পার্লামেন্ট by সৈয়দ আবুল মকসুদ

যাঁরা লন্ডনে থাকেন অথবা সেখানে ঘন ঘন যাওয়া-আসা করেন, তাঁরা টেমস নদীর তীরে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনের ভেতরের মানুষদের সম্পর্কে ভালো জানেন। বাইরে রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে ওই ভবনটি আমার একনজর দেখার সুযোগ হয়েছিল। ভবনটি আলিশান কি না, তার স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য কী, সেটা বড় কথা নয়। ওর ভেতরের অস্থায়ী বাসিন্দারা কেমন, সেটাই বিবেচ্য। কী কী কাজ তাঁরা কীভাবে করেন, কেমন তাঁদের আচার-আচরণ, দলের নেতার সম্পর্কে কণ্ঠে মধু ঢেলে হাত কচলে কী ভঙ্গিতে কথা বলেন এবং নিজেদের সমালোচনাকারীদের বিরুদ্ধে ওই কণ্ঠই বা কেমন বাঘের মতো গর্জে ওঠে, অথবা কচলানো হাত কীভাবে মহাবীর আলেকজান্ডারের তরবারির মতো শূন্যে উত্থিত হয়, তা দেখার সুযোগ পাইনি। তবে আরও কয়েকটি দেশের পার্লামেন্ট ভবন দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বাংলার মাটিতেও পার্লামেন্ট ভবন দেখেছি। একটি নয়, দুটি। দূর থেকেও নয়, তার ভেতরে গিয়ে। নাখালপাড়ার নিচু বাড়িটি দেখেছি, শেরেবাংলা নগরে লুই আই কানের সুউচ্চ স্থাপত্যটিও দেখেছি। সবশেষে গিয়েছি বহুদিন পর এবার অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণার দিন—সরকারের আমন্ত্রণে।
‘তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে’ অর্জিত ‘বাংলার মাটি’র পার্লামেন্ট ভবনটি পৃথিবীর কনিষ্ঠ পার্লামেন্ট ভবনের একটি। মালয়েশিয়ার যে পার্লামেন্ট ভবন দেখেছি, তার বয়স লুই কানেরটির চেয়ে কম। জার্মান, ফরাসি ও ভারতীয় পার্লামেন্ট ভবন দেখলে সমীহ হয়। তাকিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে, ওই সব দেশের সব মানুষের চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পুঞ্জীভূত হয়ে আছে ওই ইমারতটির ইট-পাথরের মধ্যে। ইরান ও চীনের পার্লামেন্ট ভবন দেখে আমার অন্য রকম অনুভূতি হয়েছিল, সে কথা অন্য সময় বলব।
পৃথিবীর পার্লামেন্ট ভবনগুলো আমার চেয়ে বহুগুণ বেশি দেখেছেন বাংলার পার্লামেন্টের সদস্য—সংক্ষেপে এমপিরা। এমনকি তাঁদের কেউ ইসরায়েলের পার্লামেন্ট বা নেসেট (Knesset) ভবনটিও দেখেছেন, যদিও আমাদের রাষ্ট্রপতি ওই জঙ্গি রাষ্ট্রটিতে যাওয়ার অনুমতি বাংলাদেশের কোনো নাগরিককেই দেন না আমাদের পাসপোর্টে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ এবং মুসলিম উম্মাহর নিশানবরদার বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের দুজন বিশিষ্ট এমপি চুপিসারে অন্তত একবার তেল আবিব বেড়িয়ে এসেছেন। কত তারিখে তাঁরা গিয়েছিলেন, তা আমি বলব না। বলপেন গুঁতিয়ে খাই। নুন আনতে পান্তা ফুরায়। আমাদের সাহস না থাকতে পারে, চক্ষুলজ্জা আছে। তা ছাড়া ইসরায়েলের মনোরম নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে যাওয়া এমপিদের একজন আজ পরলোকে। মৃত ব্যক্তির রেফারেন্স দিয়ে গালগল্পমূলক উপসম্পাদকীয় রচনা লেখা আমার স্বভাববিরুদ্ধ।
দেশের ভেতরে যখন এক দলের নেতারা আরেক দলের নেতাদের চিবিয়ে খান, ঢাকার রাজপথ উত্তাল, তখন আমাদের দুই এমপি একে অপরের হাত ধরে বাংলার মাটি থেকে গিয়ে ইসরায়েলের মাটিতে ঢুকে পড়েন। ওখানকার প্রকৃতির শোভা দেখে তাজ্জব হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী হয়তো বলেছিলেন, ‘আহ্, কী সুন্দর দেশ! আমাদের সোনার বাংলাও এই রকম হবে।’ তাঁর মুসলিম জাতীয়তাবাদী সহকর্মীটি হাতে চাপ দিয়ে বলেছিলেন: ‘সোনার বাংলা আর পিতলের বাংলা, যা-ই করেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি সংবিধানে যা কিছু বসাইয়া গেছেন তাতে হাত দিয়েন না।’
আজ দেশে দেশে যে পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি দেখছি, তার সূচনা ১৯৭৩ সালে বলে আমাদের বালক-বালিকাদের কেউ মনে করতে পারেন। আসলে তা ঠিক নয়। আধুনিক পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সূচনা বহু আগে। ৭০০ বছর তো হবেই! ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে বলা হয় ‘মাদার অব পার্লামেন্টস’। কারণ প্রায় সব দেশের আধুনিক পার্লামেন্ট গঠিত হয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের আদলে। পার্লামেন্টের আরেক নাম ‘লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি’ বা আইনপ্রণয়নকারী পরিষদ। আমাদের পার্লামেন্টের আমরা নাম দিয়েছি ‘জাতীয় সংসদ’।
আধুনিক পার্লামেন্টগুলোর রীতিনীতি ও কার্যক্রম ব্রিটেনের মাদার পার্লামেন্ট থেকেই গ্রহণ করা হয়েছে। স্পিকার মাঝবরাবর উঁচুতে বসা। তাঁর ডান দিকে সামনে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীরা এবং বাঁ দিকে সামনে বিরোধীদলীয় নেতা ও তাঁদের দলের সদস্যরা। তবে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনেক অপ্রীতিকর ও বিয়োগাত্মক ব্যাপারই হয়েছে, কিন্তু বাঁ দিকের আসন বণ্টন নিয়ে কোনো দিন অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়নি। তা থেকে সংসদ বর্জন তো নয়ই। ‘বর্জন’ শব্দটি ব্রিটিশদের অভিধানে অনেক কাল ছিল না।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোনো সদস্য বক্তব্য দিতে চাইলে তিনি তাঁর হ্যাট খুলে আসন থেকে উঠে দাঁড়াননি এবং গলা ফাটিয়ে চেঁচামেচি না করে স্পিকারের অনুমতির অপেক্ষায় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ওপর দিয়ে গত ৭০০ বছরে বহু ঝড় বয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। আবার তা নির্মাণ করা হয়েছে একই জায়গায়।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথ মারা যাওয়ার মাস তিনেক আগে হিটলার ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনে বোমা ফেলেন। ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হয়। রবিবাবু ভয় পেয়ে যান। ভাবলেন, এই বুঝি ব্রিটিশ সভ্যতা শেষ হতে যাচ্ছে। সভ্যতার সংকটের কথা তাঁর মাথায় আসে। কিন্তু কোনো জাতির অদম্য মনোবল থাকলে যেকোনো ক্ষতি সে পুষিয়ে নিতে পারে। যুদ্ধের পরে একই জায়গায় পার্লামেন্ট ভবন পুনর্নির্মাণ করা হয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার ব্রিটেনেও বহুকাল নারীদের ভোটাধিকার ছিল না। ১৯১৮ সালে নারীরা ভোটাধিকার পান। তবে ৩০ বছরের বেশি বয়স্করাই ভোট দিতে পারতেন। ১৯২৮ থেকে নারী ভোটারদের বয়স কমিয়ে ২১-এ আনা হয়।
আমেরিকার কংগ্রেস বা সেখানকার পার্লামেন্ট সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার দরকার নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট ও প্রতিনিধি সভা সম্পর্কে বাঙালি যা জানে, তা আমেরিকার সাধারণ মানুষও জানে কি না সন্দেহ। আমাদের রাজনীতিকেরা নানা ব্যাপারে নালিশ নিয়ে ওখানকার কংগ্রেস সদস্যদের কাছেই ধরনা দেন।
প্রকৃতপক্ষে, অন্য দেশের পার্লামেন্ট সম্পর্কে কথা বলার অধিকার আমার নেই। যেটুকু জানি তা আমাদের দেশের পার্লামেন্ট সম্পর্কেই। প্রথম পার্লামেন্টের সদস্যরা কীভাবে নির্বাচিত হন, তা আমার খুব ভালোভাবে জানা আছে।
বাংলাদেশের প্রথম সংসদের প্রথম অধিবেশন থেকে শেষ অধিবেশনটি পর্যন্ত সবগুলোতেই উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর অন্যান্য সহকর্মীর সঙ্গে সারা দেশ হেলিকপ্টারে ঘোরার সুযোগও হয়েছিল। ভারতের হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার তুষার পণ্ডিত, স্টেটসম্যান-এর মানস ঘোষ, যুগান্তর-এর সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ও দিল্লির কেউ কেউ আমাদের সঙ্গে থাকতেন।
নামমাত্র বিরোধী দল থাকলেও খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল কোনো কোনো আসনে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভাসানী ন্যাপ ও নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের। এমন অনেকের জন্য বঙ্গবন্ধু সারা দেশ ঘুরেছেন, যাঁরা ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও জয়ী হতে পারতেন না।
বিচারপতি ইদ্রিস ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কিছু আসনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাঁরও বিশেষ কিছু করার ছিল না। বঙ্গবন্ধুর কথা আলাদা। তিনি ছাড়া আর যে দশজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তা ছিল গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ভারতের পত্রপত্রিকায় তা নিয়ে কঠোর সমালোচনা হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৯৩ আসনে জয়ী হয়। জাসদ পেয়েছিল গোটা তিনেক। ভাসানী ন্যাপ একটি এবং স্বতন্ত্র তিনটি আসন। বাংলাদেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের ভাগ্য ৭ মার্চ ১৯৭৩ নির্ধারিত হয়ে যায়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথম সংসদটির অধিবেশন বসেছিল নাখালপাড়ার বাড়িটিতে। প্রথম অধিবেশন বসে ৭ এপ্রিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সংসদনেতা ও প্রধানমন্ত্রী। আতাউর রহমান খান বিরোধীদলীয় নেতা। সংসদে বিরোধী দলকে অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখতে হতো। বঙ্গবন্ধু নিজের দলের ও বিরোধী দলের সদস্যদের সঙ্গে নানা রকম রসিকতা করতেন।
প্রথম সংসদ ছিল প্রাণহীন। বিরোধী দলের সদস্য জনা কয়েক হওয়ায় তাঁরা লম্বা বক্তব্যের সুযোগ পেতেন। তবে মনে পড়ে, সরকারি দলের কোনো কোনো সদস্য যেমন শাহ মোয়াজ্জেম প্রমুখ, বিশেষ করে সত্তর-একাত্তরের বিখ্যাত চার ছাত্রনেতার একজন যাত্রাদলের অধিকারীর মতো অনর্গল বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে পার্লামেন্ট ভবন কাঁপিয়ে তুলতেন। স্পিকারের সাধ্য ছিল না তাঁকে থামান। যেদিন বাকশাল গঠিত হয়, সেই বিশেষ দিনে অবজারভার সম্পাদক ওবায়দুল হক, জনপদ সম্পাদক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও আরও কয়েকজন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সম্পাদকের সঙ্গে আমিও গ্যালারিতে বসা ছিলাম। সেদিন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ‘দেশ এক অবৈধ গ্রাম্যতার দিকে’ যাচ্ছে। বিল পাস হওয়ার পরে বঙ্গবন্ধু বারান্দায় তা নিয়ে আমাদের সঙ্গে রসিকতা করেন। সেদিন দুজন ছাড়া কোনো সদস্য বাকশাল গঠনের বিরোধিতা করেননি। পদত্যাগ করার তো প্রশ্নই আসে না।
পেটের দায়ে কাগজে নানা রকম রচনা লিখি।
অনেকে যাঁরা দেশ নিয়ে ভাবিত, ফোনে ও সশরীরে যোগাযোগ করেন। বিচিত্র বিষয়ে লেখার জন্য অনুরোধ করেন অথবা পরামর্শ দেন। দেশে বেশুমার সমস্যা, লেখার বিষয় অন্তহীন। সেদিন একজন অনুরোধ করলেন, উচ্চ আদালতের মাননীয় বিচারপতি রায় দিয়েছেন, ব্রিটিশ জেনারেল ক্রসওয়েলের মতো জেনারেল জিয়ারও মরণোত্তর বিচার হওয়া উচিত। মোশতাকেরও বিচার হওয়া দরকার। আপনার কলামে বিষয়টি নিয়ে শক্ত করে লেখেন।
পরামর্শদাতাকে আমি বললাম, খোন্কার সাহেবের বিচার ইতিহাস করেছে। ইতিমধ্যে বিধাতা তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছেন। ডালিম-ফারুকদের বিচার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার এবং তাদের কারও কারও ফাঁসি হয়ে গেছে। কিন্তু আমার বিবেচনায় ১৫ আগস্টের বর্বরতার বিচার অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আরও বেশ কিছু মানুষের বিচারকাজ বাকি আছে।
পরামর্শদাতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন এবং বললেন, তাঁদের সঙ্গে মরণোত্তর হলেও জিয়ার বিচারও হওয়া দরকার।
আমি বললাম, না, জিয়ার নয়। তাঁর বিচার হবে পরে। তাঁর আগে অতি অল্প কয়েকজন বাদে ওই পার্লামেন্টের সব সদস্যের বিচার করতে হবে। আজ না হোক, একদিন হবে। কেউ না করলে ইতিহাস করবে। ইতিহাস তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেবে বিশ্বাসঘাতকতা ও বেইমানির জন্য।
তিনি বললেন, তারা কারা?
আমি বললাম, তাঁরা আমাদের প্রথম পার্লামেন্টের মাননীয় সদস্যগণ।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলে ’৭৩-এর পার্লামেন্টের সদস্যরা সংসদ ভবনে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফেব্রুয়ারির শীতের মধ্যে রাত-দিন কষ্ট করে বঙ্গবন্ধু তাঁদের জিতিয়ে এনেছিলেন। অধিকাংশ এমপিকে ছোট ভাই ও পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। তা করুন বা না করুন, সংবিধান সমুন্নত রাখার শপথ নিয়ে তাঁরা সংসদে ঢোকেন। বঙ্গবন্ধু যেদিন সপরিবারে নিহত হন, সেদিন তাঁদের সাংবিধানিক কর্তব্যটা কী ছিল? ওই দিন বা ১৬ আগস্ট তাঁরা সংসদ অধিবেশনে বসে সংবিধান রক্ষা করলেন না কেন? কেন তাঁরা ডালিম-ফারুকদের ভৃত্যে পরিণত হলেন? কেন তাঁরা ঢাকা থেকে পালিয়ে গিয়ে কেউ দূর-সম্পর্কের চাচাশ্বশুরের বাড়ির গোয়ালঘরে আশ্রয় নিলেন, কেউ গেলেন বঙ্গভবনে মোশতাকের শীর্ণ পায়ে হাত বোলাতে?
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৫৯ ঘণ্টা পর ১৭ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে আমি জাওয়াদুল করিমের সঙ্গে বঙ্গভবনে গিয়েছিলাম। আরও সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ছিলেন। সেখানে কাদের দাঁত বের করা হাসি দেখেছি, তা বলা সম্ভব নয়। প্রতিমন্ত্রী হওয়ার জন্য কারা তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের পায়ে পড়েন, তা তাঁরা ভুলে গেলেও অনেকেই ভোলেননি। এই হলো প্রথম পার্লামেন্টের সদস্যদের কথা।
দ্বিতীয় পার্লামেন্টেও আমি প্রথম দিন থেকেই ছিলাম। সেখানে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ২০৭টি আসন, আওয়ামী লীগ (মালেক উকিল) ৩৯, মুসলিম লীগ ১২, জাসদ আট, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (ছদ্মবেশী জামায়াত) আট, আওয়ামী লীগ (মিজান চৌধুরী) দুটি আসন পায়। দ্বিতীয় সংসদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বেইমানি করেনি, কিন্তু গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ওই সংসদই বেগম খালেদা জিয়াকে একাধিক বাড়ি ও ১০ লাখ টাকা দেয়। ওই সংসদের সদস্যরাই এরশাদ যেদিন (২৪ মার্চ, ১৯৮২) ক্ষমতা দখল করেন, সেদিন গভীর নীরবতা অবলম্বন করেন। প্রতিবাদ করেননি, বরং সন্ধ্যার দিকে কেউ কেউ এরশাদের আত্মীয়স্বজন ও বান্ধবীদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়েছেন।
অর্থাৎ মেয়াদ পূরণের আগেই আমাদের প্রথম ও দ্বিতীয় সংসদের সদস্যরা স্বৈরশাসকদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে আমাদের সংবাদপত্র।
খবরের কাগজের রচনা লেখক না হয়ে যদি বড় পুলিশ কর্মকর্তা হতাম, তাহলে আল্লাহকে হাজের নাজের মেনে বলতাম, বাংলার মাটিতে পার্লামেন্টের সদস্যরা মানুষ খুন না করলেও গণতন্ত্র হত্যার সহায়তাকারীর ভূমিকাটা সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু শ্যাল বি দ্য...’-এর সময় থেকে আজ পর্যন্ত বাংলার মাটির সংবাদপত্র কোনো স্বৈরশাসককেই ছাড় দেয়নি। সংবাদপত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের সঙ্গে থেকে লড়াই করে বলপেন দিয়ে—পিস্তল, চাপাতি ও রামদা দিয়ে নয়। জনগণের দেওয়া রক্তের ওপর দিয়ে হেঁটে একদল মানুষ লুই আই কানের নকশা করা লাল বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সাংবাদিকেরা শপথ নেন না, তাই শপথ ভঙ্গের প্রশ্ন আসে না; মাননীয় এমপিরা দিব্যি শপথ ভঙ্গ করেন। যাঁদের গণতন্ত্র সংহত করতে ও রক্ষা করতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করার কথা, তাঁরা গণতন্ত্র হত্যায় সহায়তা করেন।
‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘৩০ লাখ’—শব্দগুলো যাঁদের ঠোঁটের আগায় লেগে থাকে সারাক্ষণ, তাঁদের আমি হাতজোড় করে প্রশ্ন করতে চাই, সেই ৩০ লাখের মধ্যে পার্লামেন্টের মেম্বর আছেন কতজন? সাংবাদিক খুব বেশি নেই, তবে জনা পনেরো তো আছেনই। যেমন শহীদ সাবের, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নিজামউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নাজমুল হক, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, এম এ মান্নান, আবুল বাশার—সব থোকা থোকা নাম।
লাল বাড়ির প্রকাণ্ড ঘরে দাঁড়িয়ে যাঁদের হাত বল্লমের মতো ঝলসে ওঠে সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে বিষ উদিগরণ করতে গিয়ে, সেই মাননীয়দের আমি সবিনয়ে জিজ্ঞেস করতে চাই, একাত্তরে কয়জন পার্লামেন্টের মেম্বারের বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিল? তারা ২৫-২৬ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রথম প্রহরেই দ্য পিপল, সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর অফিস-ছাপাখানা পুড়িয়ে দেয়। লেখক-সাংবাদিক শহীদ সাবের পুড়ে কয়লা হন। সেদিন কোনো এমপি কয়লা হয়েছিলেন কি?
ষোলোই ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী রেসকোর্সের ঘাসের মধ্যে গিয়ে হাঁটু ভেঙে না বসলে আরও অন্তত ১০০ সাংবাদিকের ঠাঁই হতো রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে। সংবাদপত্রের ‘নেতিবাচক’ ভূমিকা নিয়ে পৌনে দুই ঘণ্টা বক্তব্য দেওয়া সবাইকে মানায় না। সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণা নেই, তাদের আরও মানায় না। কোনো সংস্কৃতিমান মানুষ কার্টুনকে ভয় করে না। রাশিয়ায় গিয়ে পোল্যান্ডের যে রাষ্ট্রপতি বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হলেন কিছুদিন আগে, তাঁর সরকারকে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল বড় রকমের অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে চেয়েছিলেন। তা নিয়ে জার্মান পত্রিকায় কার্টুন হয়েছিল, পোলিশ নেতাকে কোলে বসিয়ে মেরকেল দুধ দিচ্ছেন। ওই অশ্লীল কার্টুনের জন্য সম্পাদককে জার্মান পার্লামেন্ট ভবনে তলব করার দাবি ওঠেনি। প্রিন্সেস ডায়ানার ছেলে উইলিয়ামের বাবা কে, তা নিয়ে সংবাদপত্র প্রশ্ন তুলেছে। ওই সম্পাদককে ওয়েস্টমিনস্টার হলে তলব করার দাবি করেননি কোনো ব্রিটিশ এমপি।
কোনো সভ্য দেশের পার্লামেন্টে মাননীয়রা ক্ষমতাহীন সাংবাদিকদের নিয়ে যা খুশি তা-ই আলোচনা হয় না। বলা হচ্ছে, কয়েকজন এমপি ও মন্ত্রী সংবাদমাধ্যমকে গালাগাল করেছেন, সকলে নন। কথাটা আমি মেনে নিতে নারাজ। একজনও তো প্রতিবাদ করেননি বা তাঁদের থামিয়ে দেননি। মৌন সম্মতি সকলের রয়েছে, তা বোঝার জন্য বড় মাথার দরকার হয় না।
হিটলারের পার্লামেন্ট প্রথমেই সংবাদমাধ্যমের ওপর আঘাত হানে। মুসোলিনির ইতালির অবস্থাও তাই। যেসব সাংবাদিক সভা-সমাবেশ কাভার করেন, তাঁরা জানেন, আমি সব সময় আমাদের সংবাদমাধ্যমের অসংগতি ও ভুলভ্রান্তির সমালোচনা করি। সাংবাদিকেরা দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে নন। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর সংবাদ পত্রিকা করতে পারে। তার জন্য প্রেস কাউন্সিলে নালিশ করা যায়। প্রেস কাউন্সিলই সম্পাদক ও প্রতিবেদককে তলব করবে। পার্লামেন্টের মেম্বাররা তলব করলে তা কেমন জমিদার বা দারোগাগিরি মনে হয়। ৩৬ বছর আমি সংবাদমাধ্যমে ছিলাম। কাগজের সম্পাদকও ছিলাম। তাই সম্পাদকদের যখন কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী অন্যায়ভাবে আক্রমণ করে, তখন তা আমার গায়ে এসে বিঁধে।
পার্লামেন্ট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। প্রতিনিধিস্থানীয় মানুষেরাই সেখানে যান। জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা, জনগণের সুখ-দুঃখ-বেদনা, জাতির ভবিষ্যৎ ও দেশের স্বার্থসংক্রান্ত বিষয় সেখানে আলোচিত হবে। ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশের জায়গা পার্লামেন্ট নয়। যত কষ্টই পাই, আশা করি, আমাদের সংসদও একদিন একটি আদর্শ পার্লামেন্টে পরিণত হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.