যেভাবে নিজের পতন ডেকে আনেন সুদান শাসক ওমর হাসান আল বশির

প্রায় ৩০ বছর ধরে সুদান শাসন করেছেন ওমর হাসান আল বশির। এই তিন দশকে বহু অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঠেকিয়ে টিকে ছিলেন তিনি। অবশেষে গত মাসেই তার পতন ঘটলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, আঞ্চলিক রাজনীতি বুঝতে না পারা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্ররাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েই নিজের পতন ডেকে এনেছেন বশির। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক বিশেষ প্রতিবেদনে প্রায় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ঠিক কীভাবে তার এই দীর্ঘ শাসনের ইতি ঘটলো। মানবজমিন-এর পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।
১০ই এপ্রিল রাতে সুদানের গোয়েন্দা প্রধান সালাহ গোশ প্রেসিডেন্ট ওমর হাসান আল বশিরের সঙ্গে তার প্রাসাদে গিয়ে দেখা করেন। ওই বৈঠকে গোশ প্রেসিডেন্টকে আশ্বস্ত করেন যে, চলমান গণবিক্ষোভ তার শাসনের প্রতি কোনো হুমকিই নয়।
অথচ, ৪ মাস ধরে রাজপথে বশিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে হাজার হাজার সুদানি। তারা গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক দুর্দশা অবসানের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। আন্দোলনকারীরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরেও তাঁবু স্থাপন করেছিলেন।
গোশ ও বশিরের মধ্যে ওই বৈঠকে উপস্থিত এক কর্মকর্তা সহ মোট চারটি সূত্র জানান, গোশ তখন বলেছিলেন যে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে প্রতিবাদকারীদের জটলা নিয়ন্ত্রণে আনা হবে অথবা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
গোশের কথায় আশ্বস্ত হয়ে শান্তিতে ঘুমাতে যান বশির। ৪ ঘণ্টা পর ঘুম থেকে জেগে উঠে বশির বুঝে যান যে, সালাহ গোশ তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। প্রাসাদ রক্ষীরা সব চলে গেছেন। তাদের স্থলে প্রাসাদে অবস্থান নিয়েছে নিয়মিত সৈন্যরা। বশিরের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে, তার ৩০ বছরের শাসনের ইতি ঘটেছে।
এই চূড়ান্ত সময়ে বশিরের সঙ্গে অল্প যে কয়েকজন ব্যক্তি কথা বলেছেন, তাদের একজন জানান, এই অবস্থা দেখে প্রেসিডেন্ট নামাজ পড়তে চলে যান। তার ভাষ্য, ‘নামাজ পড়া পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে সেনা কর্মকর্তারা।’ কর্মকর্তারা বশিরকে জানান যে, সুদানের হাই সিকিউরিটি কমিটি (যার সদস্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং সেনা, গোয়েন্দা ও পুলিশ প্রধান) তাকে ক্ষমতাচ্যুত করছে। কমিটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, দেশের নিয়ন্ত্রণ আর তার হাতে নেই।
প্রাসাদ থেকে বশিরকে রাজধানী খার্তুমের কোবার কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ঠিক এই কারাগারেই তিনি নিজের হাজার হাজার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পুরেছিলেন। তিনি এখনও ওই কারাগারেই রয়েছেন। ৩০ বছর ধরে যে বশির শক্ত হাতে বহু বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান চেষ্টা ঠেকিয়েছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েছেন, গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের নিষেধাজ্ঞাকে কাঁচকলা দেখিয়েছেন, সেই বশিরের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থান যেন অত্যন্ত নিখুঁত ও মসৃণ ছিল। সবকিছু ঘটে যাওয়ার আগে বশির টেরই পাননি।
একজন সাবেক মন্ত্রী, বশিরের অন্দরমহলের একজন সদস্য ও অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় সরাসরি জড়িত একজন ব্যক্তি সহ মোট ৩টি সূত্র বশিরের পতনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে: বশির হয়তো সুদানের অভ্যন্তরীণ ইসলামিস্ট প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী ও সামরিক অংশগুলোকে নিয়ন্ত্রণে ভীষণ দক্ষ ছিলেন, কিন্তু পরিবর্তনশীল মধ্যপ্রাচ্যে তিনি একাকী হয়ে গিয়েছিলেন। তারা বর্ণনা করেন কীভাবে বশির সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে নিজের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছেন। অথচ, ইতিপূর্বে আরব আমিরাতই সুদানের রাজকোষে কয়েক বিলিয়ন ডলার ঢেলেছিল। বশির অবশ্য ইয়েমেনে আমিরাতের স্বার্থ ঠিকঠাক মতোই রক্ষা করেছিলেন (ইয়েমেনে ইরানের বিরুদ্ধে প্রক্সি লড়াই চলছে আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের)। কিন্তু ২০১৮ সালের শেষ নাগাদ যখন দেশের অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয় আকার ধারণ করে, পাশাপাশি রাজপথ দখলে নেয় বিক্ষোভকারীরা, বশির দেখতে পেলেন তার পাশে আর নেই ক্ষমতাধর, সম্পদশালী মিত্র আমিরাত।
সূত্রগুলো আরও জানায়, সামরিক জেনারেলরা বশিরের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগেই জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সালাহ গোশ কারাবন্দি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের সমর্থন চান। অভ্যুত্থানের কয়েকদিন আগে, গোশ অন্তত একবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে আগেভাগেই জানিয়ে দেন কী ঘটতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সরকার কোনো প্রশ্নের জবাব না দিলেও, জুনে আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ টুইটারে বশিরের পতনের পর লিখেছিলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সুদানের সকল বিরোধী পক্ষ ও সামরিক পরিষদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। গারগাশ আরও বলেন, বশিরের দীর্ঘ একনায়কতন্ত্র ও মুসলিম ব্রাদারহুডের পর এখন সংবেদনশীল সময় চলছে সুদানে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, মুসলিম ব্রাদারহুড বশিরের মিত্র ছিল।
অথচ, ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতেও বশির ও আরব আমিরাতের সম্পর্ক অনেক উষ্ণ ছিল। সেবার বশির আমিরাতে গিয়ে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে আবুধাবিতে সাক্ষাত করেন। অপরদিকে ইয়েমেনে সৌদি-আমিরাত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে অংশ নেয় ১৪ হাজার সুদানি সেনা।
তবে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ (সংক্ষেপে যাকে এমবিজেড ডাকা হয়) অন্য আরেক ক্ষেত্রেও বশিরের সহযোগিতা চাইছিলেন। আর তা ছিল, ইসলামিস্ট বা ব্রাদারহুডকে দমন করতে হবে। সুদানি সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এ কথা জানান।
রাজনৈতিক ইসলাম, অর্থাৎ ব্রাদারহুডকে ঠেকাতে আঞ্চলিক তৎপরতার নেতৃত্বে ছিল আমিরাত। সৌদি ও আমিরাত মনে করে, তাদের রাজতন্ত্রী শাসন ও এই অঞ্চলের নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি হুমকি ব্রাদারহুড। ২০১১ সাল থেকে এই উদ্বেগ আরও তীব্র হয় সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের। কারণ সেই বছরই পুরো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দিয়ে বয়ে যায় আরব বসন্ত, যার সবচেয়ে বেশি লাভ ঘরে তোলে মুসলিম ব্রাদারহুড। সৌদি ও আমিরাত ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ব্রাদারহুডের দাবি তারা শান্তিপূর্ণ।
২০১২ সালে মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। মাত্র ১ বছর পরই তাকে উৎখাত করে সেনাবাহিনী। পরবর্তী ১৮ মাসে সেনা শাসনাধীন মিশরকে সাহায্য হিসেবে ২৩০০ কোটি ডলার পাঠায় সৌদি আরব, আমিরাত ও কুয়েত। সুদানে ইসলামিস্টদের প্রভাব মিশরের চেয়েও বেশি। বশির নিজেও একটি ইসলামিস্ট জান্তার প্রধান হিসেবে ১৯৮৯ সালে ক্ষমতা দখল করেন। দেশটির সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী ও প্রধান মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণেও ইসলামিস্টরা। ওই বৈঠকে বশির ও এমবিজেড ঐক্যমত্যে পৌঁছেন যে, বশির ইসলামিস্টদের উৎখাত করবেন, বিনিময়ে সুদানকে আর্থিক সহায়তা দেবে আমিরাত। কিন্তু বশির বলেননি কীভাবে তিনি ইসলামিস্টদের দমন করবেন।
আবুধাবির সেই আলোচনার পর সুদানে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাঠায় আরব আমিরাত। ২০১৮ সালের মার্চে আমিরাতি সরকারী বার্তা সংস্থা জানায়, সুদানের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সহায়তার অংশ হিসেবে এবং বেসরকারী ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের অংশ হিসেবে ৭৬০০ কোটি ডলার দিয়েছে আমিরাত।
বশিরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীদের একজন ছিলেন তার কার্যালয়ের পরিচালক তাহা ওসমান আল হোসেন। তাকেই ইউএই’র সঙ্গে সম্পর্ক দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাহা ওসমান হোসেন একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সহকর্মীরা জানান, তিনি ভীষণ উচ্চাবিলাশী ও দক্ষ একজন কর্মকর্তা। তার প্রভাব এত বেশি ছিল যে খোদ মন্ত্রীরাও তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেন। হোসেনকে এড়িয়ে বশিরের সঙ্গে মন্ত্রীরাও দেখা করতে পারতেন না। তাদের অভিযোগ ছিল, হোসেন নিজেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। একবার তিনি সরাসরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা ও সৌদি আরবের একটি সংবাদ সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেন।
বশিরের জাতীয় কংগ্রেস পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা গামার হাবানি বলেন, ‘বশিরের মনের ওপর জাদুকরি প্রভাব ছিল হোসেনের।’ তবে তার প্রতিপক্ষ ছিলেন তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান ও নেতৃত্বস্থানীয় রাজনীতিকরা। তারা প্রকাশ্যে তার বিরুদ্ধে সৌদি আরবের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ তোলেন। গোয়েন্দা সংস্থা অভিযোগ করে, দুবাইয়ে হোসেনের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১০৯ মিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে সৌদি আরব ও ইউএই। হোসেন অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
কিন্তু ২০১৭ সালের জুলাইয়ে জানাজানি হয়ে যায় যে, হোসেন সৌদি আরবের নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন। তখন তাকে বহিষ্কার করেন বশির। এরপর হোসেন রিয়াদে চলে যান ও সেখান থেকেই সৌদি আরব ও আরব আমিরাত সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ শুরু করেন।
হাবানি বলেন, ‘তাহা হোসেনের ঘটনা বশিরের মনে বিরাট দাগ কেটে যায়।’ আবার তাকে বহিষ্কারের বিষয়টি সংযুক্ত আরব আমিরাতের জন্য বড় ধাক্কা ছিল।
দুই বছর আগে হঠাৎ করে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও সৌদি আরব সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে প্রতিবেশী দেশ কাতারের সঙ্গে। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি কাতারের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে ক্ষুব্ধ ছিল আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। এই পরিস্থিতিতে বেশ জটিল অবস্থায় পড়ে যান সুদানের প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির। সুদানের অর্থনীতি বাঁচাতে ইউএই’র মতো কাতারও কয়েক বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। বশিরের ইসলামবাদী ঘরোয়া রাজনৈতিক মিত্ররা তাকে চাপ দেন, কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করা যাবে না। সুতরাং, এই সংকটে কোনো পক্ষে যেন বশির না যান। সাবেক উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তার মতে, এই মিত্রদের বার্তা ছিল স্পষ্ট।
কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে।
পরের বছর ২০১৮ সালের মার্চে লোহিত সাগরবর্তী সুয়াকিন বন্দর উন্নয়নে কাতারের সঙ্গে ৪০০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে সুদান। তার আগে অবশ্য বশির সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ইউএই ও সৌদি আরবের পক্ষে তিনি যাবেন না। অবশ্য তাদের বিরুদ্ধেও তিনি যাননি। কিন্তু ইউএই’র প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদকে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, ইসলামপন্থীদের দমন করবেন, সেখান থেকেও তিনি সরে আসেন। জ্যেষ্ঠ ঐ সরকারী কর্মকর্তার মতে, দেশের শক্তিধর ইসলামপন্থী ব্যক্তিত্বদের শত্রু বানাতে ভয় কাজ করছিল বশিরের মনে। এই ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন আলি ওসমান তাহা, যিনি সাবেক প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তার উত্তরসূরি বাকরি হাসান সালেহ। এই দু’জনই বশিরকে ক্ষমতায় আনা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন।
২০১৮ সালের অক্টোবর নাগাদ, সুদান ফের অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হয়। দেশে খাদ্য, জ্বালানি ও মুদ্রা সংকট দেখা দেয়। বশিরের নিজ দল ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির বৈঠকে, দলের জ্যেষ্ঠ সদস্য গামার হাবানি তাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন ইউএই ও সৌদি আরব আর সাহায্য করছে না সুদানকে। বশির জবাবে বলেন, ‘আমাদের ভাইয়েরা চায়, আমি তোমাদের অর্থাৎ ইসলামিস্টদের ত্যাগ করি।’ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের দিকে, ইউএই সুদানে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বশির দেশে ইসলামিস্টদের প্রভাব ক্ষুণœ না করায় স্পষ্টতই ক্ষুব্ধ ছিল ইউএই। হাবানি বলেন, ‘যেহেতু বশির ইসলামিস্টদের পরিত্যাগ করতে ও কাতারের বিরুদ্ধে যেতে রাজি হননি, সেহেতু সৌদি আরব ও আমিরাত আর আর্থিক সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সুদান কোনো পক্ষ নেবে না, সেটাই তারা মানতে রাজি নয়।’
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বশির দৃশ্যত নিজের ভাগ্য নিজেই নির্ধারণ করে ফেলেন। তখন দেশে ইতিমধ্যেই খাবারের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ওই সময় শীর্ষ নেতাদের নিয়ে গঠিত সূরা কাউন্সিলের এক বৈঠকে বশির বলে ওঠেন, ‘আমরা সবাই ইসলামিস্ট! ইসলামিস্ট হতে পেরে আমরা গর্বিত।’ জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তার মতে, এই কথা বলার পর আর পেছন ফেরার কোনো উপায় ছিল না। এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে বশির ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না।
ততদিনে অর্থের জন্য হন্যে হয়ে ওঠেন বশির। তিনি চলে যান কাতারে। সাক্ষাত করেন আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সঙ্গে। বশিরের ঘনিষ্ঠরা বলেন, ওই বৈঠকের আগে কাতারি আমির তাকে এক বিলিয়ন ডলার দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু সফর শেষে খালি হাতেই ফিরতে হয় তাকে। কেননা, আমির ওই বৈঠকে তাকে জানান ‘কিছু পক্ষে’র চাপে তিনি পূর্বের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু আমির জানাননি কারা তাকে চাপ দিচ্ছিল। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, সুদানের প্রতি কাতারের সমর্থন দেশের জনগণের সমৃদ্ধি ও মঙ্গলের জন্য। এটি কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। ওই কর্মকর্তা বলেন, সুদানের প্রতি সাহায্য বন্ধে তৃতীয় কেউ কাতারকে চাপ দেয়নি। বরং, সুদানে কাতারের অর্থায়নে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে।
এদিকে পর্দার আড়ালে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনায়ও গতি পেতে শুরু করেছে। খার্তুমের কোবার কারাগারে (যেখানে এখন বশিরকে আটক রাখা হয়েছে) বন্দী থাকা এক বিরোধী নেতা বর্ণনা দেন কীভাবে গোয়েন্দা প্রধান গোশ অপ্রত্যাশিতভাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারির দিকে তার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। শুধু তিনি নন, কারাগারে বন্দী মোট ৮ জন বিরোধী নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেন গোশ।
গোশ তাদের বলেন, তিনি আবুধাবি গিয়েছিলেন। ইউএই তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জ্বালানি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া হবে। তিনি সুদানের নতুন একটি রাজনৈতিক কাঠামো সৃষ্টির জন্য বিরোধী নেতৃবৃন্দের সহায়তা চান। গোশের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এক সূত্র এই ঘটনা নিশ্চিত করেছে।
গোশ ১০ দিন পর আবারও কারাগারে যান। এবার তিনি ২৬টি কক্ষে যান। ওই বিরোধী নেতা বলেন, ‘ওই বৈঠকের পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়। আমাদেরকে বিনামূল্যে সিগারেট দেওয়া হয়। কক্ষে টিবি দেওয়া হয়। তামাক দেওয়া হয়। আমরা খুব বিস্মিত হয়ে যাই এই ভেবে যে গোয়েন্দা প্রধান বিরোধী নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাত করছেন! কিন্তু যখন অভ্যুত্থান ঘটে, আমি বুঝে যাই কেন তিনি তা করেছিলেন।’
খার্তুমে কর্মরত একজন জ্যেষ্ঠ পশ্চিমা কূটনীতিক, বশিরের ও গোশের ঘনিষ্ঠ দুই ব্যক্তি জানান, মধ্য ফেব্রুয়ারিতে বশিরের জন্য মর্যাদাবান প্রস্থানের প্রস্তাব দেয় ইউএই ও গোশ। ওই পরিকল্পনা মোতাবেক, দেশে নির্বাচন হবে এবং অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বশিরই থাকবেন।
২২শে ফেব্রুয়ারি গোশ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, বশির নিজ দল ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতার পদ থেকে সরে যাবেন এবং ২০২০ সালের নির্বাচনে লড়বেন না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর এক টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বশির পদত্যাগের ব্যাপারে কোনো শব্দই উচ্চারণ করেননি। তিনি পরে দলীয় কর্মীদের বলেন, গোশ বিষয়টি বাড়িয়ে বলেছে। এরপর বশিরের বিরুদ্ধে কার্যক্রমে আরও গতি পায়।
সুদানের বিরোধী দলগুলো ও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইউএই। তখন ‘বশির-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি’ নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে আমিরাত। এ কথা জানান এক বিদ্রোহী নেতা ও উভয় পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী এক ব্যক্তি।
৬ই এপ্রিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পাশে প্রতিবাদের তাঁবু স্থাপন করে প্রতিবাদকারীরা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বশিরের বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু সেদিন বশিরের জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থা ওই বিক্ষোভকারীদের থামানোর কোনো চেষ্টাই করেনি। হাবানি বলেন, ‘তখনই আমরা বুঝতে পারি সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে নিতে যাচ্ছে।’ গোশ এই ফাঁকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, সেনা প্রধান ও পুলিশ প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা একমত হন যে, বশিরের শাসনের ইতি ঘটানোর সময় এসেছে। গোশের ঘনিষ্ঠ সূত্রটি জানায়, এদের প্রত্যেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ‘বশিরের দিন শেষ হয়ে এসেছে!’ বর্তমানে ক্ষমতাসীন ট্রাঞ্জিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের এক মুখপাত্র নিশ্চিত করেন যে, গোশ এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন।
এই পুরো পরিকল্পনায় সবার শেষে যোগ দেন মিলিশিয়া নেতা জেনারেল মোহাম্মেদ হামদান দাগালো। তিনি বশিরের দীর্ঘদিনের মিত্র। দাগালোকে বেশিরভাগ মানুষ হেমেদি হিসেবে চেনে। তিনি সুদানের আতঙ্ক জাগানিয়া বাহিনী র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর প্রধান। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই প্যারামিলিটারি বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হাজার হাজার। এই বাহিনীর হাতেই খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ। দাগালোও পরিকল্পনায় অংশ নিলে, আর কিছুই বাকি রইলো না বশিরের পক্ষে। ১১ই এপ্রিল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কয়েকদিন পর ইউএই ও সৌদি আরবের সঙ্গে বশিরের সম্পর্ক রক্ষার দায়িত্বে থাকা হোসেন ফিরে আসান সুদানে। তিনি সেখানে সৌদি ও ইউএই প্রতিনিধিদলের অংশ ছিলেন। এই প্রতিনিধি দল সুদানের নতুন সামরিক শাসকদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ২১শে এপ্রিল ইউএই ও সৌদি আরব জানায়, সুদানের জন্য ৩০০ কোটি ডলারের সাহায্য পাঠাবে তারা। জেনারেল হেমেদি পরবর্তীতে ঘোষণা দেন, সুদানের বাহিনী ইয়েমেনে থাকবে।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে বিরোধী ও বিদ্রোহী বিভিন্ন গোষ্ঠী আবুধাবিতে আমিরাতি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাত করছিল। দারফুরের জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্ট নামে একটি বিদ্রোহী দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আহমেদ তুগোদও সেই বৈঠকে ছিলেন। তিনি জানান, ওই বৈঠকে দেশে ঐক্যমত্য ও স্থিতিশীলতা নিয়ে তাদের মতামত জানতে চায় ইউএই। তুগোদ বলেন, আমরা শান্তি প্রক্রিয়া ও যুদ্ধক্ষেত্রের সংঘাত সমাধানের ওপর জোর দিয়েছি।
বৃটিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার সিটির মালিক ও আমিরাতি রাজপরিবারের সদস্য শেখ মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ান মূলত বিদ্রোহী ও আমিরাতের মধ্যকার যোগাযোগের বিষয়টি দেখভাল করেন। এ কথা জানান তুগোদ ও একজন মধ্যস্থতাকারী। এদিকে খার্তুমে আলোচনার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পাঠাতে চেয়েছিল কাতার। কিন্তু কাতারের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
বশিরের পতনের পর তার পুরোনো মিত্র জেনারেল হেমেদি এখন সুদানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি ক্ষমতাসীন ট্রাঞ্জিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের প্রধান। সাবেক এই পশু ব্যবসায়ী ২০০৩ সালের দারফুর যুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস মিলিশিয়া কমান্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি অর্জন করেন। তার মিলিশিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া, বেসামরিক মানুষকে হত্যা ও ধর্ষণের মতো নৃশংসতা সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তবে বশির সরকারের মতো হেমেদি এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এদিকে ১৩ই এপ্রিল ট্রাঞ্জিশনাল মিলিটারি কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন গোশ। এই গোয়েন্দা প্রধানকে প্রতিবাদকারীরা রীতিমতো ঘৃণা করে। তাদের চাপেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। গোশ এখন কোথায় তা জানা যায়নি। তবে খার্তুমে তার বাসভবনের পাশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি দেখা গেছে।
এদিকে ৩রা জুন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে প্রতিবাদকারীদের অবস্থান গুঁড়িয়ে দেয় হেমেদির বাহিনী। প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলিও ছুড়ে তারা। বিরোধী দলের ডাক্তাররা বলছেন, ১০০ জনেরও অধিক নিহত হয়েছেন। সুদানি কর্তৃপক্ষ বলছে, ৬২ জন নিহত হয়েছেন। এরপর সৈন্যরা সেখান থেকে বিভিন্ন প্ল্যকার্ড ও ব্যানার সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এসব প্ল্যাকার্ডে বিভিন্ন স্লোগান লেখা ছিল। কিছু স্লোগানে লেখা ছিল, ‘আমরা মিশরের মতো হতে চাই না।’, ‘আরব আমিরাত ও সৌদি আরব, সুদানে হস্তক্ষেপ করা বন্ধ কর।’
(রয়টার্স অবলম্বনে।)

No comments

Powered by Blogger.