ক্রসফায়ার সাঈদ আহমেদ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড: কালে কালে একই বয়ান

দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এখন ‘ক্রসফায়ার’ই একমাত্র উপায় বলে মনে করছে সরকার—১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ প্রথম আলোয় খবরটি পড়ে সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ মনে পড়ে গেল। প্রথম আলোর ওই খবর থেকে জানা যাচ্ছে, চলতি বছরের আট মাসে ‘ক্রসফায়ারের’ নামে র্যাব ও পুলিশের হাতে ৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই খবরের পাশেই আরও দুজনের মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হয়েছে। আর ১৬ সেপ্টেম্বর আরেকজনের মৃত্যুর খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাত্ সাকল্যে এ সংখ্যা দাঁড়াল ৬৩।
অথচ প্রায় সবাই জানেন এবং প্রথম আলো ওই খবরে উদ্ধৃতও করেছে যে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের দিনবদলের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিল, ‘দল ক্ষমতায় গেলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে’। আর ক্ষমতায় গিয়ে প্রথম আট মাসেই ক্রসফায়ারের নামে এতগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো! বিডিআর বিদ্রোহের পর হেফাজতে থাকাকালীন ৪০ জনেরও বেশি বিডিআর সদস্যের অস্বাভাবিক মৃত্যুকে হিসাবে ধরলে পরিসংখ্যান বলবে, এ সরকারের আমলে শতাধিক ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। অবশ্য মুখে দিনবদলের কথা বললেও সেই আগের দিনের চাতুর্য আর কুটিলতা বজায় রেখে সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা বলে যাচ্ছেন, এগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নয়। সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সেই শব্দ, দাড়ি, কমা অপরিবর্তিত রেখে ‘ক্রসফায়ারের’ স্থলে ‘এনকাউন্টার’ উল্লেখ করে বলে যাওয়া অবিশ্বাস্য গল্পকে।
এ ধরনের মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনাপরবর্তী সংশ্লিষ্ট বাহিনীর তরফ থেকে দেওয়া ব্যাখ্যা, ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ, আমাদের নিজস্ব তথ্যানুসন্ধান—এসবের মাধ্যমে আমাদের হাতে বিশ্বাস করার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে যে ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন এগুলো পরিকল্পিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং কেন এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি কার্যক্রম গ্রহণের আদেশ দেওয়া হবে না মর্মে গত ২৯ জুন ২০০৯ সরকারের প্রতি একটি রুল জারি করে হাইকোর্ট। শুনানিকালে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, আর কোনো ক্রসফায়ার হবে না। ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলেও সরকার অঙ্গীকার করে ক্রসফায়ারে হত্যার বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখানো হবে। এখন ক্রসফায়ারকেই শেষ ভরসা মানলে বাংলাদেশের তো উচিত জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্যপদ ত্যাগ করা।
অনেকেরই হয়তো মনে আছে বিগত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘র্যাব কোনো নিরীহ মানুষ হত্যা করেনি, র্যাব প্রয়োজনে আরও কঠোর হবে। বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাস থাকবে না’ (সূত্র: ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ বিভিন্ন পত্রিকা)। একই ধরণের কথার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যাচ্ছে বর্তমান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হকের মুখে।
‘র্যাবের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের ক্রসফায়ারে মৃত্যু হলে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না। কারণ আতত্মরক্ষার জন্য র্যাব গুলি ছোড়ে’—বলেছিলেন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (সূত্র: ১ ডিসেম্বর ২০০৪ বিভিন্ন পত্রিকা)। বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এখন যে ধরণের কথা বলছেন তার সাথে কি ওই কথার খুব গরমিল রয়েছে?
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তত্কালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী সুমন আহমেদ মজুমদার র্যাব হেফাজতে মারা যাওয়ার পর বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া র্যাবকে মানুষ খুন করার লাইসেন্স দিয়েছেন’ (সূত্র ২৩ জুলাই, ২০০৪, দৈনিক সংবাদ)। আমাদের একটুও আশ্চর্য হব না যদি দেখি বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রীকে উদ্ধৃত করে শুধু প্রধানমন্ত্রীর নাম পরিবর্তন করে অবিকল একই কথা বর্তমানে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
সেই ২০০২ সালে অপারেশন ক্লিন হার্ট দিয়ে শুরু। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেটাকে তখন মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তারপর চলল ‘হার্ট অ্যাটাক’, এল র্যাট, র্যাট থেকে হলো র্যাব। শুরু হলো ‘ক্রসফায়ার’, তারপর ‘এনকাউন্টার’, সর্বশেষ ‘আত্মরক্ষার্থে গুলি’। সাত বছর ধরে চলছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আর উন্নতি হলো না। এখনো সেই একই বয়ান, একই তরিকা। এ ছাড়া নাকি আর কোনো উপায় নেই!
সাঈদ আহমেদ: মানবাধিকারকর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

No comments

Powered by Blogger.