অবরুদ্ধ কাশ্মীরে তরুণদের দুর্বিষহ জীবন: -দ্য টাইমসের অনুসন্ধান

কাশ্মীরের দক্ষিণাঞ্চলে যখন গাছে গাছে লাল আপেল ধরেছে তখন সেখানকার তরুণরা নিজেদের বাঁচাতে লুকিয়ে  থাকছে এসব আপেল বাগানে। কাশ্মীরিদের স্বশাসনের অধিকার কেড়ে নেয়ার পর থেকেই তাদের ওপর নেমে এসেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তীব্র নির্যাতন। গত একমাস যাবৎ কাশ্মীরে বাছবিচারহীনভাবে গ্রেপ্তার চালিয়ে আসছে দেশটির সেনারা। এ ক্ষেত্রে সবার আগে টার্গেটে পরিণত হয়েছে উপত্যকার তরুণরা। সমপ্রতি লণ্ডনভিত্তিক দ্য টাইমসের এক অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসবের সত্যতাও।
কাশ্মীরি এক তরুণের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যমটি জানতে পেরেছে ভারতীয় সেনারা একদিন আগেই তার এলাকা থেকে ৯ তরুণকে ধরে নিয়ে গেছে। এ সময় তাদেরকে জড়ো করে প্রচণ্ড মারধর করে ভারতীয় পুলিশ ও সেনা সদস্যরা। ওই তরুণ নিজের নাম প্রকাশ করতে চায়নি।
ইরফান আহমেদ নামের আরেক যুবক জানায়, আমি যখন দেখি সেনারা এসে আমার ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে তখন আমি ছাদ থেকে লাফিয়ে কোনোমতে বেঁচে যাই। তবে আমার ভয় হচ্ছে, ভারতীয় সেনারা আবার আসবে আমাকে খুঁজতে।
এক মাসেরও বেশি সময় ধরে কাশ্মীরের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে দিল্লি। এই অঞ্চলটি কয়েক দশক ধরেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যেকার উত্তেজনার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দিল্লির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে প্রায় সমগ্র কাশ্মীরই কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে আছে। ভারত সরকার সেখানে ইন্টারনেট ও টেলিফোনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরিসেবাগুলো বন্ধ রেখেছে। সন্ত্রাসবাদের দোহাই দিয়ে পুরো একটি অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে।
সংবাদমাধ্যমের হিসাব অনুযায়ী কাশ্মীরে গত একমাসে দুই হাজারেরও অধিক মানুষকে আটক করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর ওপর পাথর ছোঁড়ার মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও চলছে দমনপীড়ন। কমপক্ষে ২ জন নিহত হয়েছে ভারতীয় বাহিনীর হামলায়। আটকদের কাশ্মীর ও কাশ্মীরের বাইরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। অনেক পরিবারই আছে যাদের তরুণ সদস্যরা নিখোঁজ রয়েছে।
অনেক কাশ্মীরিই দ্য টাইমসকে জানিয়েছে, তারা এখন সামরিক বাহিনীর আতঙ্কের মধ্যে বাস করছেন। তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি যা করছেন তা এই অঞ্চলে আগুন লাগানো ছাড়া কিছুই না। অনেকেই বলছেন ৯০ এর দশকে যেরকম উত্তপ্ত ছিল কাশ্মীর সে অবস্থায় আবারো ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। দ্য টাইমস কাশ্মীরের অন্তত ৬টি গ্রামে গিয়েছে সেখানকার অবস্থা জানতে। প্রতিটি গ্রামেই তরুণ কাউকে না কাউকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভয়ে সেখানকার তরুণরা পালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আশঙ্কা, রাস্তায় বেরুলেই ধরে নিয়ে যাবে ভারতীয় সেনারা।
সেখানকার একটি গ্রামের এক নারী জানান, আমি জানি না আমার ছেলে এখন কোথায় আছে। গত সোমবার তাকে বাসার কাছ থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এর তিন বছর আগে পুলিশের ছোড়া পেলেটের আঘাতে ওই তরুণ তার এক চোখ হারিয়েছিল। দ্য টাইমস জানিয়েছে, কাশ্মীরে এমন শত শত মানুষ আছে যারা সরকারি বাহিনীর হাতে অন্ধত্ব বরণ করেছেন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গত এক মাসে নির্যাতনের অভিযোগ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যদিও দেশটি এ ধরনের সকল দাবি উড়িয়ে দিচ্ছে। শোপিয়ান জেলায় পরিচিত এক সন্ত্রাসীর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছে দ্য টাইমসের প্রতিনিধি। পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ভারতীয় বাহিনী গত ৭ই আগস্ট তার আরেক ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে এবং তার ওপর অমানবিক নির্যাতন করেছে। এ নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের কাছে মুখ খুললে ভয়াবহ পরিণতির হুমকিও দেয়া হচ্ছে পরিবারটিকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পরিবারের এক সদস্য বলেন, শুধুমাত্র একজন সন্ত্রাসবাদে জড়িয়ে পড়ার জন্য তার ভাইকে ধরে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে প্রথমে ঝুলিয়ে পেটানো হয়েছে। তারপর বাধ্য করা হয়েছে পেট্রল খেতে। তার এক কাজিন বলেন, আমার ভাইয়েরা কেন সন্ত্রাসবাদে জড়াবে না? ভারতীয় বাহিনী তাদের ওপর যে জুলুম করছে তাদের কেউই আর কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না।

No comments

Powered by Blogger.