ঢালাও আমদানির বিপরীতে স্থানীয় শিল্প বাঁচাতে সুরক্ষা শুল্কবিধি জারি

কোনো কোনো পণ্য অবাধে বেশি আমদানির কারণে স্থানীয় শিল্প ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনুমোদিত বিধিবিধানের আওতায় এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগও আছে। তবে বিষয়টি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত ছিল।
অবশেষে ৭ জুন স্থানীয় শিল্পকে ঢালাও আমদানির বিপরীতে সংরক্ষণ-সুবিধা দিতে সুরক্ষা শুল্কবিধিমালা প্রণয়ন করেছে সরকার। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ৯২টি সদস্যদেশ এরই মধ্যে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিলেও দীর্ঘদিন বাংলাদেশে বিষয়টি ঝুলে ছিল।
জানা যায়, ২০০৭ সালে এ সংক্রান্ত একটি বিধিমালা প্রস্তাব করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বিধিমালাটির খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের (অন্য কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা) জন্যও পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় কোনো আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে জানিয়ে দেয়।
কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে তৎকালীন অর্থ উপদেষ্টা বিষয়টি পরবর্তী সময়ে থামিয়ে রাখেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন গত ১৪ বছরে বিভিন্ন পণ্য ঢালাওভাবে আমদানির কারণে স্থানীয় শিল্প চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে আটটি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় টিউবলাইট, টেলিভিশন সংযোজন শিল্প, স্থানীয় রেফ্রিজারেটর সংযোজনকারী শিল্প, জরির সুতা উৎপাদনকারী শিল্প, ব্লেড প্রস্তুতকরণ শিল্প উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু কোনো সুরক্ষা বিধিমালা না থাকায় এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারকে কমিশন সুপারিশ করতে পারেনি।
জানা গেছে, কয়েক বছর আগে জরির সুতার উৎপাদকেরা ট্যারিফ কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করেন। তাঁদের অভিযোগ ছিল, ভারত থেকে ঢালাওভাবে সুতা আমদানির কারণে তাঁদের উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাঁরা এ ব্যাপারে সরকারের কাছে সুরক্ষা-সুবিধা চান।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে ১০টির বেশি জরির সুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। বছরে তাদের উৎপাদনক্ষমতা এক হাজার ৬৫০ টন। আর দেশের চাহিদা প্রায় ৫০০ টন। কিন্তু বাংলাদেশে উৎপাদিত সুতার চেয়ে দাম কম হওয়ায় ভারতীয় জরির সুতা বেশি আমদানি হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভারত জরির সুতার উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দেয়। ফলে কম দামে আমদানি করা জরির সুতা দেশে উৎপাদিত সুতার বাজার দখল করে নিচ্ছে।
এমনকি ভারত থেকে আমদানি করা নিম্নমানের জরির সুতা দেশে বেনারসি শাড়িতে ব্যবহারের ফলে কাপড়ের মানও খারাপ হচ্ছে। ফলে দেশে এর চাহিদা কমছে।
নতুন সুরক্ষা শুল্কবিধি জারি হওয়ার কারণে এখন থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবে সরকার।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন ও সেইফগার্ড কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনটি আরও আগেই চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা আটকে ছিল। আইনটি চালু হওয়ার ফলে ঢালাও আমদানি থামিয়ে দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণ-সুবিধা দেওয়া যাবে।’
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ভালো টিউবলাইটের প্রস্তুতকারক কোম্পানি থাকার পরও সস্তায় ঢালাওভাবে নিম্নমানের টিউবলাইট বাংলাদেশে আমদানি করা হচ্ছে। ফলে যে টিউবলাইট ১০ হাজার ঘণ্টা চলার কথা, সেটি চলছে পাঁচ হাজার ঘণ্টা। অন্যদিকে দেশের শিল্প উন্নত টিউবলাইট উৎপাদন করেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। এই আইন জারি হওয়ার ফলে এ ধরনের ঢালাও আমদানি আটকাতে পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মত দেন।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি অবশ্যই একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। নির্বিচারে কোনো পণ্য আমদানির বিপরীতে এটি স্থানীয় শিল্পের জন্য একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে।’
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এ ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বলে আসা হচ্ছিল। এতকাল সরকার তা কর্ণপাত করেনি।
মনজুর আহমেদ আরও জানান, এর আগেও নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে একবার এই সুরক্ষা শুল্কবিধি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের চাপে আর তা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
সেইফগার্ড কর্তৃপক্ষ: নতুন বিধি প্রণয়নের পাশাপাশি এটিকে বাস্তবায়নের জন্য একই সঙ্গে চালু হচ্ছে সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ (সেইফগার্ড অথরিটি)। বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সেইফগার্ড কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই কর্তৃপক্ষ শুল্ক আরোপযোগ্য পণ্য শনাক্তকরণ, বাংলাদেশে কোন কোন পণ্যের বর্ধিত আমদানির প্রভাবে স্থানীয় শিল্পের স্বার্থহানি অথবা স্বার্থহানির হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে—এসব বিষয়ে সরকারের কাছে নিয়মিত প্রতিবেদন দাখিল করবে।
কর্তৃপক্ষ স্থানীয় শিল্পের স্বার্থহানি অথবা স্বার্থহানির হুমকি দূর করার জন্য আরোপযোগ্য সুরক্ষা শুল্কের পরিমাণ, স্থায়িত্বকাল ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ করবে।
আবেদন গ্রহণ ও তদন্ত: দেশি কোনো পণ্য-উৎপাদক সমজাতীয় পণ্য ঢালাওভাবে আমদানির কারণে তাদের শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি না, তা জানিয়ে সুরক্ষা চেয়ে লিখিতভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করবে।
স্থানীয় উৎপাদনকারী বা তার পক্ষে দাখিল করা লিখিত আবেদন পাওয়ার পর কর্তৃপক্ষ বিক্রয়, উৎপাদন, মুনাফা, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদনক্ষমতার ব্যবহার, লাভ-লোকসান, কর্মসংস্থানের মাত্রার পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত করবে।
তদন্ত পরিচালনার নীতি: কোন কোন পণ্য বেশি আমদানির ফলে স্থানীয় শিল্পের স্বার্থহানি হচ্ছে—এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। এই বিজ্ঞপ্তির মধ্যে সংশ্লিষ্ট পণ্য, রপ্তানিকারক দেশের নাম, তদন্ত শুরু করার দিন, স্থানীয় শিল্পের স্বার্থহানির অভিযোগের সারসংক্ষেপ, তদন্ত শুরুর কারণ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকতে হবে।
এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়টি রপ্তানিকারক কোম্পানি, রপ্তানিকারক দেশের সরকার ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সেইফগার্ড-বিষয়ক কমিটির কাছে পাঠাতে হবে।
সংরক্ষণ শুল্কের স্থায়িত্বকাল: কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আরোপিত তারিখ থেকে ২০০ কার্যদিবসের জন্য সাময়িকভাবে সুরক্ষা শুল্ক আরোপ করা যাবে। তবে বিষয়টি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সেইফগার্ড-বিষয়ক কমিটিকে অবহিত করতে হবে।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কোন কোন পণ্য অতিরিক্ত আমদানির ফলে স্থানীয় শিল্প হুমকির মধ্যে পড়েছে এবং অনেক লোক কর্মসংস্থান হারিয়েছে, এটি প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ চার বছরের জন্য সংরক্ষণ শুল্ক আরোপ করতে পারবে।
কিন্তু প্রাথমিক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো সংরক্ষণ শুল্ক আরোপের পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বিষয়টি প্রমাণিত না হলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সুরক্ষা শুল্ক প্রত্যাহার করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.