মানবিক করিডরে ঢাকার সায়, আপত্তি মিয়ানমার জান্তার: উভয়ের সম্মতি চায় জাতিসংঘ
এদিকে কেন্দ্র তথা জান্তা সরকারকে বাইপাস করে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত আরাকান বা রাখাইনে এমন করিডরে আপত্তি তুলেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। বিষয়টি স্বীকার করে সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা রাতে মানবজমিনকে বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বিষয়ে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্র দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমারের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত সামরিক জান্তা সরকার। আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে বাংলাদেশ কেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নেপি'ড। শেষ পর্যন্ত দেশটির জান্তা সরকার করিডর প্রশ্নে বিরোধিতা থেকে সরাসরি বাধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে ন।
সরকারের বক্তব্য, অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়ে অস্পষ্টতা!
বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছি। তবে মানবিক সহায়তার রুটের বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে আছে, যা নিয়ে নানা পক্ষের মধ্যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে বার্তা সংস্থা ইউএনবির এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। সরকার মনে করে, যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।’
মিস্টার আলম বলেন, ‘বাংলাদেশ সংকটকালে অন্যান্য দেশকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বরাবরই উদাহরণযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মিয়ানমারে ভূমিকম্পের পর আমাদের সহায়তা।’
প্রেস সচিব জানান, তারা আশঙ্কা করছেন যে এই ভোগান্তি দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে আরও মানুষের বাংলাদেশে আসার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এ অবস্থা বাংলাদেশ সামাল দিতে পারবে না। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে সাহায্য পাঠানোর একমাত্র কার্যকর পথ হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এই পথ ব্যবহার করে সাহায্য পরিবহনে কারিগরি সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, ‘এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। যথাসময়ে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শ করব।’
প্রসঙ্গত, রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডর চালুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বিষয়টি গত রোববার জনসমক্ষে আনেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে; কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিস্তারিত বিষয়ে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’
নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরাও চুলচেরা বিশ্লেষণ আর বাংলাদেশের সব অংশীজনকে যুক্ত করার আগে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সমীচীন নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে, জাতিসংঘ, বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির এ বিষয়ে একমত হতে হবে। এই চার পক্ষের মধ্যে কোনো একটি পক্ষের ভিন্নমত থাকলে এটি আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব কি না, সেটি বড় প্রশ্ন।
মানবিক করিডোর: বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ের সম্মতি চায় জাতিসংঘ
যুদ্ধ-কবলিত রাখাইনে খাদ্য সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশের উপর দিয়ে ‘মানবিক করিডোর’ চালু করতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ের সম্মতি লাগবে বলে মনে করে জাতিসংঘ। ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের বরাতে বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এমনটাই জানানো হয়। বলা হয়, রাখাইনে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন। সংস্থাটি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা অব্যাহত রেখেছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সমর্থন জোরদার করতে কাজ করবে জাতিসংঘ। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে সীমান্ত পেরিয়ে যেকোনও মানবিক সহায়তা বা সরবরাহের জন্য প্রথমে দুই সরকারের সম্মতি প্রয়োজন। সীমান্ত অতিক্রম করে সহায়তা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এছাড়া জাতিসংঘ সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না বলেও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এদিকে, রাখাইনের বেশিরভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আরাকান আমি। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সীমান্ত তাও নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি। এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির তীব্র সংঘাত চলছে। গত মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস রাখাইনে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতা চান। এর অংশ হিসেবে একটি মানবিক করিডর তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি। রাখাইনে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মানবিক করিডর চালুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বিষয়টি গত রোববার জনসমক্ষে আনেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে; কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিস্তারিত বিষয়ে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ গৃহযুদ্ধের মধ্যে থাকা মিয়ানমারের রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য শর্তসাপেক্ষে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগতভাবে সম্মত মর্মে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যুতে অর্ন্তবর্তী সরকার কিসের ভিত্তিতে এবং কোন প্রক্রিয়ায় ‘মানবিক করিডর’ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, সেই প্রশ্ন তুলেন অনেকে। বলা হয়, সরকারের উচিত ছিল, দায়িত্ব ছিল এই বিষয়টা নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্তে দেশের ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির’ মুখে পড়তে পারে। বিষয়টি নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা সরকারের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যে সরকারের ভেতরে বাইরে প্রতিক্রিয়া হলে নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম মঙ্গলবার বলেন, “আমরা এটা স্পষ্টভাবে বলতে চাই যে সরকার তথাকথিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনও সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেনি। রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সাহায্য দেয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে রাজি হবে, এটাই আমাদের অবস্থান।” এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি দাবি করে প্রেস সচিব বলেন, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সবপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এ বিষয়ে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা সমস্যাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ খলিলুর রহমানও কথা বলেছেন। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘রাখাইনে জাতিসংঘের নেতৃত্বে মানবিক সহায়তার উদ্যোগ নেওয়া হলে বাংলাদেশ তাতে কারিগরি সহায়তা দিতে আগ্রহী আছে। আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের সহায়তায় মানবিক সহায়তার মাধ্যমে রাখাইনে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা শরণার্থীদের ফেরার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করবে।’
রাখাইনে হিউম্যানিটারিয়ান করিডরের পক্ষে-বিপক্ষে ঢাকায় তোলপাড় চলা অবস্থায় আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। বিষয়টি স্বীকার করে সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বুধবার মানবজমিনকে বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বিষয়ে ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্র দিয়ে আপত্তি জানিয়েছে মিয়ানমারের কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত সামরিক জান্তা সরকার। আরাকান আর্মিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ অভিহিত করে বাংলাদেশ কেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নেপি’ড। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত দেশটির জান্তা সরকার করিডর প্রশ্নে বিরোধিতা থেকে সরাসরি বাধা বা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

No comments