছে, বড় পরিসরে কর্মকাণ্ড পরিচালনার মতো রাজনৈতিক নেটওয়ার্ক তেহরিক-ই-হুরিয়াতের না থাকলেও এই বিক্ষোভের সমন্বয়কের ভূমিকায় রয়েছে তারা। বিক্ষোভের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য মসজিদ থেকে শুরু করে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠানোর পদ্ধতিও ব্যবহার করছেন এই দলের কর্মীরা। এর মাধ্যমে তাঁরা রাজপথে বেশি পরিমাণ বিক্ষোভকারী জড়ো করার চেষ্টা করছেন।
গত বছর স্থানীয় ধর্মীয় নেতারা বিষয়টি ধরতে পেরেছিলেন। জামায়াত আহল-এ-হাদিস নামের স্থানীয় একটি সংগঠনের সভাপতি শওকত আহমেদ শাহ পাথর নিক্ষেপের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। কাশ্মীরের গ্র্যান্ড মুফতি মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন তাঁকে সমর্থন করেন। তবে হুরিয়াত নেতা গিলানি বলেন, তরুণেরা পাথর ছুড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। স্থানীয় তরুণদের সংগঠন ইসলামিক স্টুডেন্টস লিগের নেতা শাকিল বকশি এই বিক্ষোভকে ফিলিস্তিনের ইন্তিফাদার কাশ্মীরি সংস্করণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে জম্মু ও কাশ্মীরের সাবেক একজন উপমুখ্যমন্ত্রী সেখানকার সহিংসতার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও সেনাবাহিনীকে দায়ী করেন। সেখানকার পিপলস ডেমোক্রেটিক দলের নেতা মুজাফফর হোসেন বেগ ওই রাজ্যের রাজনীতিকদের দায়ী করে বলেন, তাঁরা নিজেরাই সেখানকার তরুণদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছেন। চলমান এই সংকট মোকাবিলায় স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলোর এখনই কাশ্মীর উপত্যকার শহরগুলোর উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.