লক্ষ্মীপুরে নয়নের শাসন by মারুফ কিবরিয়া ও মো. ইউসুফ

লক্ষ্মীপুর মানেই আবু তাহের পরিবার। গত কয়েক বছর আগেও এই অঞ্চলে ত্রাসের নাম ছিল পরিবারটি। পৌরসভার মেয়রের চেয়ার হারানোর পর কিছুটা হোঁচট খায় এ পরিবার। পরে আবার নিজেদের রাজনৈতিক শক্তির জানান দেন তাহেরের ছেলেরা। যদিও লক্ষ্মীপুর-২ আসনে নাটকীয় উত্থান হয় সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের। কেউ বলেন সম্রাট, কেউ বলেন বাদশা। অল্প সময়েই নয়ন হয়ে ওঠেন লক্ষ্মীপুরের নিয়ন্ত্রক। শহরে প্রচলিত, মূলত সাবেক এমপি কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের পতনেই ভাগ্য খুলে যায় নয়নের। এমপি’র আসনে বসেই লক্ষ্মীপুরে একাধারে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মনোনয়ন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন তিনি। আর এসব কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন নিজের আত্মীয়দের।

স্থানীয়দের মতে, সাবেক এমপি’র অনিয়ম দুর্নীতি অনেকটা মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসার মতো। নিজে মূল নিয়ন্ত্রক থেকে পরিবার আত্মীয়স্বজনদের উপজেলা ইউনিয়নের বিভিন্ন পদে বসিয়ে রাজত্ব কায়েম করেছেন। নুর উদ্দিন নয়নের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, ২০২২ সালে লক্ষ্মীপুরে জোড়া খুনের ঘটনার সঙ্গে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ততা রয়েছে তার। খুনের ঘটনায় মূল আসামি আবুল কাশেম জিহাদীর সঙ্গে এক সপ্তাহ আগেই বৈঠক হয় সাবেক এই এমপি’র।  তবে এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

যেভাবে উত্থান নয়নের: লক্ষ্মীপুরের জেলা উপজেলায় বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এডভোকেট নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন। বাবা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। অনেকটা টানাপড়েনের সংসার বলা চলে। নয়ন নিজে আইনজীবী হলেও স্থানীয়দের মতে, রাজনীতির মাধ্যমেই আয় করেছেন শত কোটি টাকা। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে খুব একটা জনপ্রিয় ছিলেন না তিনি। ২০০৯ সালে সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে লড়েছিলেন নয়ন। সেই ভোটে বিপুল ব্যবধানে হেরে যান। ওই সময় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নয়ন। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এই সময়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় যত অনিয়ম তার হাত ধরেই শুরু হতে থাকে। নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয় পদ ও মনোনয়ন বাণিজ্যের মতো বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ব্যবসায়ী কাজী সহিদ ইসলাম পাপুলের উদয় হয়। তিনি কোনো রাজনীতিক ছিলেন না। তখন পাপুলকে প্রার্থী করা ও সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে ছিলেন এই নয়নই। স্থানীয় একাধিক রাজনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাপুলকে রাজনীতিতে আনা ও এমপি বানিয়ে তার কাছ থেকে নয়ন কমপক্ষে দুইশ’ কোটি টাকা নিয়েছেন। পরবর্তীতে পাপুল কুয়েতে মানব পাচারের মামলায় ফেঁসে গেলে সেই নয়নই আবার এমপি হন।
নিয়োগ বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি: লক্ষ্মীপুর জেলা ও উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রতিটি নিয়োগে মোটা অংকের কমিশন না পেলে কারও চাকরি হতো না। সেই কমিশন দেয়া লাগতো নয়নকে। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই তার এই নিয়োগ বাণিজ্যের কাজটি বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষক বলেন, আমার নিয়োগের জন্য ৭ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। এ রকম আমার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে দিতে হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, যেকোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরেই নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন কমিশন নিতেন।
নিয়োগের বাইরেও সড়কে চাঁদার টাকার বড় অংশ যেতো নয়নের কোষাগারে। লক্ষ্মীপুর শহরে যত সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করে সবক’টি তার নিয়ন্ত্রণে। পরিবহনের এই খাতে নয়নের ক্যাশিয়ার হিসেবে কাজ করতেন কুলি চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি। এই চৌধুরীর ছেলে বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম রকি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়,  জেলায় প্রায় ১০ হাজারের মতো সিএনজি চলাচল করে। এসব সিএনজির প্রতিটি সড়কে নামানোর আগে সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দেয়া লাগতো চৌধুরীকে। এ ছাড়া প্রতিমাসে একেকটি সিএনজি বাবদ সাড়ে ৪ হাজার টাকা চাঁদা আসতো। এই খাত থেকে বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হতো যার বেশিরভাগ অংশ যেতো এমপি নয়নের কাছে।
মনোনয়ন বাণিজ্য: নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের আয়ের বড় একটি উৎস মনোনয়ন বাণিজ্য। লক্ষ্মীপুর জেলায় কোন ইউনিয়নে কে চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন, কোন উপজেলায় কে চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন সব নির্ধারণ করতেন সাবেক এই এমপি। তার ইশারা ছাড়া কোনো প্রার্থীই মনোনয়ন পাবেন না। ইউপি কিংবা উপজেলায় নৌকা প্রতীক পেতে হলে নয়নকে দিতে হবে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা। কারও কারও ক্ষেত্রে কম বা বেশিও নেয়া হতো। ২০২১ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় রায়পুরের দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন আবদুর রশিদ মোল্লা। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু টাকা দিয়েও মেলেনি নৌকা। পরে রশিদ মোল্লা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, টাকা দেইনি বলে মনোনয়ন পাইনি। কাকে টাকা দেননি জানতে চাইলে কৌশলে এড়িয়ে যান তিনি। তবে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, রশিদ মোল্লা সাবেক এমপি নয়নকে ৪০ লাখ টাকা দেন নৌকা প্রতীকের জন্য। কিন্তু নয়ন সেই ইউনিয়নে অন্য এক প্রার্থীকে বেশি টাকা নিয়ে মনোনয়নের ব্যবস্থা করে দেন। উত্তর চর আবাবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী ছিলেন শহীদ উল্লাহ বিএসসি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তিনি এমপি নয়নেরই আত্মীয়। কিন্তু টাকা দিয়েও মনোনয়ন পাননি। এ বিষয়ে শহীদ উল্লাহ বলেন, আমার কাছে কেউ টাকা চায়নি। আমি এসব কিছু জানি না।  
নয়নের ডান হাত বাকি বিল্লাহ: সাবেক এমপি নুর উদ্দিন নয়নের ডান হাত ছিলেন লক্ষ্মীপুরের রায়পুর পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাকি বিল্লাহ। রায়পুর শহরে একটি জলসাঘরে নিয়মিত আসর বসাতেন। এই আসরে ঠিকাদারির নিয়ন্ত্রণ, সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের চাঁদা, থানার সালিশ বাণিজ্য, সিএনজি স্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি দপ্তরে চাঁদাবাজির পরিকল্পনা করা হতো। এসবের নেতৃত্ব দিতেন বাকি বিল্লাহ। রায়পুর থেকে আদায় করা চাঁদার টাকার বড় অংশ যেতো নুর উদ্দিন নয়নের কোষাগারে। রায়পুর পৌরসভায় সাইফুদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীর ৫টি দোকান ছিল। সেই দোকানগুলো দখলে নেন বাকি বিল্লাহ। সেখানেই  সাজানো হয় জলসাঘর। সাইফুদ্দিন মানবজমিনকে বলেন, বাকি বিল্লাহ আমার দোকান দখল করে জলসাঘর সাজিয়েছিল। এখানে বসে রায়পুরের সব কুকীর্তির পরিকল্পনা করতো সে। আমাকেও মারধর করেছে। আমার পরিবারের ওপরও নির্যাতন করেছে। এসব নিয়ে আমি মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। শুনেছি এমপি’র ইন্ধনে এসব অপকর্ম করে বেড়াতো তারা।

আত্মীয়ের সিন্ডিকেট এবং সঙ্গী তাহের পরিবার:
লক্ষ্মীপুরের সাবেক ও প্রয়াত পৌর মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। এক সময় তার ইশারাতেই চলতো পুরো লক্ষ্মীপুর। সবশেষ পৌরসভার নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি তাহের। তার বছর দেড়েকের মাথায় মৃত্যু হয় তার। এরপর লক্ষ্মীপুরের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই চলে যায় নুর উদ্দিন নয়নের হাতে। তবে তাহের পরিবার তার আত্মীয় হওয়ায় সেই পরিবারকে হাতে রাখেন সাবেক এমপি। জানা যায়, আবু তাহেরের মেজো ছেলে সদ্য অপসারিত উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান  ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন টিপু। তিনি সাবেক এমপি’র মামাতো বোনের জামাই। সদর উপজেলায় যত চাঁদাবাজি, টেন্ডার বাণিজ্য সবই নিয়ন্ত্রণে রাখেন টিপু। অস্ত্রও সঙ্গে রাখতেন তিনি। সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর নির্বিচারে গুলি করার ভিডিও চিত্র ধরা পড়ে স্থানীয় সাংবাদিকদের ক্যামেরায়। জানা যায়, ৪ঠা আগস্ট টিপু ও তার সঙ্গীদের গুলিতেই নিহত হন অন্তত ৪ জন। এ ছাড়া ৪শ’র বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ওইদিন তার দুই বাড়িতে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। এ সময় টিপুর ৭ সহযোগী গণপিটুতে নিহত হয়।
নয়নের ভগ্নিপতি রায়পুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলার অপসারিত চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ ও তার মামা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চররুহিতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর পাটোয়ারী। এ ছাড়া রায়পুরের সোনাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিউল আজম চৌধুরী সুমন সাবেক এমপি’র শ্যালক। এই ৩ আত্মীয়ের মাধ্যমে জেলা ও উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে যত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সব ধরনের অনিয়ম কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন নয়ন। বিভিন্ন স্তরে দলীয় পদ ব্যবহারের মাধ্যমে অনিয়মের মাধ্যমে শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন সাবেক এমপি’র আত্মীয়রাও।
শুধু তাই নয়, নয়নের স্ত্রী লুবনা চৌধুরীও ছিলেন এই লক্ষ্মীপুরবাসীর জন্য আতঙ্কের নাম। স্বামীর প্রভাব খাটিয়ে তিনি স্থানীয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতির পদ বাগিয়ে নিতেন। ওইসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন লুবনা।
সরকার পতনের পর আত্মগোপনে যাওয়া নুর উদ্দিন তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রেখেছেন। এ কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.