ওয়েডিং শেমিং: অনলাইনে অন্যদের বিয়ে নিয়ে হাসি মশকরা করার বিষাক্ত জগত

আপনি হয়তো সদ্য বিয়ে করেছেন। এখনো নানা শুভেচ্ছা কার্ড আসছে, নানা জায়গায় দাওয়াত পাচ্ছেন, নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বিয়ের নানা ঢঙের ছবি আপলোড করছেন, তাতে লাইক কমেন্টে ভরে যাচ্ছে।
আবার উল্টো চিত্রটা একবার কল্পনা করুন। কেউ একজন হয়তো আপনার বিয়ের পোশাক বা খাবারের তালিকার ছবি সামাজিক মাধ্যমে তুলে দিয়ে তার সঙ্গে ব্যঙ্গাত্মক একটি মন্তব্য জুড়ে দিল।
এরপর সেখানে আরো অনেকে আপনার আনন্দের দিনটাকে নিয়ে নানা হাস্যরসাত্মক, বিদ্রূপ করে মন্তব্য করতে শুরু করলো, সঙ্গে এলওএল চিহ্ন দিয়ে।
এভাবে অনলাইনে ওয়েডিংশেমিং বা বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে লজ্জা দেয়া হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনেকে। সারা পৃথিবীতে এ ধরণের গ্রুপের সংখ্যা বাড়ছে, যেখানে লোকজন এসে অন্যদের বিয়ে নিয়ে মজা করে।
বর্তমানে কানাডায় ফেসবুকের এরকম একটি গ্রুপে এক লাখ ২০ হাজার সদস্য রয়েছে। ফেসবুকে এরকম অন্তত ২০টি গ্রুপ আছে, যাদের সদস্য সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ৬২ হাজার পর্যন্ত।
যদিও এসব গ্রুপ 'প্রাইভেট', কিন্তু যে কেউ চাইলেই সেখানে যোগ দিতে পারে। শুধুমাত্র কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় এবং কয়েকটি ছবি শেয়ার করতে হয়, যার মধ্যে থাকতে হবে আপনার দেখা সবচেয়ে হাস্যকর বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবি।
যদিও এসব গ্রুপে বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ পরিচয় ইত্যাদি নিয়ে কোন বিভেদ না করার নীতিমালা আছে, কিন্তু গ্রুপের পোস্ট, ছবি বা মন্তব্যে সেটা আসলে কেউই খুব একটা অনুসরণ করে না।
সবচেয়ে বড় গ্রুপে ঢুকে দেখা গেলো, সেখানে বিয়ের নানা অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে, নানা জিনিসপত্রের ছবি রয়েছে। সেখানে অনেকেই মন্তব্য করেছেন, ''এটা কেমন জামাকাপড় হলো, খুব বাজে লাগছে,'''সে আরো ভালো জামাই পেতে পারতো,'' এই লোকটা কি ওয়াকিং ডেডের কাছ থেকে কাপড়চোপড় ধার করেছে'' ইত্যাদি।
কিন্তু সব মন্তব্য বা ছবিই বিষাক্ত নয়। যেমন সবচেয়ে লাইক পাওয়া ছবির মধ্যে রয়েছে বিয়ে বাড়িতে একটি শিশুর ছবি, যে নিমন্ত্রণ ছাড়াই বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে এবং সব ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
বান্ধবীর সঙ্গে মিলে ফেসবুকে এরকম বড় একটি গ্রুপ পরিচালনা করেন বাইশ বছরের অ্যান্টন। তিনি মনে করেন না এর ফলে মানুষের বিষাক্ত আচরণ বেড়ে যাচ্ছে।
'' আমরা একবছরের কম সময়ের মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার সদস্য পেয়েছি এবং প্রতিমাসে প্রায় দুই মিলিয়ন যোগাযোগ হচ্ছে। ইন্টারনেটের আর সব জায়গার মতো এখানেও ভালো, খারাপ আছে।''
'ওয়েডিং শেমিং' টার্মটি কখনো কখনো ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে বলে তিনি মনে করেন।
''অনেক মানুষ এই গ্রুপে এসে তাদের সৎ মতামত দিতে চায়। অনেক মানুষকে তারা সেরা বন্ধুর মতো মনে করে, অনেকে গল্প করে, অনেকে মজা করে। আপনি যদি অতীতের মন্তব্যগুলো ভালো করে দেখেন, তাহলে দেখবেন, তারা আসলে সৎ লোক,'' বলছেন অ্যান্টন।
''যদি সত্যিকারের খারাপ কোন মন্তব্য দেখা যায়, তাহলে আমরা ওই সদস্যকে স্থগিত বা সতর্ক হওয়ার জন্য বলি।'''
২০১৮ সালের অগাস্ট থেকে প্রথম অনলাইনে ওয়েডিং শেমিং বা বিয়ের বিষয় নিয়ে হাসি মশকরা করার চলটি শুরু হয়। তখন একটি গ্রুপের একটি পোস্টে একজন কনেকে নিয়ে লেখা হয় যে, সে বিয়ের সময় অতিথিদের কাছে বিয়ের জন্য ১৫০০ ডলার চেয়েছে।
মডেল ও সামাজিক মাধ্যমের তারকা ক্রিসি টেইজিন ওই গল্পটি শেয়ার করার পর সেটি ভাইরাল হয়ে যায়।
ওই গ্রুপের একজন মডারেটর মনে করেন, তারা বন্ধুত্বপূর্ণ একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন , যেখানে যেকেউ এসে তাদের হতাশার কথা জানাতে পারে।
''আমি এটাকে গুরুত্ব দেই না যে, অন্য কেউ আমাদের গ্রুপ নিয়ে কি ভাবছে। এটা এমন একটা জায়গা যেখানে মানুষজন এসে তাদের খারাপ বিয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে।''
এরপর থেকে এ ধরণের ফেসবুক গ্রুপ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
গ্রুপের একজন সদস্য ওরলা বলছেন, এটা শুধুমাত্র মজার করার জন্যই তিনি করেছেন।
''আমি পাগলাটে সব জিনিস আর কি সব মজার বিয়ের ঘটনা মানুষ ঘটাতে পারে, সেটা দেখতে পছন্দ করি।''
তবে ক্যাথরিন নামের আরেকজন সদস্য বলছেন, ''পুরো ধারণাটি আসলে খানিকটা লজ্জাজনক তো অবশ্যই- এটা নেতিবাচক ধারণার ওপরে তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমি এখানে বিনোদনের বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে চাই। অন্তত আপনি বুঝতে পারবেন যে, বিয়ের অনুষ্ঠানে কোন কাজটি করা উচিত নয়।''
মানুষজন তাদের নিজেদের বিয়ে নিয়ে যতটা গোপনেই পরিকল্পনা করুক না কেন, এখন একটা বার্তা পরিষ্কার হয়ে গেছে- ইন্টারনেটের এমন একটি জায়গা তৈরি হয়েছে, যেখানে একদল মানুষ এ নিয়ে মশকরা করার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে। যারা অন্যদের বিশেষ এই দিনটিকে নিয়ে হাসিতামাশা করছে, যার অনেকগুলো অনেক সময় ট্যাবলয়েড ম্যাগাজিনগুলোয় ওয়েবসাইটে ছাপাও হচ্ছে।
অনলাইনে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য নিয়ে গবেষণা করেছেন মনোবিজ্ঞানী এমা কেনি। তিনি বলছেন, ''এই লোকদের অনেকের মধ্যে 'অন্ধকার ধরণের ব্যক্তিত্ব' আছে, যেখানে তাদের মধ্যে আত্মপ্রেম, অন্যদের নিজের পছন্দমতো বিচার করা এবং মানসিক বিকারের বিষয় রয়েছে।''
''সাধারণত যদি আমরা নোংরা কোন কাজ করি, তাহলে আমাদের নিজেকে নিয়ে খারাপ লাগে, অপরাধবোধ হয়। কিন্তু এই ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরা কোন নেতিবাচক ধারণা বোধ করে না, সুতরাং তারা অন্যদের নিয়ে যতটাসম্ভব বিদ্রূপাত্মক মশকরা করার চেষ্টা করে।''
এমা বলছেন, ''এই ব্যক্তিরা মনে করেন, যদি অন্য কেউ তাদের চেয়ে ভালো কিছু করে, আসলে সেটা করা তাদের উচিত হয়নি। এ ধরণের গ্রুপে এই ধরণের মানুষরা তাদের মতো অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং সবাই মিলে নিচু কর্মকাণ্ডের পরিবেশ খুঁজে পায়।''
এ ধরণের গ্রুপ থেকে সবাইকে দূরে থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিজ্ঞানী এমা। '' যতই মানুষ এটা করবে, ততই সে অন্যদের জন্য খারাপ লাগার কারণ হতে থাকবে। একসময় মানুষজন হয়তো দানব হয়ে যেতে পারে এবং এই বিষাক্ততা তাদের বাস্তব জীবনেও ছড়িয়ে যেতে পারে। মানুষের এ ধরণের 'ওয়েডিং শেমিংয়ে' জড়িত হওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিত, কারণ এটি তাকে একজন খারাপ মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারে।''
হয়তো অন্য কারো বিয়ে নিয়ে কারো মতামত থাকতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে একজন অতিথির কাছে বা বর-কনের কাছে মন্তব্য করা এক জিনিস, আর হাজার হাজার অপরিচিত মানুষের কাছে তাকে ছোট করে তোলা ভিন্ন বিষয়।
দুঃখজনক হলো, এই বিষয়ে এসব গ্রুপের কোন চিন্তা নেই, যেহেতু প্রতি ঘণ্টায় অসংখ্য পোস্ট অ্যাপ্রুভ হচ্ছে আর প্রকাশিত হচ্ছে।
অনেকের বিয়ের ছবিতে মন্তব্যের সঙ্গে থাকে হাসির চিহ্ন হিসাবে এলওএল শব্দটি

No comments

Powered by Blogger.