ম্যারাডোনা এখন শান্তিদূতও! by পবিত্র কুন্ডু



মাঠে খেলছেন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়, ডাগ-আউটে আরেক সাবেক বিশ্বসেরা। এমন একটা দল দর্শক-সাংবাদিকদের পতঙ্গের মতো টানবে, জানাই ছিল। কিন্তু সেই টান কতটা, সেটা বোঝা গেল পরশু সকার সিটি স্টেডিয়ামে। মেসি-ম্যারাডোনার দলের টানে বিশাল মিডিয়া সেন্টারটাও ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী’ হয়ে গেল।
ফিফা আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল, অত্যধিক চাহিদার কারণে অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা সব সাংবাদিককে ম্যাচ টিকিট দেওয়া যাবে না। কপাল পুড়ল বিশ্বকাপ থেকে আলোকবর্ষ দূরে থাকা বাংলাদেশের অভাগা সাংবাদিকদের। তবে মনের মধ্যে একটা সান্ত্বনা অন্তত জমা হলো। ইংল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, কোরিয়ার ওরা যখন টিকিট পায়নি, আমাদের তো না পাওয়ারই কথা। অতএব বিশালাকৃতির এলসিডি টিভিগুলোই আমাদের সহায় হলো। মেসি, তেভেজ, হিগুয়েইন, দস সান্তোস, হাভিয়ের হার্নান্দেজদের নৈপুণ্য দেখলাম মিডিয়া সেন্টারে বসে।
মাঠে খেলা দেখি, কিন্তু একটু পরপরই চোখ চলে যায় ডাগ-আউটে। সেখানে ম্যারাডোনা তাঁর সরব উপস্থিতি জানান দেন বারবার। হাত নেড়ে খেলোয়াড়দের ইশারা করেন। একটা সুযোগ হাতছাড়া হলে দুই হাত ওপরে তুলে হতাশায় লাফ দেন। চিৎকার করে কী যেন বলতে চান খেলোয়াড়দের। কিন্তু কথা ততদূর পৌঁছায় না। মূকাভিনয় করে যান আর্জেন্টাইন ফুটবলের দেবতা। কানে কথা পৌঁছাবে কী? ভুভুজেলা আছে না! ওগুলো শুধু আর দক্ষিণ আফ্রিকানদের সম্পত্তি নয়। সব দেশের সব বয়সী দর্শকের হাতে উঠে গেছে। পরে হয়তো কোনো এক সময়ে হিসাব করা হবে, এই প্লাস্টিকের বাঁশি কতগুলো গোল হতে দেয়নি, আর কতগুলো গোল প্রতিপক্ষের জালে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এখন এটা আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকার গর্বের প্রতীক। ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার পর্যন্ত এটির দারুণ ভক্ত। তাঁর কাছে এটি বাতিল করে দেওয়ার আবেদন উঠলেই তিনি হা-রে-রে করে উঠছেন। সাংবাদিক সমাজ নিশ্চিত, ব্ল্যাটার টুর্নামেন্ট শেষে বাক্সভর্তি ভুভুজেলা নিয়ে যাবেন তাঁর জুরিখের বাড়িতে। বিশ্বকাপের সফল আয়োজনের তৃপ্তিতে সংগীতরসিক এই সুইস ওটা বাজাবেন মাঝেমধ্যেই। আবার মন খারাপ হলেও হয়তো হাতে তুলে নেবেন।
মন খারাপ হওয়ার কোনো লক্ষণ তাঁর মধ্যে এখনো দেখা যায়নি। গ্যালারিতে বিভিন্ন দেশের রাজা-উজিরদের দেখছেন। দেখছেন গায়ক-গায়িকা, নায়ক-নায়িকা, নর্তক-নর্তকীদের। কদিন গ্যালারি মাতিয়ে গেলেন বিল ক্লিনটন। এখনো আছেন গায়ক মিক জ্যাগার। সত্যিই আছেন কি না হলফ করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, ইংল্যান্ডের জালে ওদিন জার্মানদের শ্যুটিং প্র্যাকটিস করতে দেখে দৃশ্যত জ্যাগারকে বিষণ্ন লাগল।
আরেকজনকে বিশ্বকাপের অনেকেই এখানে বিষণ্ন দেখবে বলে ভেবেছিল। নিদেনপক্ষে তাঁর ক্রুদ্ধ চেহারা। রেফারির দিকে তেড়ে যাচ্ছেন, অঘটন ঘটিয়ে ফেলছেন সংবাদ সম্মেলনে। যেমন করে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে তাঁকে নিষিদ্ধ থাকতে হয়েছে মাস তিনেক।
কিন্তু না, তিনি আশ্চর্য রকমের ধৈর্য দেখাচ্ছেন। মাঠে শান্তি স্থাপনে ভূমিকা রাখছেন। তেভেজের প্রথম গোলের পর পুরো মেক্সিকো শিবির খেপে গেল রেফারির ওপর। পরিষ্কার অফসাইড থেকে গোল। ইতালীয় রেফারি রবার্তো রসেত্তি বিরতির সময় ড্রেসিংরুমে যাওয়ার সময় পড়লেন বিপদে। তাঁর ওপর হামলে পড়লেন মেক্সিকোর রিজার্ভ বেঞ্চের খেলোয়াড়েরা। শান্তি স্থাপনে এগিয়ে এলেন কে? ডিয়েগো ম্যারাডোনা।
রসেত্তিকে তবু ম্যারাডোনা রক্ষা করেছেন। কিন্তু ইংল্যান্ড-জার্মানি ম্যাচের উরুগুইয়ান রেফারি হোর্হে লরিয়েন্দাকে তিনি বাঁচাতে পারবেন না। শারীরিকভাবে আক্রান্ত না হলেও এরপর তিনি শুধু ইংলিশ মিডিয়ার কাঁটার খোঁচায় ক্ষতবিক্ষত হতে থাকবেন। ইংলিশ মিডিয়া কতটা বিষাক্ত তা কি আর জানেন না আর্জেন্টিনার ছিয়াশি বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক!
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কীভাবে হয়! এই ইংল্যান্ড ১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল পেয়েছিল বল গোললাইন অতিক্রম না করা সত্ত্বেও (অন্তত জার্মানরা এখনো তা-ই মনে করে)। আর এ ম্যাচে বল গোললাইন পেরিয়ে যাওয়ার পরও ইংল্যান্ডকে গোল দিলেন না এই রেফারি।
ইংল্যান্ড-জার্মানি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেছে। ৩ জুলাইয়ের কোয়ার্টার ফাইনালে কি আর্জেন্টিনা-জার্মানি ম্যাচও তা-ই করবে? গত বিশ্বকাপের শেষ আটে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল জার্মানি। এবার কি তাহলে আর্জেন্টিনার জয়ের পালা? এই জয়টা কি হবে মেসির গোলে? তেভেজের আলোকোজ্জ্বল নৈপুণ্যের পরও মেসির নাম সবার মুখে। কারণ, মেসির গোল না পাওয়া যে এখন বিশ্বকাপের দুঃখ হয়ে রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.