বেহুদা প্যাঁচাল: যেভাবে পতনের দরজা খোলেন হাসিনা by শামীমুল হক

অবিশ্বাস্য। অকল্পনীয়। চরম নাটকীয়। দুর্দান্ত প্রতাপশালী শাসক। স্বৈরশাসক। হাল আমলে বিদেশি মিডিয়া নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসক তকমা দিয়েছে। যিনি দীর্ঘ প্রায় ষোল বছর অঙ্গুলির হেলনিতে বাংলাদেশটাকে চালিয়েছেন। টুঁটি চেপে ধরেছেন বিরোধী মতকে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভিশন-২০২১ এর কথা বলেছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর চলে যান ভিশন ২০৪১-এ।

আর ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর ভিশন-২১০০ নিয়ে ভাবনা তুলে ধরেন। অর্থাৎ আজীবন তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। তবে আপাতত ২১০০ পর্যন্ত তার ভিশন নিয়ে এগিয়ে যাবেন। এমন ভাবনাও কি সম্ভব? মানুষের এক সেকেন্ডেরও নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। যাই হোক- যিনি নিজেকে সর্বেসর্বা ভাবতেন। অন্য সবাইকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতেন। বাংলাদেশের হর্তাকর্তা- সেই তিনি এমনভাবে ধপাস করে পড়বেন- এটাই ছিল অকল্পনীয়। অবিশ্বাস্য। যার রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকার। আরও ছিল বিএনপি-জামায়াত। তার কথার প্রতিবাদ করলেই দেয়া হতো রাজাকার তকমা। নিজেরা প্রকাশ্যে আকাম করে বলতেন এগুলো বিএনপি-জামায়াতের কাজ।

সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে উস্কিয়েছেন নিজেরাই। এখানেও বিএনপি- জামায়াত দেখেছেন ওনারা। সব ঠিকঠাক চলছিল। একটি বক্তব্য আগুনে ঘি ঢালে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তার স্বভাবভঙ্গিতে আন্দোলনকারীদের হুমকি দেন। বলে উঠেন, এই ছাত্রদের দমাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। কাদেরের এ কথায় ছাত্রলীগ উজ্জীবিত হয়। হামলে পড়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর। নির্মম নির্যাতন চালায়। নারী শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায়নি ছাত্রলীগের রোষানল থেকে। আহতদের নিয়ে যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে অন্য শিক্ষার্থীরা তখন সেখানেও হাজির হয় শ’দুয়েক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী। তারা সেখানেও হামলা চালায়। নারকীয় এমন ঘটনায় ফুঁসে উঠে ছাত্রসমাজ। ফুঁসে উঠে গোটা দেশ। পরদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেয়া সবাই লাঠি নিয়ে হাজির হন শাহবাগে। এদিনও হামলা চালায় ছাত্রলীগ। কিন্তু বিধিবাম! ছাত্রলীগ কুলিয়ে উঠতে পারেনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। সকল শিক্ষার্থী এক হয়ে হলে হলে অভিযান চালায়। ছাত্রলীগের কোনো নেতাকে পেলেই ধাওয়া দেয়। কাউকে কাউকে প্রহার করে। ছাত্রলীগ সভাপতির রুমে তল্লাশি চালায়। করা হয় ভাঙচুর। সেই যে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ত্যাগ করে আজও ক্যাম্পাস ছাড়া। ফের কখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ প্রবেশ করতে পারবে আল্লাহ মালুম। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের সবক’টি সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়ে উঠে। যেন প্রতিটি ক্যাম্পাস আগুনের গোলা। রাস্তায় ছাত্র-জনতার মিছিল। এই মিছিলেই রংপুরে ঘটে এক ঘটনা। শিক্ষার্থী আবু সাঈদ দু’হাত মেলে ধরে পুলিশের দিকে। বলে গুলি করেন। আবু সাঈদ ভেবেছিলেন এই পুলিশই তো আমার আপনজন। আমার মতো কারও বাবা। কোনো বাবা কী তার পুত্রকে গুলি করতে পারে? আবু সাঈদের বিশ্বাস মুহূর্তেই ভেঙে যায়। যাকে বাবা বলে বিশ্বাস করেছিলেন সে যে সাঈদের আজরাইল সে কি জানতো। দু’হাত মেলে ধরা অবস্থায় প্রথম গুলি করে। তারপরও আবু সাঈদ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর আরও গুলি চালায়। এ দৃশ্য গোটা দেশকে নাড়িয়ে দেয়। উত্তাল হয়ে উঠে দেশ। শিক্ষার্থীদের পাশে নেমে আসে আমজনতা। মিছিলে মিছিলে উত্তাল সারা দেশ। সেই মিছিলে চলে পুলিশের গুলি। পুলিশের সঙ্গে মিশে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগও গুলি চালায়। মৃত্যুর সংখ্যা মিনিটে মিনিটে বাড়তে থাকে। আহত হন অসংখ্য ছাত্র- জনতা। ঢাকার এমন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে আহতদের ভর্তি করা হয়নি। এমন কোনো হাসপাতাল নেই যেখানে লাশ ছিল না। সারা দেশ অগ্নিকুণ্ডলীতে পরিণত হয়।

আচ্ছা, কোটা আন্দোলন থেকে সরকারের পদত্যাগ দাবির একদফাতে কেন গেলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা? কারণ একটাই গণহত্যা। নির্বিচারে পুলিশের গুলিতে চোখের সামনে শত শত সহযোদ্ধার মৃত্যু তাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। সরকারের সরাসরি নির্দেশে এমন গণহত্যা কেউ মেনে নিতে পারেনি। মানবজমিনে প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে- কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে। আন্দোলন দমাতে সরকারি কোনো কৌশলই যখন কাজে আসছে না। তখনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলীয় নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। ১৯শে জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নেতারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। বামঘেঁষা দু’জন নেতা বলেন, ছাত্রদের এই আন্দোলন মার্কিন ষড়যন্ত্র। এটাকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। দেশব্যাপী সেনা মোতায়েন ও  কারফিউ জারি করতে হবে। বাকিদের বেশির ভাগই রাজনৈতিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজতে পরামর্শ দেন। কেউ কেউ আলোচনার কথাও বলেন। শেখ হাসিনা হার্ডলাইনে যাওয়ার পক্ষেই মত দেন। দেশব্যাপী কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত দেন। যেখানেই মিছিল সেখানেই গুলি করার নির্দেশনাও আসে।

এ বৈঠকের পরই দেয়া হয় কারফিউ। মাঠে আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের গুলি চলতে থাকে অনবরত। লাশ পড়তে থাকে একের পর এক। এসব ঘটনায় হাসিনাবিরোধী হয়ে পড়ে গোটা দেশ। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ ষোল বছরের আওয়ামী লীগের অপশাসনে অতিষ্ঠ ছিল দেশের বেশির ভাগ মানুষ। সরকারের সুবিধাভোগী ছাড়া কেউই এই সরকারের পক্ষে ছিলেন না। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানদের নিয়ে আতঙ্কিত ছিল অভিভাবকরা। কখন পুলিশ এসে শিবির বলে ধরে নিয়ে যায়। এমন বহু ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ। আশপাশে এমন উদাহরণ ভূরিভূরি। কোনো রাজনৈতিক দল না করেও শিবির বানিয়ে নিয়ে গেছে পুলিশ। যারা মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে পেরেছে তাদের ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আর যারা দিতে পারেনি তাদের জেল খাটতে হয়েছে দিনের পর দিন। আর যারা সত্যিকারের শিবির করেছে তারা গত ষোল বছর একদিনের জন্যও ঘরে ঘুমাতে পারেনি। আর প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি’র এমন কোনো নেতা নেই যার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। শেখ হাসিনার আমলে নতুন কায়দায় মামলার রূপ দেখেছে দেশবাসী। যা হলো গায়েবি মামলা। কোনো ঘটনা ঘটেনি। বোমা বিস্ফোরণ হয়নি। অথচ এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে শত শত। আর আসামি হয়েছে বিএনপি’র লাখ লাখ নেতাকর্মী। এ ছাড়া গুমের সংস্কৃতিও ব্যাপক হারে চালু হয় শেখ হাসিনার আমলে। চৌধুরী আলম, ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পর বিষয়টি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জোরপূর্বক অপহরণ ও গুমের ঘটনা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। একের পর এক জুলুম জনগণের কাঁধে চাপিয়ে শেখ হাসিনা সুকৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষকে মুখোমুখি করে তুলেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কথা বলতেন আওয়ামী লীগের নেতার মতো। এরা যে সাধারণ মানুষের সেবক সেটি ওরা ভুলে গিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর খড়্‌গ চালিয়েছে। আর দুই হাতে টাকা কামিয়েছে। এরাই শেখ হাসিনাকে ডুবিয়েছে অনেকখানি। শেখ হাসিনার সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনে পৃথিবীর সকল স্বৈরাচারকে হার মানিয়েছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর কেউ নমরুদ, ফেরাউনের চেয়েও হাসিনা ভয়ঙ্কর এমনটা প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচিতও হয়েছে হাসিনার সরকার। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনীতিকরণ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ধ্বংস করে ফেলা হয় শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আইনের আওতায় কাজ না করে ক্ষমতাসীনদের আদেশ মেনে কাজ করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে নানা উপায়ে ফ্যাসিবাদী কায়দায় আওয়ামী সরকার দীর্ঘ ষোল বছর জনগণের অধিকার লঙ্ঘন করেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে পুরোদমে। আর দুর্নীতির মাত্রা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশছোঁয়া। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি ছিল না। এ ছাড়া শেখ হাসিনার আয়না ঘর দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় তোলে।

বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুম করে রাখা হতো এই আয়না  ঘরে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর আয়না ঘর থেকে বেশ ক’জন বেরিয়ে আসে। তাদের মুখের বর্ণনা ইতিমধ্যে দেশের মানুষ শুনেছেন। কি এক নির্মম বয়ান তাদের মুখে। শুনলে গা শিউরে উঠে। চোখের পানি গড়গড়িয়ে পড়ে যে কারও। এরমধ্যে একজন রয়েছেন জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের ছেলে। যিনি কিনা নিজেই সেনাবাহিনীর লোক ছিলেন। এ ছাড়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও ছিল আলোচনার বিষয়।  এ ধরনের গুমের ঘটনার  মাধ্যমে শুধুমাত্র বিরোধী পক্ষ এবং সমালোচকদের ভয় দেখিয়ে চুপ করতে বাধ্য করেছিল তা নয় বরং স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে সক্ষম সাধারণ নাগরিকদেরও কণ্ঠরোধ করেছিল। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অনেকেই এখনো নিখোঁজ।  নারায়ণগঞ্জে র‍্যাব-১১ কর্তৃক তুলে নিয়ে সেভেন মার্ডারের কথা দেশের মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি।

বল প্রয়োগের মাধ্যমে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল সরকারের অন্যতম কৌশল। এবং তা করে গেছে শেখ হাসিনার সরকার অবলীলায়। প্রকাশ্যে তা বলেছেনও। এ জন্য র‌্যাবকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়। কেউ কেউ এখন বলছেন শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে দোজখে পরিণত করেছিল। দেশে আইন ছিল, কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ না হয়ে অপপ্রয়োগ হয়েছে সর্বক্ষেত্রে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে নানা চাপে রাখা হয়েছে সাংবাদিকদের। কাউকে কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সংসদে মিডিয়ার মুখ বন্ধ করতে আইন পর্যন্ত করা হয়েছে। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন হাসতে হাসতে, খেলতে খেলতে করে ফেলেছেন। আবার বড় গলায় বলেছেন জনগণের ভোটে আমরা নির্বাচিত হয়েছি। অথচ নির্বাচনে ভোটের হার ছিল সর্বোচ্চ পাঁচ ভাগ। কোনো কোনো কেন্দ্রে সারাদিনেও কেউ ভোট দিতে যায়নি। গৃহপালিত নির্বাচন কমিশন অবশ্য সবসময় দেখিয়েছে ৩০ থেকে ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে। আসলে শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে বোকা ভেবেছিলেন। আর কথায় কথায় কান্না ছিল তার আরেক নাটক। ষোল বছরে কতো হাজার মায়ের কোল খালি করেছেন একমাত্র তিনিই জানেন। শেষ ভাষণে এসে তিনি এটা অজান্তে স্বীকারও করেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, স্বজন হারানোর ব্যথা কী এটা আমি বুঝি। তার ভাষণের পর আন্দোলনে থাকা এক মা কোনো টিভি পর্দায় বলছিলেন শেখ হাসিনা স্বজন হারানোর ব্যথা বুঝেন ঠিকই। কিন্তু সন্তান হারানোর ব্যথা বুঝেন না। কারণ তার তো কোনো সন্তানকে হারাতে হয়নি। হাসিনা মনে করতেন তিনি যে ‘কাউয়া চালাক’ এটা কেউ বুঝতে পারছে না। তিনি যা বলবেন সেটিই বেদবাক্য। অথচ তার কথা শুনে মানুষ হাসতেন। এভাবে কখন যে তিনি বিশ্বের স্বৈরাচারের তালিকায় এসে যান তিনি নিজেই জানেন না।  শেষ কথা হলো- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কাজ শেষ হয়ে যায়নি। দেশকে সংস্কার করেই তাদের ঘরে ফিরতে হবে। দেশের মানুষ এটাই চায়। সংস্কার হোক সর্বত্র। সব জায়গায়।

No comments

Powered by Blogger.