ক্ষুদ্র প্রাণী মশা ‘ভয়ংকর’ দংশনে হতে পারে মারাত্মক ১২ রোগ by তোফাজ্জল হোসেন কামাল

ছোট প্রাণী মশার কমবেশি উৎপাত বছরজুড়েই লেগে থাকে রাজধানী ঢাকায়। এর উৎপাত কমাতে কাজ করে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারের মশক নিবারণ দফতর। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোট্ট এই প্রাণীটির উৎপাত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সালে দেশজুড়ে চিকুনগুনিয়া রোগ ভয়াবহ রুপে আবির্ভূত হলে প্রাণ সংহারের ঘটনাও ঘটে। দু’বছরের মাথায় এবার মশার উৎপাতের ভয়াবহতা দেখছে দেশবাসী। এবার মশাবাহিত রোগ ‘ডেঙ্গু’ আবির্ভূত হয়েছে ‘যমদূত’ হিসাবে। ইতোমধ্যে দেশের ৬০ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়েছে, যাতে আক্রান্ত হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৫ হাজারের ওপরে। আর নিহতের সংখ্যাও কম নয়, অর্ধশত ছুঁই ছুঁই।
মশার দংশনে ভয়ংকর ১২ রোগ
অনেকেরই ধারণা মশার কামড়ে শুধু ডেঙ্গু বা ম্যালেরিয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে চিকুনগুনিয়া দেশ কাঁপিয়েছে। এবার ডেঙ্গুতে ধরাশায়ী হচ্ছেন দেশবাসী। তবে ছোট্ট এই প্রাণীটি যে আরো কতো ভয়ংকর রোগের কারণ হতে পারে তা হয়তো অনেকেই জানেন না। মশার কামড়ে সৃষ্টি হয় ১২ ধরনের ভয়ংকর রোগ। আমেরিকান মসকিউটো কন্ট্রোল এসোসিয়েশনের (এএমসিএ) এক তথ্যে দেখা যায় যে , মশার কারনে প্রতিবছর সারাবিশ্বে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ লাখের অধিক মানুষ মারা যায়। শুধু মানুষই নয়, মশার কামড়ে কুকুর, ঘোড়া আক্রান্ত হয়ে প্যারালাইজডসহ মৃত্যুবরণও  করে থাকে। এক সময়ে এ দেশে মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যেত। এখন আর সে অবস্থা না থাকলেও দেশের পার্বত্য জেলাগুলোতে এখনও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে, যা ওই অঞ্চলের মানুষকে পীড়িত করে।
জিকা
সাম্প্রতিককালে মশাবাহিত ভয়ংকর রোগগুলোর মধ্যে জিকা অন্যতম। জিকা ভাইরাস যে রোগ সৃষ্টি করে তার নাম জিকা জ্বর। এর উপসর্গগুলো হলো জ্বর, মাথাব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, পেশীতে ব্যথা, শরীরে লালচে দাগ বা ফুসকুড়ি ইত্যাদি। এই ভাইরাসের কারণে মারাত্মক জটিলতা হয় গর্ভস্থ শিশুর, ছোট আকৃতির মাথা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই রোগের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেশে তুলনামূলক কম।
ওয়েস্ট নাইল ভাইরাস
এটি মশাবাহিত একটি ভয়ংকর রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্নায়ুবিকভাবে দুর্বল হয়ে পুঙ্গ হয়ে যেতে পারে। এই রোগের ভীতিকর দিকটি হলো, এটি কোনো প্রকার উপসর্গ ছাড়াই দেখা দেয়। ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতেই পারে না যে তিনি ওয়েস্ট নাইল ভাইরাসে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
ডেঙ্গু
সাধারণত উষ্ণম-লীয় দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি দেখা যায়। জিকা বা চিকনগুনিয়ার মতো স্ত্রী এডিস মশার মাধ্যমে এই রোগ ছড়ায়। উচ্চমাত্রায় জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা (মাথার সামনের অংশে), চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশীতে ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, র‌্যাশ, বমি বমি ভাব, বিতৃষ্ণাবোধ ইত্যাদি এই রোগের উপসর্গ। ডেঙ্গু জ্বর প্রাণঘাতী হতে পারে। এবার সেটাই প্রমানিত।
ওয়েস্টার্ন ইকুয়িন এনসেফালাইটিস
কিউলেক্স মশার কামড়ে এই রোগ হয়। জ্বর, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি এই রোগের উপসর্গ। সাধারণত বয়স্ক লোকেরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। পৃথিবীর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি এই রোগী দেখা যায়। তবে সংখ্যার বিচারে তা একেবারেই নগণ্য। ১৯৬৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা মাত্র ৭০০ জন।
চিকুনগুনিয়া
আফ্রিকা মহাদেশে এই রোগ বেশি হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ায়ও বেড়ে চলেছে। ডেঙ্গু ও জিকার ভাইরাস বহনকারী মশা এই রোগের কারণ। উপসর্গও ডেঙ্গুর মতো। তবে এই রোগে আক্রান্ত রোগী হাড়ের সংযোগস্থলে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। রোগটির কোনো প্রতিষেধক নেই।
ইয়োলো ফিভার
এর লক্ষণগুলো জন্ডিসের মতো। এই রোগ হলে সারা শরীর হলুদ রঙের হয়ে যায় এবং তীব্র জ্বর ও বমি বমি ভাব থাকে। আফ্রিকান দেশগুলোতে এই রোগ বেশি হয়ে থাকে।
লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস
মশাবাহিত রোগের মধ্যে লিমফেটিক ফাইলেরিয়াসিস কম পরিচিত হলেও এটি খুব ভয়ংকর। রোগটি ফাইলেরিয়া ধরনের একটি মারাত্মক ইনফেকশন, যার প্রভাবে মানুষের পা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক গুণ ফুলে ভারী হয়ে ওঠে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম তীরবর্তী অঞ্চলে এই রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি দেখা যায়।
জাপানি এনসেফালাইটিস
এ রোগ ছড়ানোর জন্য দায়ী কিউলেক্স মশা বাড়ির চারপাশের জলাভূমি ও স্থির পানি কিংবা কৃষি জমিতে জন্ম নেয়। মানবদেহে সংক্রমণের পর রোগটি কেন্দ্রীয় নার্ভ সিস্টেমে প্রবেশ করে। এছাড়া জ্বর, মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাব হয়। এশিয়া এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
সেন্ট লুইস এনসেফালাইটিস
কিউলেক্স মশাবাহিত একটি ভয়ংকর রোগ এটি। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমের রাজ্যগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। উপসর্গ হিসেবে জ্বর, মাথা ব্যাথা ও বমি বমি ভাব ইত্যাদি হয়ে থাকে। তবে এর তীব্রতা বাড়লে আক্রান্ত ব্যক্তি কয়েকদিনের জন্য সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে যেতে পারে। শিশুদের তুলনায় বয়স্করা এই রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকে। রোগটির কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি।
লা ক্রস এনসেফালাইটিস
যে সমস্ত মশা গাছের কোটরে জন্ম নেয় তাদের কাছে থেকে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। বয়স্করা এই রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকলেও ১৬ বছরের নিচের বাচ্চাদের জন্য এই রোগ অত্যন্ত ভয়ংকর। আটলান্টিক মহাসগরের দক্ষিণ পাড়ের দেশগুলোতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এই রোগের উপসর্গ হিসেবে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর ও বমি বমি ভাব হয়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই রোগে ভুগলে আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিকভাবে বিকলঙ্গ হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে।
ইস্টার্ন ইকুয়িন এনসেফালাইটিস
যুক্তরাষ্ট্রের মশাবাহিত রোগের মধ্যে ইস্টার্ন ইকুয়িন এনসেফালাইটিস অন্যতম। আমেরিকার ফ্লোরিডা, জর্জিয়া এবং নিউ জার্সিতে এই প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যায় এবং যারা রোগ আক্রান্ত হওয়ার পর বেঁচে যায় তাদের মস্তিস্কে সমস্যা দেখা দেয়। এই রোগের কোনো প্রতিষেধক নেই।
ভেনিজুয়েলা ইকুয়িন এনসেফালাইটিস
উপসর্গ এবং ফলাফলের দিক দিয়ে এটি ইস্টার্ন ইকুয়িন এনসেফালাইটিস গোত্রের রোগ। তবে এই রোগ গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিকর। কারণ এর ফলে অকালে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দক্ষিণ এবং মধ্য আমেরিকায় এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
ওষুধে যখন ভেজাল
অভিযোগ রয়েছে, মশার ওষুধ কেনায় সম্পৃক্ত সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশে মানহীন ওষুধ নিয়ে থাকেন। তবে ২০১১ সালের ২০ আগস্ট বিষয়টি হাতেনাতে ধরা পড়ে। ঠিকাদার মিজানুর রহমান খান ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকায় ৫০০ ড্রাম এডাল্টিসাইড ওষুধ সরবরাহ করেন। এক পর্যায়ে এ ওষুধ ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা যায়, ড্রামগুলোতে কোনো ওষুধই নেই।
বর্তমান দুই সিটি করপোরেশনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) দরপত্রের মাধ্যমে ওষুধ সংগ্রহ করে। এ ওষুধ খামারবাড়ির প্লান্টেশন উইং, গাজীপুরের এগ্রিকালচার রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও মহাখালীর আইইডিসিআর থেকে পরীক্ষা করা হয়। তিনটি পরীক্ষা রিপোর্টে ওষুধের মান ঠিক থাকলে ডিএনসিসি ওষুধ নেয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) আগে দরপত্রের মাধ্যমে ওষুধ কিনলেও গত কয়েক বছর ধরে নৌবাহিনীর ডকইয়ার্ডের কাছ থেকে ওষুধ সংগ্রহ করছে। এসব ওষুধও তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। তবে এই পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ পরীক্ষার সময় সিটি করপোরেশনের কোনো প্রতিনিধি থাকেন না। এমনকি মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের সময় কখনও কখনও নমুনা সংগ্রহ করেও মান যাচাই করা হয় না।

No comments

Powered by Blogger.