খোলা চোখে হাসান ফেরদৌস আমেরিকায় নব্য ফ্যাসিজম মাথাচাড়া দিচ্ছে

ওপরের ছবি দুটি দেখুন। গত রোববার ওয়াশিংটন ডিসিতে ওবামাবিরোধী একটি সমাবেশে প্রায় লাখখানেক লোক জড়ো হয়েছিল। সেখানেই তোলা। প্রথম ছবির স্লোগান: ‘আমেরিকা জেগে ওঠো, দেশকে সমাজতন্ত্রের হাত থেকে বাঁচাও।’ দ্বিতীয় ছবির: ‘ওবামা একজন চোর।’
ছবিগুলো থেকে স্পষ্ট: বারাক ওবামার বিরুদ্ধে শ্বেত-আমেরিকা এখন ফুঁসছে। হিটলার ও স্তালিনের সঙ্গে তাঁকে তুলনা করে পোস্টার বেরিয়েছে। ওবামাকে খুন করা উচিত—এ কথা তো হরহামেশাই বলা হচ্ছে। একজন পাদরি পর্যন্ত বলেছেন, যেহেতু ওবামা গর্ভপাত সমর্থন করেন, তাঁকে হত্যা করা পূণ্যের কাজ হবে। গত রোববারের সমাবেশেই দেখেছি, একদল লোক পোস্টার উঁচিয়ে ধরেছেন, তাতে লেখা: ‘ইউটাহ ও মোন্টানা থেকে আমরা এসেছি, এবার নিরস্ত্র হয়ে!’ অর্থাত্ এর পরের বার আসব বন্দুক নিয়ে। ওবামা বিদেশি ও মুসলমান, এমন দাবি তো রেডিও টক-শো ও টিভিপর্দায় একের পর এক ভাষ্যকাররা অনেক আগে থেকেই করে যাচ্ছেন। একজন রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান আইন পরিষদে প্রস্তাব তুলেছেন, এরপর থেকে যাঁরা রাষ্ট্রপতির পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, তাঁদের আগেভাগে নিজের জন্মসনদ দাখিল করতে হবে। প্রস্তাবটা যে ওবামার কথা মাথায় রেখে তোলা হয়েছে তা বোঝার জন্য রকেট-বিজ্ঞানী হতে হয় না। ওবামা অবশ্য তাঁর জন্মসনদ নিজের ওয়েবসাইটে ছেপে দিয়েছেন, তার পরও তিনি বিদেশি—সে কথা বলে আদালতে মামলা পর্যন্ত ঠোকা হয়েছে। এ বছর আগস্ট মাসের প্রায় পুরোটাই দেশজুড়ে ওবামাবিরোধী ‘টাউন হল’ মিটিং করেছে রিপাবলিকান দল। সে রকম একটি সভায় এক শ্বেতকায় মহিলা চিত্কার করে আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে দাবি করেন, ‘আমার দেশ আমেরিকা বেদখল হয়ে গেছে। আমি তা ফেরত চাই।’ গত সপ্তাহে ওবামা দেশের স্কুলের ছেলেমেয়েদের জন্য একটি ভাষণ রেকর্ড করেন। সে ভাষণ নিয়েও এ দেশের সাদা মানুষের সে কী চিত্কার-শোরগোল! আলাস্কা থেকে টেক্সাস—যেখানেই রিপাবলিকানরা অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে এখনো ক্ষমতা ধরে রেখেছে, সেখানেই তারা বেঁকে বসল: ওবামা তাদের ছেলেমেয়েদের মাথায় সমাজতন্ত্রের পোকা ঢোকানোর চেষ্টা করবেন। অতএব এ ভাষণ ক্লাসে প্রচার করা যাবে না। অথচ এর আগে সব প্রেসিডেন্টই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন, তখন এ নিয়ে কেউ টুঁ-শব্দটি করেনি।
ওবামাবিরোধী বিক্ষোভ মাঠ থেকে এখন কংগ্রেসের ভেতরও গড়িয়েছে। গত সপ্তাহে কংগ্রেসের যৌথ সভায় ভাষণ দিতে এসেছিলেন বারাক ওবামা। বিষয়: স্বাস্থ্যবীমা প্রশ্নে নতুন আইন। বক্তৃতার এক পর্যায়ে ওবামা বললেন, ‘নতুন যে আইন হবে, তাতে কোনো অবৈধ বহিরাগত ব্যক্তির জন্য বীমাব্যবস্থা থাকবে না।’ তিনি কথা শেষ করতে না করতেই সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য জো উইলসন চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘মিথ্যা কথা।’ কংগ্রেসের ইতিহাসে এই প্রথম আইন পরিষদের ভেতর দাঁড়িয়ে কোনো সাংসদ প্রেসিডেন্টকে ‘মিথ্যাবাদী’ বলে দোষারোপ করলেন।
ওবামাবিরোধী এই তত্পরতার আরও ভয়াবহ কিছু লক্ষণ চিহ্নিত করেছে আলাবামার সাউদার্ন পভার্টি ল সেন্টার। মানবাধিকারবিষয়ক কাজের জন্য সুপরিচিত এই সংস্থাটি তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলেছে, গত এক বছরে শ্বেতসভ্যতায় বিশ্বাস করে, এমন অতি দক্ষিণপন্থী মিলিশিয়া দলের সংখ্যা আমেরিকায় ভয়াবহ রকম বেড়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে গঠিত হয়েছে এমন মিলিশিয়া দলের সংখ্যা কম করে হলেও ৫০, তাদের অনেকে আবার মূলত সাবেক পুলিশ ও সেনা সদস্যদের দিয়ে গঠিত। এসব মিলিশিয়ার সদস্যরা প্রায় সবাই শ্বেতকায় ও পুরুষ, তাদের বেশির ভাগই বিশ্বাস করে, আমেরিকা সাদা মানুষের খ্রিষ্টান দেশ, একমাত্র তারাই এই দেশটি শাসন করার অধিকার রাখে, অন্য কেউ নয়। কালো বা পীতবর্ণের মানুষদের বিরুদ্ধে, বিশেষত অভিবাসীদের বিরুদ্ধে, এসব মিলিশিয়া দল নানা রকম গোপন বা প্রকাশ্য আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছে।
প্রামাণিক তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত এই প্রতিবেদনে ভীত হওয়ার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। যারা এসব মিলিশিয়ার সদস্য, তারা সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করে, বারাক ওবামা একজন বিদেশি মুসলমান ও কমিউনিস্ট। তাঁর আসল লক্ষ্য দেশটিকে একটি আন্তর্জাতিক চক্রের হাতে তুলে দেওয়া। তাঁর হাত থেকে আমেরিকাকে রক্ষা করতে হলে এখনই প্রস্তুত হতে হবে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, দেশের বিভিন্ন স্থানে সাবেক সেনা সদস্যদের নেতৃত্বে সামরিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে গেছে। কয়েকটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণ রয়েছে প্রতিবেদনটিতে। যেমন, ফ্লোরিডার পেনসাকোলার এক মিলিশিয়া সমাবেশে সাবেক এফবিআই এজেন্ট টেড গান্ডারসন প্রকাশ্যে দাবি করেন, কেন্দ্রীয় সরকার সারা দেশে এক হাজারেরও বেশি বন্দীশালা স্থাপন করেছে। খুব শিগগিরই এ দেশে মার্শাল ল জারি হবে, যারা এর প্রতিবাদ করবে, তাদের এসব জেলখানায় ঢোকানো হবে। আটলান্টায় আরেক মিলিশিয়া দলের নেতৃত্বে ‘নাগরিক আদালত’ স্থাপন করে বারাক ওবামার বিচার হয়েছে। তাঁর অপরাধ: তিনি বিদেশি, অবৈধভাবে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদ দখল করেছেন। ম্যাসাচুসেটসের লেক্সিংটনে সদ্যগঠিত মিলিশিয়া দল ‘ওথ কিপারস’-এর এক সমাবেশে সদস্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিয়েছে, জান দিয়ে হলেও তারা দেশের শাসনতন্ত্র রক্ষা করবে। এ সম্পর্কে পুরো রিপোর্ট পড়তে হলে ইন্টারনেটে এই ঠিকানায় দেখুন: http://www.splcenter.org.images/dynamic/main/The_Second_Wave.pdf
এসব দলের নেতা বা সদস্যদের চূড়ান্তবাদী ও প্রান্তবর্তী দলের লোক ভেবে তাদের আমরা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারি। রোববার ওয়াশিংটন ডিসিতে যারা মিছিল করল, তারাও আমেরিকার মূলধারার কেউ নয়। কিন্তু এসব প্রান্তবর্তী ও অতি দক্ষিণপন্থী দলগুলো, তা তারা সংখ্যায় যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন, ক্রমেই উচ্চকণ্ঠ হচ্ছে। (৭০-৭৫ হাজার মানুষকে খুব কমই বা কী করে বলি?) দক্ষিণপন্থী রেডিও-টিভিতেও তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, দেশের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টি এদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে। দলটি যেসব ব্যাপারে ওবামা সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছে, তা আর কিছু নয়, এই প্রান্তবর্তী গ্রুপগুলোর কথা মাথায় রেখে। এরাই এখন দলের ‘বেইস,’ বা মূল ভিত্তি। তাদের খুশি করার জন্য রিপাবলিকান নেতারাও এখন ফেডারেল সরকারকে দেশের এক নম্বর শত্রু বলে চিহ্নিত করছে এবং তার বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনে সমর্থন জোগাচ্ছে। টেক্সাসের গভর্নর রিক পেরি তো সরাসরি বলেই দিয়েছেন, দরকার হলে তাঁরা আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করবেন। সাউথ ক্যারোলাইনার রিপাবলিকান গভর্নর মার্ক স্যান্ডফোর্ডও একই কথা বলেছেন। আরও প্রায় ডজনখানেক রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যের আইন পরিষদে বিচ্ছিন্নতার সমর্থনে প্রস্তাব উঠেছে। কোনো কোনো রিপাবলিকান সিনেটর পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতার পক্ষে কথা বলা শুরু করেছেন। যেমন, ওকলাহোমা থেকে নির্বাচিত সিনেটর জিম ইনহফ বলেছেন, ‘ওবামার হাতে দেশের যে দশা হয়েছে তাতে মনে হয় না, এই দেশ কংগ্রেসের আগামী নির্বাচন পর্যন্ত অর্থাত্ ২০১১ সাল নাগাদ টিকে থাকবে।’ ওবামা সন্ত্রাসীদের মদদ দিচ্ছেন, এ কথা সরাসরি বলে ইনহফ মন্তব্য করেছেন, ‘তাঁর মাথায় ঢুকছে না, প্রেসিডেন্ট ওবামা কেন এই দেশটি সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে দিতে চান।’
সন্দেহ নেই, রিপাবলিকানদের এসব কথাবার্তা ও কাজকর্মের পেছনে একটি গভীর বর্ণবাদী মনোভাব কাজ করছে। দেশের দক্ষিণের কৃষিনির্ভর রাজ্যগুলো বরাবরই খোলামেলাভাবে বর্ণাবাদী। সরকারের ব্যাপারে এরা সন্দেহবাদী, সব সামাজিক মূল্যবোধের প্রশ্নে এরা প্রবল রক্ষণশীল এবং আমেরিকার রাজনৈতিক ও নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব বিষয়ে এরা সম্পূর্ণ আস্থাবান। বর্তমানের রিপাবলিকান দলের বেশির ভাগ সদস্যই কার্যত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের এই রক্ষণশীল ও শ্বেতকায় পুরুষনির্ভর রাজনৈতিক সমর্থনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এ দলে এই মুহূর্তে কোনো স্বীকৃত নেতা নেই, তার ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে তা পূরণে এগিয়ে এসেছে অতি কট্টর টক রেডিও-টিভি হোস্টগুলো। ইভানজেলিক্যান খ্রিষ্টান যাজকেরাও সমর্থনের ছাতা মেলে ধরেছেন। এঁদের সার্বক্ষণিক চেষ্টায় যে অসহিষ্ণু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে তার ফলে যদি রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যায়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মোটে আট মাস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন বারাক ওবামা। ‘পরিবর্তন’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময় যে পরিবর্তন তিনি প্রস্তাব করেন, তাতে একটি প্রগতিশীল, জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থার সম্ভাবনায় আমরা অনেকেই আশান্বিত হয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এ পর্যন্ত এমন কিছুই করেননি, যার ফলে আমেরিকার করপোরেট সংস্কৃতি বদলে যায় বা তার ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মোচড় খায়। বস্তুতপক্ষে, ওবামার নেওয়া পদক্ষেপের ফলে আমেরিকার করপোরেট সংস্কৃতিতে এতটুকু আঁচড় পর্যন্ত লাগেনি। উল্টো, বড় বড় ব্যাংক ও অর্থপ্রতিষ্ঠান যারা আমেরিকার চলতি মন্দাবস্থার জন্য দায়ী, তাদের সরকারি কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে রক্ষা করেছেন ওবামা। ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও বিদেশে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে, কমছে না। পরিবেশবিষয়ক একটি আইনে তিনি স্বাক্ষর করেছেন বটে, কিন্তু তেল ও গ্যাস লবির চাপের ফলে সেটি একটি দুর্বল আইনে দাঁড়িয়েছে। একজন সুপরিচিত উদারনৈতিক সুপ্রিম কোর্ট বিচারকের স্থানে একজন লাতিন মহিলাকে মনোনয়ন দিয়েছিলেন, কিন্তু সে মহিলাকেও কোনোক্রমেই আমেরিকার মূলধারার বাইরের অর্থাত্ বামপন্থী বলা যায় না। সবচেয়ে বেশি তর্ক বেধেছে ওবামা স্বাস্থ্যখাত ঢেলে সাজানোর যে প্রস্তাব করেছেন তা নিয়ে। কিন্তু সেখানেও তিনি একের পর এক ছাড় দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের পাশাপাশি একটি ‘সরকারি সেবাখাত’-ও থাকবে। এ দুই খাতের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে একদিকে সেবার মান যেমন বাড়বে, তেমনি অহেতুক ব্যয়-সংকোচনও সম্ভব হবে। কিন্তু সে কথা বলতে না বলতেই চারদিক থেকে এমন হইচই পড়ে গেল যে ওবামার উপদেষ্টারা বলতে বাধ্য হলেন, দরকার হলে সরকারি খাত ছাড়াই স্বাস্থ্যবীমা আইন পাস হবে।
এত ছাড় দেওয়ার পরও এই ওবামাবিরোধী দক্ষযক্ষ কেন? একমাত্র কারণ কি এ নয় যে ওবামার গায়ের রং কালো?
নিউইর্য়ক, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.