আসিফ নজরুলকে হেনস্তা জাতির কলঙ্ক, রাখাল চন্দ্র নাহা’র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বীরউত্তম
কক্সবাজারের ডিসি টাঙ্গাইলে, নোয়াখালীর ডিসি হয়তো ফরিদপুর, ফরিদপুরের জনকে যশোর কিংবা দিনাজপুর। এখনো তাই হচ্ছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনা আর স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ সব একাকার করে ফেলা হয়েছে। শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধু যেমন এক না, শেখ হাসিনা আর প্রকৃত আওয়ামী লীগও এক না। আমরা অনেক ডিক্টেটর দেখেছি, তার মধ্যে বিশেষ করে সামরিক ডিক্টেটর, অনেক রাজতন্ত্রও দেখেছি। কিন্তু হাসিনাতন্ত্র যারা দেখেনি তারা এক ব্যক্তি কীভাবে রাষ্ট্র চালায় বা চালাতে পারে সেটা ভাবতেও পারবে না। গত ১০ তারিখ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে শেখ হাসিনার তল্পিবাহকরা যা করেছে বা করলো তা অভাবনীয়। রাখালের ‘বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে’ করতে করতে যেদিন বাঘে গিলে খাবে সেদিন কেউ ফিরাতে আসবে না। অসুবিধা হলো ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই শেখ হাসিনার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। একজন সাধারণ মানুষের যতটা জ্ঞান গরিমা শিক্ষা দীক্ষা মেধা থাকে নেত্রী শেখ হাসিনা, বোন হাসিনার মধ্যে তার বিন্দুবিসর্গও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে এক লেখাতে লিখেছিলাম, ড. ওয়াজেদ মিয়া যদি যথাযথ সেবাযত্ন পেতেন তাহলে তিনি পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন হতে পারতেন কিনা বলতে পারবো না, তবে আমাদের দেশে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু অবশ্যই হতেন। ১০ তারিখ নূর হোসেন দিবসে কি প্রয়োজন ছিল এই নকশা করার? মানুষকে একটু শান্তিতে স্বস্তিতে থাকতে দিলে কি এমন ক্ষতি? কিন্তু না, তা তিনি থাকতে দিবেন না। তিনি সকালে আসেন, বিকালে আসেন- এটা সত্য নয়, অত সহজও নয়। শেখ হাসিনাকে নিয়ে অনেকেই হয়তো ভবিষ্যদ্বাণী করবেন। আমার তেমনটার কোনো ইচ্ছা নেই। কিন্তু তার যে বয়স, তার যে বিচার বিবেচনা, মেধা তাতে কোনোমতেই এক যুগের আগে ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। হ্যাঁ, কিছুটা যন্ত্রণা দিতে পারবেন, গোলমাল করতে পারবেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ছবি পদদলিত করে সিনক্রিয়েট করতে পারবেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। হ্যাঁ এটা ঠিক, মানুষ বড় কষ্টে আছে। সেই কষ্ট দূর করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যতটা সাফল্য আশা করা গিয়েছিল কেন যেন ততটা হচ্ছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণহীন, সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া, মানুষ কোনোমতেই সংসার চালাতে পারছে না।
অন্যদিকে অতি সম্প্রতি নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ অনেকের কাছেই পছন্দ হয়নি। আওয়ামী লীগ বাদ দিয়ে মানুষ পাবে কই? ক্ষমতার আওয়ামী লীগ, অর্থবিত্তের আওয়ামী লীগ- সে তো দেশব্যাপী। যার কারণে প্রকৃত দেশপ্রেমিক দীর্ঘদিন কোণঠাসা হয়েছিল। এখনো তারা কোণঠাসা। বিত্তশালী আওয়ামী লীগ সব জায়গায়। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পাল্লায় পড়ে রাজনীতির এমন অধোগতি প্রকৃত রাজনীতিকরা কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই যখন যাকে যেখানেই বসানো হচ্ছে হাসিনার নেশপেশ অবশ্যই থাকছে। যা নিয়ে অসন্তোষও দেখা দিয়েছে। দেশের মানুষ সব সময়ই চায় সুস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হোক, মানুষ শান্তিতে থাকুক, বিচার ব্যবস্থার উপর সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসুক। এসব ক্ষেত্রে আর সামান্য একটু গতি এলে সাধারণ মানুষ আশান্বিত হতো। আর একবার মানুষ আশান্বিত হলে কেমন কি হয়, কতোটা হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাক্রমশালী পাকিস্তানি হানাদার পশু শক্তিকে পরাজিত করে আমরা দেখিয়েছি, ’৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাংলার ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়ে দেখিয়েছে আর এই সেদিন যে অধ্যাপক ড. ইউনূসকে সকাল বিকাল কোর্ট- কাচারির বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতে হতো তাকে মসনদে বসিয়েছেন দেশের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। এসবই আল্লাহর ইচ্ছা, সাধারণ ছাত্র-জনতার কর্মকাণ্ড। দুর্ভাগ্য আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেই না। এরপরও যারা অমনটা করবেন তাদের পরিণতি দু’দিন আগে আর দু’দিন পরে একই হবে। উপদেষ্টা নির্বাচনে বেশ অসন্তোষ আছে। যার বহিঃপ্রকাশ কয়েকদিন থেকে শুরু হয়েছে। তবে একটা জিনিস বলবো নেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকার চাইতে কাউকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর দক্ষতা-যোগ্যতা অনেক বেশি। তা না হলে সদ্য নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ছবি পদদলিত করে তার কাছে পাঠানোর চিন্তা অনেকের মধ্যে হওয়ার কথা নয়। তা তিনি চিন্তা করেছেন এবং আমার বিশ্বাস তিনি অবশ্যই ওসব করে ছাড়বেন। কারণ টাকা দিয়ে অনেক কিছু করা যায়। অনেকেই করেছেন।
শেখ হাসিনার কাছে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে। শুধু শেখ হাসিনা কেন, যারাই গত ১৫-১৬ বছর ক্ষমতার আশপাশে ছিলেন সবার কাছে অচিন্তনীয় অর্থ সম্পদ রয়েছে। সেইসব সম্পদ ব্যয় করে কতোটা কাজের কাজ করতে পারবেন হলফ করে বলতে পারি না। কিন্তু অকাজ-কুকাজ অনেকটাই করতে পারবেন। এটা বিগত দিনের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া। তাই সফল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা আরামে গা এলিয়ে দিলে চলবে না। তাদের সফলতা নির্ভর করে তাদের সচেতনতার উপর। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ৫-১০ জনে মিলে জেনেভার মতো জায়গায় অপমান অপদস্থ হেরাজ করা গেলে পৃথিবীর বহু দেশ পড়ে আছে আমাদের দেড় কোটির উপর বাঙালি প্রবাসে বাস করে। তারা বিএনপি, জামায়াত যেমন করে তেমনি আওয়ামী লীগও করে। তাই অশান্তি সৃষ্টিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। এক সময় দেখতাম দেশের ভেতরে যত দলাদলিই থাকুক দেশের বাইরে আমরা এক দল, এক মত। কিন্তু এখন দেশের বাইরেও মারামারি কাটাকাটি হানাহানি করি। এটা খুব ভালো লক্ষণ নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এ ব্যাপারে যথাযথ সক্রিয় হতে আন্তরিক অনুরোধ জানাচ্ছি।
জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত সত্য। মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। মৃত্যু থেকে কারও মুক্তি নেই। সময় এলে সবাইকে এপার থেকে ওপার যেতে হবে। তেমন একটি মৃত্যু রাখাল চন্দ্র নাহার। আমার জন্ম টাঙ্গাইল, নাহারের জন্ম কুমিল্লার দেবিদ্বার। সে হিন্দু, আমি মুসলমান। মিল শুধু একটা ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা, রাখাল চন্দ্র নাহারও একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিষয় সম্পত্তি নিয়ে যা হয় এখানেও তাই হয়েছে। সামান্য জমিজমা নিয়ে বিরোধে ২৬/০২/১৯৯৯ সালে দীনেশ চন্দ্র দত্তের সঙ্গে রাখাল চন্দ্র নাহার পরিবার পরিজনের ঝগড়াঝাটি হয়। লাঠিসোটা নিয়ে মারামারিও হয়। রাখাল সেদিন ঘটনাস্থলে ছিল কিনা আদৌ তার প্রমাণ হয়নি। অথচ প্রথমে তার ফাঁসি, পরে যাবজ্জীবন, সবশেষে গত ২রা জুলাই ২০২৩ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছিল। গত ৯/১১/২০২৪ এ ধরাধামের সমস্ত জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে পরপারে চলে গেছে। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হঠাৎই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য জায়গার ১০-১২ জন ছেলেমেয়ে ও কয়েকজন বয়সী মানুষ এসে হাজির।
রাখাল চন্দ্র নাহা নামে একজন মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হচ্ছে। আপনি একটা কিছু করুন। সাধারণত নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এতটা পথ এসেছি। তাই কোনো কিছুই খুব একটা বিচলিত করে না। একদিন যে চলে যাবো সেটা সব সময় বুকের মধ্যে লালন করি। সেই রাতেই গিয়েছিলাম মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব শুনে বলেছিলেন, আপনি একজন সরল সোজা মানুষ। আপনি মনে করেন আমি সব করতে পারি। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি না। সরকারের কাছে যান। তখনকার সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমেদের কাছে গেলে তিনিও খুব সরল সোজা ভাবে বলেছিলেন, আমার কিছু করার নেই। যা কিছু করার ক্যান্টনমেন্ট থেকে করা হয়। আপনি সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদকে বলুন। সেনাপ্রধানের কার্যালয়েও গিয়েছিলাম। কারণ কার্যালয়টা আমার বহুদিনের চেনা। কারণ ১৬ই ডিসেম্বর ’৭১ ভারতীয় তিন সেনাপতির সঙ্গে নিয়াজির গুহায় গিয়েছিলাম। সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রাখাল চন্দ্র নাহার জীবন রক্ষার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিলেন। দিনটা ছিল ৭ই এপ্রিল ২০০৮। সারাদিন মারাত্মক উত্তেজনায় কেটেছিল। রাত ১১টার পর বীর মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি হবে রাত ১০টা পর্যন্ত তেমন কিছুই জানি না। হঠাৎ রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফোন আসে, রাখাল চন্দ্র নাহার ফাঁসির আদেশ স্থগিত করা হয়েছে। ফাঁসির পরিবর্তে যাবজ্জীবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। বড় একটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম নির্বাচিত সরকার এলে রাখাল চন্দ্র নাহা মুক্তি পেয়ে যাবে। এরপর নির্বাচিত সরকার আসে। নেত্রী শেখ হাসিনার সরকার। এক আজব সরকার। আইনমন্ত্রী হন আনিসুল হক। আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী।
কলকাতার বেকার হোস্টেলে থাকতেন। তুই তুমি সম্পর্ক ছিল তাদের। একটা সোনার মানুষ সিরাজুল হক। তারই ঘরে এমন একটি মানুষ কী করে জন্মেছিল আমি কোনো কূলকিনারা পাই না।
আগে যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। রেয়াত মুরীদ বাদে জেল খাটতে হতো ১৪ বছর। ’৯০-এর গণআন্দোলনে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়ে এক কলমের খোঁচায় ২০ বছরকে ৩০ বছর করে দিয়েছিলেন। একটা মানুষের জীবন থেকে একটা দিন চলে গেলে কেমন হয়- এ সমস্ত লোকেরা তা ভেবেও দেখে না। আমি অন্ততপক্ষে ১০ বার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একেবারে হতদরিদ্র নিরীহ মানুষ হিসেবে রাখাল চন্দ্র নাহাকে মুক্তি দিতে। কিন্তু মুক্তি হয়নি। অনুরোধ করেছি বিশেষ বিশেষ দিনে মুক্তি দিতে- সে মুক্ত হয়নি। নাহাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২৬/০২/১৯৯৯ সালে। তার যে মামলা এবং যখন সাজা হয় তখন যাবজ্জীবন ছিল ২০ বছর। সেই অনুসারে ২০১৪ সালে তার মুক্তি পাবার কথা। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সে যদি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোনো রকম রেয়াত মুরীদ পায় তাহলে জেলের সময় আরও কমার কথা।
অন্যদিকে ৩০ বছরের জেল হলেও ২০ বছরের একদিন বেশিও কারও জেল খাটার বিধান নেই। জেলে নতুন কোনো অপরাধ না করলে ৩০ বছরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগীরা ২০ বছর একদিনের মাথায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত আকাশের নিচে আসে। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাখাল চন্দ্র নাহার ক্ষেত্রে তা হয়নি একমাত্র আনিসুল হকের মতো একজন বিচার বিবেচনাহীন আইনমন্ত্রীর কল্যাণে। সে যদি আরও কিছুদিন বাইরে থাকতো, সন্তান সন্ততি স্ত্রী আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থাকতো তাহলে যেদিন চলে গেছে ঐদিনই চলে যেতো কিন্তু একটা শান্তি ও স্বস্তি থাকতো। কিন্তু কাউকে নাকি একবারের বেশি কোনোক্ষেত্রে ক্ষমা করা যায় না বলে রাখাল চন্দ্র নাহাকে মুক্ত হতে দেননি। আজ আনিসুল হকের দুর্গতি তো মাঝে মধ্যেই মনে হয় সেখানে রাখাল চন্দ্র নাহারও হুতাশ অনেকাংশে কাজ করেছে। রাখাল চন্দ্র নাহার জন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে একটি বীরনিবাস বরাদ্দের অনুরোধ করেছিলাম। মাননীয় মন্ত্রী যথাযথ কর্তৃপক্ষকে সে নিবাসটি ৪/১০/২০২৩ এ প্রদানের আদেশও করেছিলেন। কিন্তু সেটা কেমন কি হয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনই জানেন। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন তার সৃষ্টি রাখাল চন্দ্র নাহাকে ক্ষমা করেন।
No comments