দিল্লির চিঠি কূলদীপ নায়ার বিশ্বায়ন ও খাদ্য সংকট

ভারতের খরা প্রকৃতি-সৃষ্ট। অর্ধেকের বেশি এলাকায় বৃষ্টির অভাবে দেশটি এক কোটি টন চাল ও সমপরিমাণ চিনি ঘাটতিতে পড়েছে। কিন্তু মানব-সৃষ্ট এই খাদ্যসংকট হয়তো এড়ানো যেত। বিশ্বায়নের ফলে এই সংকটের সৃষ্টি। ব্যাপকাকারে ভূমি দখল, কৃষকের উদ্বাস্তু হওয়া এবং ভূমিহীনদের অস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে জমিনির্ভর প্রান্তীয় মানুষ আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।
দুই দশক ধরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ শতাংশের কাছাকাছি। এই বছরও এই হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। তথাপি, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ গরিবের চোখে পড়ার মতো কোনো উন্নতি হয়নি। তাদের বাড়তি আয়ের অর্থ কেবল ধনীদের পকেট ভারি করেছে। রপ্তানির উদ্দেশ্য অপ্রয়োজনীয় শস্য চাষ বেড়ে যাওয়ায় চাপ পড়েছে ধান-গমের চাষে। ভারতে চালের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিপুল পরিমাণে চাল রপ্তানিও করা হয়েছে। বিশ্বায়নের ফলে ভারত বাধ্য হয়েছে রপ্তানি করতে। কিন্তু তা এড়ানো যেত যদি কিছু মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ আমলা টেবিলের তলা দিয়ে অর্থ কামানোর প্রলোভনের শিকার না হতেন। কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক উদ্বেগ জানানো হয়েছে, কিন্তু এগুলো তদন্তের কোনো কথা শোনা যায়নি।
ভারত এখনো উপলব্ধি করতে পারে না যে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি ক্ষুধা-দারিদ্র্য কমায় না, আরও শোচনীয় করে তোলে। শিল্পায়িত কৃষির মডেল ও বিশ্বায়িত খাদ্য বাণিজ্য ক্ষুধা সৃষ্টির জন্য দায়ী—এ বিষয়ে মনমোহন সিংয়ের সরকার এখনো সজাগ নয়। কৃষকেরা সাহায্যের জন্য অনিবার্যভাবে ঋণের ওপর নির্ভর করেছে। তারা বুঝতে পারেনি ঋণের ফাঁদ আসলে ক্ষুধারই ফাঁদ। অনেকে আত্মহত্যা করেছে, আরও অনেকে করবে।
ভারতের গরিবদের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। বিশ্বায়নের ফলে তাদের জীবিকার পথ ধ্বংস হয়েছে। মধ্যবিত্তের অবস্থা আরও খারাপ। তারা নিম্নমানের খাবার খাচ্ছে, অসুষম ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশ্বায়নের মাধ্যমে তাদের খেতে বাধ্য করা হচ্ছে। পর্যাপ্ত খাবার না পাওয়া গরিবদের পুষ্টিহীনতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে দেশটি। ধনীরাও পুষ্টিহীনতার শিকার। কারণ, আমেরিকায়িত খাদ্য সংস্কৃতির প্রভাবে তাদের খাদ্যাভ্যাসে জায়গা করে নিয়েছে অসুষম ও প্রক্রিয়াজাত খাবার।
বুশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিভ্রান্তিকর এক যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ভারতের খাদ্যসংকটের কারণ সেদেশের মধ্যশ্রেণীর আকার বৃদ্ধি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে এবং এই বিপুলসংখ্যক মানুষ অনেক খাদ্য গ্রহণ করে। কিন্তু তিনি জানেন না যে ভারতীয়রা এখনো মোটের ওপর কম খাবার খায়। খাদ্যনিরাপত্তার উদ্দেশ্য ও সমাধান বিষয়ে সদ্য প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বুশের জীব-জ্বালানিনীতি ও শস্য বাণিজ্য-জোটের সংরক্ষণনীতি মূল্য বৃদ্ধির প্রকৃত কারণ।’ খাদ্যকে বৃহত্ করপোরেশনগুলোর যৌথ নিয়ন্ত্রণাধীন পণ্যতে পরিণত করা হয়েছে।
খাদ্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধি স্পষ্টত পশ্চিমাদের বর্ণিত নয়া উদারনৈতিক প্যারাডাইসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তৈরি অর্থনৈতিক নীতির ফল। খাদ্যব্যবস্থার সর্বত্র করপোরেটদের একচেটিয়া কায়েম করতে সরকারের হস্তক্ষেপ করেছে। জাতীয় উত্পাদন, বাণিজ্য থেকে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, উদারভাবে আমদানি থেকে রপ্তানিকেন্দ্রিক কৃষি সর্বত্র হস্তক্ষেপ করেছে; যদিও সরকারের হস্তক্ষেপের ফলে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটেছে। সরকার এখন হাত গুটিয়ে বসে থেকে বলছে, মূল্য নিয়ন্ত্রণে তাদের কিছুই করার নেই।
বিশ্ব কৃষি-শিল্প ফোরামের এক সভায় গত বছর ১১ এপ্রিল মনমোহন বলেন, খাদ্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আরও কঠিন করে তুলবে এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাও আক্রান্ত হতে পারে। তবে তিনি মূল্যবৃদ্ধি রোধে কঠোর নিয়ন্ত্রণের যুগে ফিরে যাওয়া নাকচ করে দেন। গরিবদের উচ্চ মূল্যের খাবারের অর্থনীতির দিকে ঠেলে দিয়ে সেই অর্থনীতির রূপকার বলেছেন, তিনি ‘নাক না গলানোর অর্থনীতিতে’ বিশ্বাসী। এর মানে হলো, খাদ্যব্যবস্থায় করপোরেটদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থনীতিকে স্বয়ংচালিত করে দেওয়া।
খাদ্য আমদানি আর আর্থিক সামর্থ্যের সীমার মধ্যে নেই। আর আমদানিনির্ভর অর্থনীতির মডেল যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের স্বার্থের অনুকূলে হতে পারে, যে সরকার খাদ্যকে সব সময় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। ভারতের খাদ্য সার্বভৌমত্বের স্বার্থে নিশ্চয়ই তা নয়। ইতিমধ্যে পর্যাপ্ত খাদ্যহীন ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর জন্যও নয়।
সস্তা খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এক দশকের বেশি সময়ে করপোরেট বিশ্বায়ন বিশ্বব্যাপী কৃষি ধ্বংস করেছে। বিশ্বায়ন সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা শক্তি ও প্রক্রিয়াগুলোই খাদ্যদ্রব্যকে জনগণের আয়ত্তের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য বাড়ছে। ৩৩-এর অধিক দেশে দাঙ্গা হয়েছে। ভারতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চহারে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। নানা রকম কারণ হাজির করা হয়েছে, বলা হয়েছে জনসংখ্যা বেড়ে গেছে। এগুলো অশোভন ব্যাখ্যা। কারণ, গত বছরে খাদ্যমূল্য দ্বিগুণ হয়েছে, জনসংখ্যা নয়।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে অর্থনীতিতে হাজার হাজার কোটি টাকা যোগ করে যখন দেখলেন কোনো উন্নতি ঘটল না, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই অর্থ কোথায় গেল তা অনুসন্ধানের জন্য এক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেন। তাঁর প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাড়তি অর্থ ধনীদের পকেটস্থ হয়েছে। নেহরু আশ্চর্য হননি, কিন্তু আহত বোধ করেছিলেন এই জন্য যে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জনগণের সম্পদের রক্ষকের ভূমিকায় কাজ করার জন্য মহাত্মা গান্ধীর উপদেশ কোনো কাজে আসেনি। আসলে গ্রামীণ অর্থনীতি ও স্বনির্ভরতা নিয়ে মহাত্মা গান্ধী যে উপদেশ দিয়েছেন, তা একদমই অনুসরণ করা হয়নি। তাঁকে এর জন্য দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু সরকারের লোকজন এর জন্য দায়ী।
ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি ক্ষুধা বৃদ্ধির মূল কারণ বিশ্বায়ন দেশটির জন্য ক্ষতিকর ফল বয়ে এনেছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, তত্কালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরাম ও পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মনটেক সিং আহলুওয়ালিয়া বিশ্বায়নকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের অধিকারী এই ত্রয়ী তাঁদের উন্নয়নের তত্ত্বে মগ্ন থেকেছেন। আশ্চর্য লাগে যে প্রবৃদ্ধির হার প্রায় তিন গুণ হওয়ার ফলে অর্জিত অর্থ কোথায় গেল, তা অনুসন্ধানে প্রধানমন্ত্রী কোনো কমিটি গঠন করলেন না, চটপট একজনকে নিয়োগ করলেন। ধনী ও মধ্যবিত্ত তাদের পকেট ভর্তি করেছে ঠিকই, কিন্তু তা শুধু আংশিক সত্য, পুরো সত্যটি জানা দরকার।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কূলদীপ নায়ার: ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.