ছিনতাই আতঙ্ক নগর জুড়ে by শুভ্র দেব

ছিনতাইকারীর রাজ্যে পরিণত হয়েছে রাজধানী ঢাকা। দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি সন্ধ্যায়, রাতে ও ভোরেও ছিনতাই হচ্ছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে শুরু করে বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির টাকা ছিনতাই, পথচারী, রিকশা আরোহী যাত্রীদের থামিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া গণপরিবহনে বসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে মোবাইল, ব্যাগ, ল্যাপটপসহ অন্যান্য মূল্যবান জিনিসও ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছে ছিনতাইকারীরা। ছিনতাইকারীরা দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করছে। প্রকাশ্যে অটোরিকশা ছিনতাই, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের টাকা বহনকারী গাড়িতে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনাও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। প্রাণঘাতী ছিনতাইয়ের ঘটনাও রয়েছে অহরহ। এছাড়া ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে আহত হচ্ছেন শত শত মানুষ। অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টসূত্রগুলো বলছে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অবাধে গুলি করে মানুষ হত্যাসহ নানা কারণে পুলিশের উপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা চলে যায়। এতে করে জনগণের সঙ্গে পুলিশের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিক্ষুব্ধ জনগণ থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ, মালামাল লুট করাসহ পুলিশের ওপর আক্রমণ করে। অনেক পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এরপর থেকে পুলিশের মনোবল ভেঙে যায়। স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড থেকে তারা দূরে চলে যায়। থানায় অগ্নিসংযোগ করার কারণে পুলিশের যানবাহন পুড়ে যায়। ওই সময় পুলিশের আইজিপি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের পদবিতে পরিবর্তন আসে। ঢাকায় যারা দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত ছিলেন তাদের ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ইউনিটে বদলি করে দেয়া হয়। আর ঢাকায় যারা নতুন করে বদলি হয়ে এসেছেন তারা ডিএমপি’র কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বুঝে উঠতে সময় নিচ্ছেন। বদলির মধ্যে থাকার কারণে বিভিন্ন থানা পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের উপস্থিতিও কম। যানবাহন না থাকার কারণে পুলিশের টহল কার্যক্রম হচ্ছে না। এতে চোর- ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়েছে। টহল না থাকায় দেদারছে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, দেশে ১০ হাজারের বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এদের সংখ্যা বেশি। ঢাকার ছিনতাইকারীদের নিয়ে গত বছর একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ। এতে বলা হয়, ডিএমপি’র সাসপেক্ট আইডেন্টিফিকেশন অ্যান্ড ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (এসআইভিএস) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ছয় হাজার ১৯৮ জন ছিনতাই ও ডাকাতিতে জড়িত। এর মধ্যে ছিনতাইকারী এক হাজার ৭৩৭ জন। ঢাকায় ছিনতাই ও ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে এসআইভিএস’র তথ্য কাজে লাগিয়ে এই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চলছে। সূত্রগুলো বলছে, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য বেশি গুলিস্তান, চানখাঁরপুল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা, মালিবাগ রেলগেট, বাড্ডা, মগবাজার, শাহবাগ, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, নিউ মার্কেট, মতিঝিল, যাত্রাবাড়ী ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায়। পুলিশ মাঠ পর্যায়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানতে পেরেছে, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী ও ডাকাত রয়েছে তেজগাঁও এলাকায়। সবচেয়ে কম মিরপুর এলাকায়। সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারি ও ডাকাত রয়েছে শাহবাগ, ভাটারা ও শেরেবাংলানগর থানা এলাকায়। সবচেয়ে কম ছিনতাইকারী ও ডাকাতের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে দক্ষিণখান, উত্তরখান ও উত্তরা-পূর্ব থানা এলাকায়।

ডিএমপি’র বিভিন্ন অপরাধ নিয়ে কাজ করেন এমন কমকর্তারা বলছেন, ঢাকায় বেশির ভাগ ছিনতাই মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত। বিশেষ করে ভোরবেলা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, সায়েদাবাদ, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনালে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা। যাত্রীরা যখন বাস ও ট্রেন থেকে নেমে রিকশা, সিএনজি ও পায়ে হেঁটে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে চায় তখনই অন্ধকার বা আবছা অন্ধকারে যাত্রীদের টার্গেট করে ছিনতাইকারীরা। এছাড়া দিনের বেলা বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংকের গ্রাহকদেরও টার্গেট করে তারা।

পুলিশ সদরদপ্তর জানিয়েছে, শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে ছিনতাই রোধে রেঞ্জ পুলিশ, পুলিশ কমিশনার, র‌্যাবসহ সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ছিনতাই প্রবণতা ঢাকায় বেশি হওয়াতে ঢাকার ৫০ থানা, ডিবিকে এ নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি র‌্যাব সদরদপ্তর। পাশাপাশি র‌্যাব সদরদপ্তরও এ নিয়ে গুরুত্বসহকারে কাজ করছে। র‌্যাব’র যেসব ব্যাটালিয়ন ঢাকায় কাজ করছে তারা ঢাকার কোন কোন স্থানে বেশি ছিনতাই এবং অন্যান্য অপরাধ বেশি হয় তার একটি ম্যাপ তৈরি করছেন। সে অনুযায়ী তারা ছিনতাইকারী ধরতে পরবর্তী ব্যবস্থা নিবেন। ডিএমপি জানিয়েছে, ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন এলাকায় টহল বাড়ানো হয়েছে। ঢাকার প্রতিটি থানার ওসিদের এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুুযায়ী ডিএমপি’র আটটি অপরাধ বিভাগের (ক্রাইম) প্রতিটি এলাকায় প্রতিদিন রাত ৮টার পর থেকে পরদিন ভোর পর্যন্ত এই বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিএমপি’র উপ-কমিশনাররা (ডিসি) অভিযান তদারকি করছেন। যে এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি হবে সেই এলাকার ওসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

শুধু যে ছিনতাই হচ্ছে তা নয়; পুলিশ বিভিন্ন ছিনতাইয়ের ঘটনায় ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তারও করছে। বৃহস্পতিবার ভোরে ধানমণ্ডির রাপা প্লাজার সামনে অভিযান চালিয়ে তিন ছিনতাইকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে দু’টি চাপাতি, একটি লোহার রড ও ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত একটি হলুদ রঙের পিকআপ ভ্যান জব্দ করা হয়। ধানমণ্ডি থানা সূত্রে জানা গেছে, জেহাদুল ইসলাম মনি ও তার স্ত্রী মির্জা ফাতিমা জাহান দম্পতি ১৬ই অক্টোবর ভোরে বরগুনা থেকে এসে রাসেল স্কয়ার বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি থেকে নামেন। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশাযোগে রওনা হয়ে ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে ধানমণ্ডির রোড নম্বর-১৩/এ, বাসা নম্বর-২৩ এর সামনে পৌঁছান। রিকশা থেকে নামার মুহূর্তে অজ্ঞাতনামা তিনজন ছিনতাইকারী একটি হলুদ রঙের পিকআপ দিয়ে তাদের গতিরোধ করে। তারা ধারালো চাপাতি ও লোহার রড দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে ও মারধর করে ভুক্তভোগীর স্ত্রীর ব্যবহার করা একটি মোবাইল ফোন, একটি ভ্যানিটি ব্যাগ, একটি ইবিএল ব্যাংকের এটিএম কার্ড ও এনআইডি কার্ড ছিনিয়ে নেয়। তাদের মারধরে জেহাদুল ইসলাম মনির স্ত্রী শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হন। ধানমণ্ডি সোসাইটি ঘটনাটি পুলিশকে জানালে ধানমণ্ডি থানা-পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এবং গোয়েন্দা তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তার সবাই একটি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। এ চক্রটি দীর্ঘদিন যাবৎ ধানমণ্ডি, শেরেবাংলা নগর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় পিকআপযোগে ছিনতাই করে আসছিল। গত সোমবার রাত ১০টার দিকে বাড্ডা থেকে পেশাদার সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম সদস্য পারভেজকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। উত্তর বাড্ডার হাজীপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার হেফাজত থেকে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত একটি সুইচ গিয়ার চাকু, একটি ছুরি ও ৬টি মোবাইল উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তার পারভেজ পেশাদার সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে বাড্ডা এলাকাসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় চুরি ও ছিনতাই করে আসছিল।

ডিএমপি আইন ও গণমাধ্যম শাখার উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান গতকাল মানবজমিনকে বলেন, ছিনতাই প্রতিরোধে আমাদের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। পেশাদার ছিনতাইকারী অনেকে আটক হয়েছে। এলিটফোর্স র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌস মানবজমিনকে বলেন, আমাদের ব্যাটালিয়নগুলো তাদের দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় একটা অপরাধ মানচিত্র তৈরি করছে। আমরা শনাক্ত করার চেষ্টা করছি কোন কোন এলাকায় ছিনতাই বেশি হচ্ছে। সে অনুযায়ী র‌্যাবের টহল টিম যে স্পটে বেশি ছিনতাই হয় সেটিকে নজরদারির মধ্যে রেখেছে। এ ছাড়াও আমরা স্থানীয়দের সহযোগিতা নিচ্ছি। তাদের কাছে যদি কোনো তথ্য উপাত্ত থাকে সেটিও সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর বাইরে থানা ও বিভিন্ন সংস্থার চিহ্নিত ছিনতাইকারীদের নজরদারিতে রেখেছি। কেউ জামিনে বের হয়ে আসছে কিনা সেটিও নোট করছি। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা অভিযান চালিয়ে ২০ জনের মতো ছিনতাইকারী ও ৩৩ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছি। তিনি বলেন, হেডকোয়ার্টার্স থেকে ব্যাটালিয়নগুলোকে বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। জনজীবনে স্বস্তি আনার জন্য ডাকাতি ও ছিনতাই নিয়ে কাজ করার কথা বলা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.