কোন পথে অর্থনীতি? by এমএম মাসুদ

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের বেশির ভাগ সময়ই অর্থনীতির সূচকগুলো ছিল নিম্নমুখী। দেশের অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে দু’টি বাদে প্রায় সব সূচকই এখনো নেতিবাচক ধারায় রয়েছে।  বর্তমানে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। এর পরেই রয়েছে রপ্তানি আয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দুর্বিষহ করে তুলেছে নিম্নআয়ের মানুষের জীবন। ডলার সংকট, আমদানি কমেছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন, বিনিয়োগে স্থবিরতা, কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, আয়বৈষম্য বৃদ্ধি ও দেশ থেকে টাকা পাচারে নড়বড়ে দেশের অর্থনীতি। ব্যাংক  খাতের পরিস্থিতিও নাজুক। কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এসব চিত্র গত সরকার কারসাজির মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে রেখেছিল। সরকারের শেষ সময়ে অর্থনীতির সূচকগুলোর সার্বিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলমান।

এমন প্রেক্ষাপটে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছে। এখন প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। বর্তমানে টাকা ছাপানো বন্ধ, টাকা পাচার এবং ব্যাংক খাতে লুটপাট না হলেও অর্থনীতির স্থবিরতা কাটেনি। শিল্প ও বিনিয়োগেও স্থবিরতা বিরাজমান। তবে ধীরে ধীরে অর্থনীতি স্থিতিশীল হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, খাদের কিনারে থাকা অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।
তবে দেশের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ যৌথভাবে প্রতি মাসে পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স (পিএমআই) প্রকাশ করে, তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে জুলাই ও আগস্ট মাসের ধারাবাহিকতায় সেপ্টেম্বর মাসেও অর্থনীতি সংকোচনের ধারায় ছিল। তবে আগস্ট মাসের তুলনায় সংকোচনের গতি সামান্য কমেছে। আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বর মাসে পিএমআইয়ের মান ৬.২ পয়েন্ট বেড়েছে। অর্থাৎ আগস্ট মাসের তুলনায় অর্থনীতি উন্নতির দিকে। সেপ্টেম্বর মাসে পিএমআই সূচক ছিল ৪৯.৭, আগস্ট মাসে যা ছিল ৪৩.৫। পিএমআই সূচকের মান ৫০-এর নিচে থাকার অর্থ হলো, অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি: সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ তথ্যমতে, অক্টোবরে দেশের মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০.৮৭ শতাংশ হয়েছে। এর আগে সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯২ শতাংশ ও আগস্টে ছিল ১০.৪৯ শতাংশ। বিবিএস বলছে, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২.৬৬ শতাংশে, যা জুলাইয়ে ছিল ১০.৪০ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯.৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এক মাস আগে ছিল ৯.৫ শতাংশ।

শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি কমেছে: গত অর্থবছরের শেষ বা চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৯৮ শতাংশ। অথচ তার আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এই খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে- ১০.১৬ শতাংশ। অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে আসার কারণেই গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৩.৯১ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ৬.৮৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল দেশে।

এফডিআই কমেছে: আয় ফেরত আনার ভোগান্তি, অস্থিতিশীল বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের নিট ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) বা বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ আগের বছরের তুলনায় ৮.৮ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৬১ কোটি (১.৬১ বিলিয়ন) নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮.৭ শতাংশ কম। 

রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি: রাজনৈতিক অস্থিরতার ধকল কাটাতে পারছে না রাজস্ব খাত। জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী শিথিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রভাব দেখা যাচ্ছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস (জুলাই-অক্টোবর) সময়ে শুল্ক-কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাময়িক হিসাবে এ চিত্র উঠে এসেছে।

রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন: অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোর মধ্যে এ মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের পর অক্টোবর মাসেও বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৩ কোটি ৭১ লাখ (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। জুলাইয়ে এসেছিল ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ (১.৯১ বিলিয়ন)। আগস্ট মাসে প্রবাসী আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২২২ কোটি ডলারে (২.২২ বিলিয়ন)। সেপ্টেম্বর মাসে আসে ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার, যা ছিল ৪ বছরের মধ্যে একক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এরপর সবশেষ অক্টোবর মাসে আসে ২৪০ কোটি (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
রপ্তানি আয় বাড়ছে: রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি)। এর পর চার মাস কোনো রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করেনি ব্যুরো। এরপর গত ৯ই অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে চার মাসের তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেন ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৮২ কোটি (১০.৮২ বিলিয়ন) ডলার। তবে চলমান অস্থিরতার মধ্যে আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কার মধ্যে আছেন রপ্তানিকারকরা।

রিজার্ভের পতন থামছে না:
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়লেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নকে (এসিইউ) ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। আইএমএফ’র বিপিএম৬ মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৮.১৯ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্যে দেখা যায়, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের কারণে গত ৭ই নভেম্বর সাময়িকভাবে ২০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করে দেশের রিজার্ভ। তবে এসিইউকে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করায় তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর আগে, সেপ্টেম্বরে ১.৩৬ বিলিয়ন ডলার (জুলাই-আগস্টের) এসিইউ বিল পরিশোধে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৯.৪৪ বিলিয়ন ডলার। তবে গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কোনো ডলার বিক্রি করছে না। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বাড়ছে।

আমদানি কমছে: চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা গেছে, এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১১ লাখ (১৫.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬.৭৪ শতাংশ কম।

বিদেশি ঋণের চেয়ে পরিশোধ বেশি: বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ-সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। কিন্তু সেই ঋণের ডলার দেশে আসেনি। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মাত্র ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ-সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। বিপরীতে আগে পাওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ (১.১৩ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যত ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে ২৮ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।

অর্থনীতির ৪ চ্যালেঞ্জ: নতুন প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেটে বিশ্বব্যাংক দেশের অর্থনীতির জন্য চারটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছে। এগুলো হলো- মূল্যস্ফীতি, যা কিছুটা কমলেও উচ্চহারে থাকবে; বহিঃস্থ খাতের চাপ, যার মূল কারণ প্রয়োজনের তুলনায় কম রিজার্ভ; আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা দূর করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। গত ৫ই আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের রাজনৈতিক গতিপথ কী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কেবল বাড়ছেই।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেয়ার পর বলেছিলেন, বিভিন্ন কারণে দেশের অর্থনীতি শ্লথ হয়ে পড়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে অর্থনীতিকে যত দ্রুত সম্ভব গতিশীল করা। কারণ অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে গেলে সেটা চালু হওয়া বেশ কঠিন। আমরা অর্থনীতিকে স্তব্ধ হতে দিতে চাই না। তবে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। দেশীয় শিল্পের বিকাশে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ছে।’

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য তিনটি অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। প্রথমত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যার কারণে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং মালিক, শ্রমিক ও সরকারের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি সমঝোতার পরও যা চলমান রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক খাতের দুর্বলতা, যা ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তৃতীয়ত, জ্বালানি খাতের দীর্ঘদিনের সমস্যা।
mzamin

No comments

Powered by Blogger.