কেন কানাডায় আশ্রয় চেয়েছেন জানালেন বিচারপতি সিনহা

বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে তাকে হুমকি দেয়া হয়েছিল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল প্রসঙ্গে কানাডার দ্য স্টার পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিচারপতি সিনহা এ কথা বলেন। তিনি সম্প্রতি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান বিচারপতি বলেন, আমি অ্যাক্টিভিস্ট জাজ ছিলাম। যে কারণে আমাকে টার্গেট করা হয়। আমার দেয়া রায়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন আমলা, প্রভাবশালী, রাজনীতিক এমনকি সন্ত্রাসীরাও। তিনি বলেন, আমি যেন দেশের শত্রু, সেখানে  আমার থাকা নিষিদ্ধ। এসব কারণেই তিনি কানাডায় আশ্রয় চাইছেন।
তবে তার এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন কানাডার অটোয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূত মিজানুর রহমান। তিনি অটোয়া থেকে দ্য স্টার পত্রিকাকে বলেছেন, আমি আপনাদের যা বলতে পারি, তা হলো যখন তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন, তারপর থেকেই তিনি সরকার সম্পর্কে এমন বিভ্রান্তিকর বা অসত্য বক্তব্য দিয়ে আসছেন। দেশে ফেরার ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে মোটেও কোনো হুমকি নেই। তিনি আশ্রয়ের দাবিকে জোরালো করতে এসব বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

দ্য স্টার পত্রিকার ইমিগ্রেশন বিষয়ক প্রতিবেদক নিকোলাস কেউং এ নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে হুমকি দেয়া হয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা করছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কথা তিনি বলছেন তাতে ভিন্ন মতাবলম্বী বিচারকদের সরিয়ে দিতে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদকে বৃহত্তর ক্ষমতা দেয়া হয়। এস কে সিনহার অভিযোগ, সরকারের অনুকূলে একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর পক্ষে রায় দিতে তাকে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর তিন মাস পরে ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে ৬৮ বছর বয়সী এস কে সিনহা নির্বাসনে রয়েছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ সময় কেটেছে তার যুক্তরাষ্ট্রে।

এস কে সিনহা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়া প্রথম হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। তিনি গত ৪ঠা জুলাই ফোর্ট ইরি দিয়ে কানাডা প্রবেশ করে আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন জমা দিয়েছেন। এ মাসের শুরুতে বাংলাদেশি মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশের দুর্নীতিবিরোধী কমিশন (দুদক) সাবেক এই বিচারপতি এবং ব্যাংকের সাবেক একজন নির্বাহীসহ মোট ১১ জনের বিরুদ্ধে ঘুষ, অর্থ পাচার ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে মামলা করেছে। তবে এসব অভিযোগ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন এস কে সিনহা। এসব অভিযোগের তদন্ত সম্পর্কে দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য স্টার। তবে তারা এ বিষয়ে সাড়া দেয় নি।

নিকোলাস কেউং লিখেছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার প্রস্থানকে বিচার বিভাগের ওপর বাংলাদেশ সরকারের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকারের পক্ষে যারা তাদেরকে মাঝে মাঝেই হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে। জোরপূর্বক গুম অব্যাহত আছে।

নিকোলাস কেউং আরো লিখেছেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ। তখন থেকেই এর যাত্রা শুরু হয় বহুদলীয় ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে। এরপরই তা একদলীয় শাসনের অধীনে চলে যায়। তারপর এক গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা। তারপর থেকেই এ দেশটি শাসন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এবং পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায়। গত বছর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসেন হাসিনা।

আশ্রয় চেয়ে করা আবেদনে এস কে সিনহা দাবি করেছেন, ২০১৭ সালের ২রা জুলাই তাকে এক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সংবিধান সংশোধনের পক্ষে তাকে রায় দিতে সেই বৈঠকে অনুরোধ করেন সরকার প্রধান। সিনহা বলেন, এই সংশোধনী পাস হলে ক্ষমতায় থাকা বিচারকদের সরিয়ে দেয়া সরকারের পক্ষে সহজ হতো। এ প্রসঙ্গে এস কে সিনহা বলেন, আমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমাদের গণতন্ত্র শৈশবকালে এখন। আরো বলেছিলাম, দেশে কোনো আইনের শাসন নেই।

এস কে সিনহা ১৯৯৯ সালে প্রথম হাইকোর্ট ডিভিশনে বিচারপতি নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এর এক দশক পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগ পান। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তাকে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। সরকারের ওই রকম অনুরোধের প্রেক্ষিতে এস কে সিনহা বলেন, এমন পরিস্থিতিতে জাতির বিবেকের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। সরকারের হাতের পুতুল হিসেবে একে কাজ করানো অনুমোদন দেয়া যায় না। সরকারের কথা মানতে মারাত্মক চাপ ছিল আমার ওপর। কিন্তু আমি আমার অবস্থানে অটল ছিলাম।

নিকোলাস কেউং লিখেছেন, ২০১৭ সালে তাকে হয়রানি করেছে বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা তাকে বিচারিক পদ থেকে অসুস্থতার জন্য ছুটি নিতে বাধ্য করেছে বলে তার অভিযোগ। এমন কি তারা তাকে গৃহবন্দি করেছিল। তিনি আরো দাবি করেছেন, এ সময়ে তার কাছে কোনো ভিজিটরকে আসতে দেয়া হয়নি। তখন তিনি ও তার স্ত্রী একটানা নজরদারিতে ছিলেন। তিনি বলেন, এমন অবস্থায় তিনি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সহায়তা ‘ছুটিতে’ দেশ ছাড়তে রাজি হন। তারাই তার জন্য অস্ট্রেলিয়ার ভিসা করিয়ে দেন দ্রুততার সঙ্গে। অস্ট্রেলিয়ায় সিনহার দুই মেয়ের একজন বসবাস করেন। এস কে সিনহা বলেন, বাংলাদেশে ফেরার পথে তিনি যখন সিঙ্গাপুরে যাত্রাবিরতিতে তখন বাংলাদেশি একজন গোয়েন্দা এজেন্ট তাকে হুমকি দেন। তাকে দেশে ফিরতে বারণ করেন এবং তাকে পদত্যাগের জন্য চাপ দেন।

নিকোলাস কেউং লিখেছেন, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে কানাডার উদ্দেশে যাত্রা করেন এস কে সিনহা। সেখানে তার অন্য মেয়ে অবস্থান করেন। তিনি কানাডার মানিতোবাতে পড়াশোনা করছিলেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নিউজার্সিতে তার ভাইয়ের সঙ্গে অবস্থান করতে থাকেন এস কে সিনহা। যুক্তরাষ্ট্রেও আশ্রয়ের প্রার্থনা করেছেন তিনি। তবে সেখান থেকে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পান নি। এস কে সিনহা এরই মধ্যে প্রকাশ করেছেন আত্মজীবনী ‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’। সরকারের পক্ষে রায় দিতে কিভাবে বিচারকদের ভীতি প্রদর্শন করা হয় তার বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এ বইয়ে।

এস কে সিনহা বলেছেন, গত সেপ্টেম্বরের আগে তিনি কানাডায় আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি পরিকল্পনাও করেন নি। এ সময়ে নিউজার্সিতে তার ভাইয়ের বাড়ির ছবি বাংলাদেশি মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এস কে সিনহা বলেন, টরেন্টো যাওয়ার সিদ্ধান্ত তিনি সম্প্রতি নিয়েছেন, যখন তার স্ত্রী খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি কানাডায় মেয়ের সঙ্গে অবস্থান করতে চান।

No comments

Powered by Blogger.