গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বিএনপি’র রাজনীতি, একটি নিরীক্ষা by জি এম রাজিব হোসেন
গত বেশকিছু দিন ধরে দুর্গাপূজার শান্তিপূর্ণ আয়োজন নিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি ছিল। তবে গত ১৩ই অক্টোবর কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের হিন্দু সমপ্রদায়ের বৃহত্তম দুর্গোৎসব শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় সবার মনে স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কারণ পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের দোসররা আবার কখন কিসের ওপর সওয়ার হয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া নতুন এ বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে সেটা সময়সাপেক্ষ। তবে তাদের ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে নেই। তারা বিভিন্নভাবে দেশে পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তাই তারা কখনো বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলনরত স্টেকহোল্ডারদের ভেতরে ঢুকে উস্কানি দিয়ে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। কখনো সংখ্যালঘু কার্ড ব্যবহার করছে। কখনো অন্যান্য ইস্যুকে বড়ো করে দেখানোর মরিয়া চেষ্টা চলছে। সে কারণে এবারের দুর্গোৎসব ঘিরে স্বয়ং সংখ্যালঘুদের মধ্যেই নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। তবে সরকারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় পূজা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ায় অশুভ শক্তির অপতৎপরতা আপাতত থেমেছে। এ কথা বলাই যায়, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা আয়োজনে সরকার শতভাগ সফল হয়েছে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষও চরম সহযোগিতা করেছে।
এক্ষেত্রে বিএনপি একধাপ এগিয়ে ছিল সন্দেহ নেই। হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষ যাতে নিরাপদ, উৎসবমুখর ও শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারে সে লক্ষ্যে এ দলটি দেশের প্রতিটা পূজামণ্ডপের জন্য আলাদা আলাদা কমিটি করে দেয়। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনায় এসব কমিটি করা হয় বলে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার এক খবরে জানায়। পূজা শুরুর দিনই গত ৯ই অক্টোবর যখন এ খবরটা দেখলাম সেদিন খুব ভালো লেগেছে। মনে হয়েছে দেশের মানুষ একটা রাজনৈতিক দলের কাছে এটাইতো প্রত্যাশা করে।
এ প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের সামপ্রতিক একটি বক্তব্য দেশের মানুষ বিশেষ করে হিন্দু সমপ্রদায়ের লোকজনকে আরও আশান্বিত করেছিল বলে আমার বিশ্বাস। পূজা চলাকালীন তিনি তার এক অফিসিয়াল ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন-“স্বাধীন বাংলাদেশে তথাকথিত সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নিয়ে চিন্তার কোনো অবকাশ নেই। দেশের প্রতিটা নাগরিক সমান অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করবে-এটাই বিএনপি’র নীতি, এটাই বিএনপি’র রাজনীতি। আমরা বিশ্বাস করি; দল-মত-ধর্ম যার যার, কিন্তু রাষ্ট্র সবার, নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার সবার। বাঙালি-অবাঙালি, বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী কিংবা সংস্কারবাদী প্রত্যেক নাগরিকের একমাত্র পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। এই বাংলাদেশ আপনার, আমার, আমাদের সবার।” তারেক রহমান এ বক্তব্যের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা দিয়েছেন তা হলো- বাংলাদেশের সকল মানুষ এক ও অভিন্ন।
আমি ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে একবার মালয়েশিয়া ভ্রমণে গিয়েছিলাম। সে সময় দেশটির বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা একটি গ্রাফিতি আমি দেখেছিলাম। গ্রাফিতিতে হাতের তর্জনী আঙুল উঁচু করে রাখা ছিল। আমার বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছিল যে এটি মালয়েশিয়ার কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী ও আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি ডা. মাহাথির বিন মোহাম্মদের ‘এক মালয়েশিয়ার’ সাইন। অর্থাৎ তিনি মালয়, ওরাং অসলি, সাবাহ ও সারাওয়াকের আদিবাসী, চীনা, ভারতীয় ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সবার পরিচয় যে মালয়েশীয় তা বুঝিয়েছেন। পূজার সময় তারেক রহমানের বক্তব্যটা আমার কাছে অনেকটা এরকমই মনে হয়েছে। তিনি তার বক্তব্যে আমাদের এক বাংলাদেশি পরিচয়কে সামনে এনেছেন। তার এ বার্তা অভূতপূর্ব কাজে দিয়েছে। এরপর আমরা দেখেছি বিএনপি’র নেতাকর্মীরা সুন্দরভাবে পূজা আয়োজনে দিনরাত পরিশ্রম করেছে।
এর আগে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জামায়াত-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এমনকি হেফাজত ইসলামের কর্মীদেরও মাদ্রাসার ছাত্রদেরকে হিন্দু সমপ্রদায়ের বাড়িঘর ও ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিতে দেখা যায়। দেশে অনেকদিন ধরে একটা কথা প্রচলিত আছে যে হিন্দুরা আওয়ামী লীগ আমলে তুলনামূলক ভালো থাকে। তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা অনেক সময় এ দাবি করেছেন। তাদের এ দাবি যে মিথ্যা তা ৫ই আগস্টের পর জামায়াত-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডে প্রমাণিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তারেক রহমানের আরেকটি বক্তব্যকে সামনে না আনলে অযথার্থ হবে। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার ফেসবুকে প্রচারিত এক ভাষণে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছিলেন- “বিজয়ের এই আনন্দঘন সময় শান্তভাবে উদ্যাপন করুন। অনুগ্রহপূর্বক কেউ প্রতিশোধ বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না। কেউ নিজের হাতে দয়া করে আইন তুলে নেবেন না।” কী চমৎকার তার বাক্যবাণ, কী চমৎকার তার আকুতি। বিদেশে নির্বাসিত জীবনে থেকেও নিজের দেশ বাংলাদেশকে শান্ত, স্থিতিশীল দেখার কী আকাঙ্ক্ষা তিনি ব্যক্ত করেছেন। তার এ আহ্বানের প্রতিফলনও কিন্তু আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ২০১৮ সালের ২০শে আগস্ট ভোলায় এক অনুষ্ঠানে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রথম দিনেই লক্ষ মানুষ হত্যা করবে (প্রথম আলো)। এরপর ২০২৩ সালের ২০শে মার্চ আওয়ামী লীগের সাবেক মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বিএনপি আবার ক্ষমতায় এলে ১০ লাখ লোক মেরে ফেলবে (কালের কণ্ঠ)। কিন্তু আমরা বাস্তবে কী দেখলাম? আওয়ামী লীগের পতনের অব্যবহিত পর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কেউ মারা যায়নি। তাৎক্ষণিক গণরোষে পড়ে কিছু মানুষ মারা গেছে এটা সত্য। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে তাৎক্ষণিক গণরোষে যাদের মৃত্যু হয় তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ছিল।
২০২২ সালের নভেম্বরে কাতার বিশ্বকাপের উদ্বোধনী দিনে কাতার-ইকুয়েডর ম্যাচ শেষে জাপানি ফুটবলপ্রেমীরা আল বায়ত স্টেডিয়াম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করার একটি খবর সে সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। ৫ই আগস্টের পর আমরা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে একটি পরিবর্তন দেখেছিলাম। পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশের অনুপস্থিতির কারণে সে সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে দায়িত্ববোধের একটা তাগিদ আমরা দেখেছি। তখনো কিন্তু সাধারণ ছাত্র-জনতার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ছাত্রদল-যুবদলের কর্মীরা সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা রাস্তা পরিষ্কার করেছে। ডাকাতির উৎপাতরোধে রাত জেগে শহর পাহারা দিয়েছে। সবার মধ্যে একধরনের একাত্মতা দেখা গেছে। যেন আলাদা কোনো দল নেই। সবাই এক। আওয়ামী লীগের দুঃশাসন যেন সবাইকে একটা বন্ধনে আবদ্ধ করেছে। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যার সময়ও দলমত নির্বিশেষে সবাই এগিয়ে এসেছেন। ত্রাণ নিয়ে বন্যাকবলিত এলাকায় হাজির হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরাও বন্যাদুর্গতদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিয়েছেন।
১১ই অক্টোবর যুগান্তর পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন ধারার ছাত্র রাজনীতির রোডম্যাপ প্রকাশ করবে ছাত্রদল। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে সাধারণ ছাত্রদের মতামত নিচ্ছেন। বৃক্ষরোপণ করছেন। অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। এটাকে অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হয়। কারণ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে শিক্ষার্থীরা ছাত্র-রাজনীতির ওপর থেকে কিছুটা মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মন জয়ের ছাত্রদলের প্রচেষ্টা ইতিবাচক। কারণ ছাত্র-রাজনীতির প্রয়োজন আছে। আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির একটি গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও আছে। তাই দেশের আগামীর নেতৃৃত্ব তৈরির সুতিকাগার ছাত্র-রাজনীতির হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে ছাত্রদলের প্রচেষ্টা একটা ভালো উদ্যোগ।
তবে এত কিছুর পরও কিছু নেতাকর্মীর অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডে বিএনপিকে মাঝে মধ্যেই বিব্রত হতে হচ্ছে। সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারের অনুসারীরা এতে আবার রসদও জোগাচ্ছে। এটা সত্য বাড়ির কোনো সদস্য কোনো ভুল করলে যেমন অভিভাবককে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়, ঠিক তেমনি কিছু নেতাকর্মীর কর্মকাণ্ডের কারণে বিএনপিকেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। আসলে বিএনপি এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল। এখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলন রয়েছে। কোটি কোটি কর্মী সমর্থক রয়েছে। এর মধ্যে কিছু মানুষ দলীয়শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ড করলেও বেশির ভাগ নেতাকর্মীর অবস্থান এর বাইরে। তারা এটাকে পছন্দ করছেন না। শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীর সংখ্যা কম হলেও এর দায়ভার বিএনপির ওপর বর্তায় বটে। তবে এক্ষেত্রে যে বিষয়টা বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন তা হলো- দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব কী করছেন। তারা কী কর্মীদের শৃঙ্খলা ভঙ্গকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন নাকি তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন। এটা দেখতে হবে। এখন পর্যন্ত যেটা দেখা যাচ্ছে বিএনপি শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই এসব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে বলেছে, গণঅভ্যুত্থানের পর দলীয় আদর্শ বিরোধী ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে এ পর্যন্ত ১০২৩ জন নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৪ জনের পদ স্থগিত, ৩৫ জনকে সতর্ক ও ৪ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেয়া হয়েছে। এটাই আসলে দেশের মানুষ দেখতে চায় যে দল কী পদক্ষেপ নিচ্ছে। এর মাধ্যমে বিএনপি যে নতুন ধারার গুণগত রাজনীতির চর্চা ঘটাতে চায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। এটা স্পষ্টতই প্রশংসনীয়।
সিনিয়র সাংবাদিক
No comments